লঘু প্রাণায়াম (Laghu Pranayama):
নিয়মিত অভ্যাসের মাধ্যমে সহজ প্রাণায়ামে অভ্যস্ত হয়ে যাবার পর লঘু প্রাণায়াম অভ্যাস করা যেতে পারে। লঘু প্রাণায়ামে (Laghu Pranayama) দম নেয়া বা পূরক (Puraka), দম আটকে বায়ু ধারণ করে রাখা বা কুম্ভক (Kumbhaka) এবং দম ছাড়া বা রেচক (Rechaka) প্রক্রিয়া যথানিয়মে অনুসরণ করতে হয়।
এর মধ্যে কুম্ভক (Kumbhaka) বা দম আটকে রাখার সময় ও প্রক্রিয়া যথাযথ না হলে পূরকান্ত-কুম্ভকে রক্তে ক্ষতিকারক কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বেড়ে এবং রেচকান্ত-কুম্ভকে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন ঘাটতির কারণে শরীরে সৃষ্ট তীব্র স্নায়ুচাপে সহনশীলতার পর্যায় ছাড়িয়ে সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে বলে সদগুরুর তত্ত্বাবধান ছাড়া কুম্ভক প্রাণায়াম অভ্যাস করা উচিত নয়। যোগশাস্ত্রীদের মতে ‘হঠযোগ-প্রদীপিকা’ (Hatha Yoga Pradipika) গ্রন্থে উল্লেখিত লঘু প্রাণায়াম আট ধরনের। যথা- ১.০ সূর্যভেদ (Surya Bhedan), ২.০ উজ্জায়ী (Ujjayi), ৩.০ সীৎকারী (Sitkari), ৪.০ শীতলী (Shitali), ৫.০ ভ্রামরী (Bhramari), ৬.০ ভস্তিকা (Bhastrika), ৭.০ মূর্চ্ছা (Moorcha) ও ৮.০ প্লাবনী (Plavini)।
এক্ষেত্রে একান্তই উল্লেখিত প্রাণায়ামের অভ্যাস করতে হলে কুম্ভক প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে শুধু পূরক ও রেচক ক্রিয়ার মাধ্যমে প্রথম পাঁচটি প্রাণায়াম সতর্কতার সাথে অভ্যাস করা যেতে পারে। সাধারণ অভ্যাসকারীদের জন্য শেষোক্ত তিনটি প্রাণায়াম অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
(০১) সূর্যভেদ প্রাণায়াম (Surya Bhedan Pranayama):
পদ্ধতি:
পদ্মাসনে বা যে কোন ধ্যানাসনে সোজা হয়ে বসে অনামিকা ও কনিষ্ঠা আঙুল দিয়ে বাম নাসাপুট বন্ধ করুন এবং বৃদ্ধাঙ্গুলি দক্ষিণ নাসাপুটের উপর আলতোভাবে রাখুন। এবার পিঙ্গলা নাড়ী অর্থাৎ দক্ষিণ নাসাপুট দিয়ে ধীরে ধীরে দমভোর শ্বাসগ্রহণ বা পুরক করুন। পুরকান্তে অর্থাৎ শ্বাসগ্রহণ শেষ হলে আকর্ষিত বায়ু জালন্ধরবন্ধ, উড্ডীয়ানবন্ধ ও মূলবন্ধ এই তিনটি মুদ্রা দ্বারা ধারণ করে নিজ নিজ সাধ্যানুযায়ী ১০/১৫ সেকেন্ড দম আটক বা কুম্ভক করুন- যে পর্যন্ত না পায়ের নখ হতে মাথার চুল পর্যন্ত দেহস্থ সমস্ত নাড়ী’র বায়ু রোধ হয়।
এরপর বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা দক্ষিণ নাসাপুট বন্ধ করে অনামিকা ও কনিষ্ঠা আঙুল আলগা করে ইড়া নাড়ী দ্বারা অর্থাৎ বাম নাসাপুট দিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাসত্যাগ বা রেচক করুন। শ্বাস ছাড়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে- পূরকে যত সময় লেগেছে রেচক অভ্যাসকালে যেন তার চেয়ে সময় বেশি না লাগে। অর্থাৎ পূরক, কুম্ভক ও রেচকের সময়ানুপাত হবে ২ ঃ ১ ঃ ২। তাড়াহুড়ো করে রেচক অভ্যাস করা যাবে না।
এইভাবে নিজ নিজ সামর্থমতো ৪ থেকে ৬ মিনিট প্রাণায়ামটি অভ্যাস করুন।
চিন্তা:
প্রতিবার কুম্ভকের সময় চিন্তা করতে হবে- আমার যত রোগ-ব্যাধি ও দুর্বলতা সব দূর হয়ে যাচ্ছে এবং আমার শরীর এক অসীম প্রাণশক্তিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে।
উপকারিতা:
এই প্রাণায়াম অভ্যাসে স্নায়ুর দুর্বলতা দূর হয়ে দেহ সবল হয়ে উঠে। ফুসফুস, পাকস্থলী ও যকৃত সুস্থ সবল হয়ে ওঠে, এরা সহজে রোগাক্রান্ত হয় না। ক্ষুধামন্দা রোধ করে, কৃমি নাশ করে। দেহের মেদ হ্রাস এবং নাসাতন্ত্রের যাবতীয় রোগ নিরাময় করে শ্লেষ্মাদোষ নাশ করে।
(০২) উজ্জায়ী প্রাণায়াম (Ujjayi Pranayama):
পদ্ধতি:
পদ্মাসনে বা যে কোন সহজ ধ্যানাসনে সোজা হয়ে বসুন। এবার মুখ বন্ধ রেখে গলা বা ভোকাল কর্ড হতে সশব্দে উভয় নাক দিয়ে বুক ভরে শ্বাসগ্রহণ বা পূরক করুন। শ্বাসগ্রহণ শেষ হলে চিবুক কণ্ঠকূপে রেখে জালন্ধরবন্ধ অবস্থায় বস্তিপ্রদেশের স্নায়ুগুলোকে আকর্ষণ করে নিজ নিজ সামর্থ অনুযায়ী ১০ থেকে ২০ সেকেন্ড পর্যন্ত বায়ুধারণ বা কুম্ভক করুন। এবার স্নায়ুর আকর্ষণ শিথিল করে এবং বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা ডান নাসাপুট বন্ধ করে বাম নাক দিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাসত্যাগ বা রেচক করুন।
এভাবে উভয় নাক দিয়ে ৬ থেকে ১২ বার প্রাণায়ামটি অভ্যাস করুন।
চিন্তা:
প্রতিবার কুম্ভকের সময় চিন্তা করতে হবে- আমার স্খলনদোষ দূর হয়ে যাচ্ছে এবং আমি উর্ধ্বরেতা হয়ে উঠছি। আর মেয়েরা চিন্তা করবে- আমার রতিগ্রন্থির রসাদির অনিচ্ছাকৃত ক্ষরণ এবং প্রদরাদি রোগ আরোগ্য হচ্ছে এবং আমি কামজয়ী হয়ে উঠছি।
উপকারিতা:
এই প্রাণায়াম অভ্যাসে ফুসফুসের ভালো কাজ হয়, সর্দি-কাশি নিরাময় হয় এবং ইনফুয়েঞ্জা, নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস, টাইফয়েড প্রভৃতি কফরোগ ও হাঁপানি সেরে যায়। স্ত্রী পুরুষের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং জরা রোধ হয়। উচ্চরক্তচাপ রোগের ক্ষেত্রে এই প্রাণায়ামে আশ্চর্য সুফল পাওয়া যায়।
(০৩) সীৎকারী প্রাণায়াম (Sitkari Pranayama):
পদ্ধতি:
পদ্মাসন বা যে কোন সহজ ধ্যানাসনে বসে মুখ ও ঠোঁট সরু করে পরস্পর সংলগ্ন করুন এবং জিহ্বার অগ্রভাগ সরু হয়ে থাকা মুখ ও ঠোঁটের সাথে স্থাপন করুন। এবার মুখ দিয়ে একটানা সি সি সি শব্দ করতে করতে বেশ জোরের সঙ্গে ধীরে ধীরে মুখ দিয়েই বুক ভরে পূরক বা শ্বাস নিতে থাকুন। শ্বাসগ্রহণ শেষ হলে ৫/১০ সেকেন্ড বায়ু ধারণ বা কুম্ভক করে অতঃপর উভয় নাক দিয়ে শ্বাস ত্যাগ বা রেচক করুন। এভাবে নিজ সামর্থ অনুযায়ী চার থেকে ছয় মিনিট প্রাণায়ামটি অভ্যাস করুন।
চিন্তা:
প্রতিবার কুম্ভকের সময় চিন্তা করতে হবে- আমার আলস্য নিদ্রা ও তমোভাব দূর হয়ে যাচ্ছে এবং আমার দেহমন দিব্য-শক্তির অধিকারী হয়ে উঠছে।
উপকারিতা:
এই প্রাণায়াম অভ্যাসে আলস্য, নিদ্রা, জড়তা ও শারীরিক দুর্বলতা দূর হয়ে দেহ স্বাস্থ্যোজ্জ্বল ও বলশালী হয়। যোগশাস্ত্রীদের মতে এই প্রাণায়াম অভ্যাসে দেহ সৌন্দর্য্যমণ্ডিত হওয়ায় পুরুষেরা কামদেবের মতো রূপবান এবং মেয়েরা অসামান্যা রূপবতী হন।
(০৪) শীতলী প্রাণায়াম (Shitali Pranayama):
পদ্ধতি:
পদ্মাসন বা যে কোন সহজ ধ্যানাসনে শিরদাঁড়া সোজা করে বসুন। এবার মুখ ও ঠোঁট পাখির ঠোঁটের মতো সরু করে জিহ্বাগ্র মুখের একটু বাইরে নিয়ে আসুন এবং মুখ দিয়ে বেশ জোরে ও ধীরে ধীরে দমভোর পূরক বা শ্বাসগ্রহণ করুন। পূরক বা শ্বাসগ্রহণ শেষে আকর্ষিত বায়ু জালন্ধরবন্ধ, উড্ডীয়ানবন্ধ ও মূলবন্ধ এই তিনটি মুদ্রা দ্বারা ধারণ করে নিজ সামর্থানুযায়ী ১০/১৫ সেকেন্ড কুম্ভক করুন, যে পর্যন্ত না পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত দেহস্থ নাড়ীগুলোর বায়ু রোধ হয়। এরপর উভয় নাক দিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাসত্যাগ বা রেচক করুন। এভাবে নিজ নিজ সামর্থমতো ৫/৬ মিনিট ধরে প্রাণায়ামটি অভ্যাস করুন।
চিন্তা:
প্রতিবার কুম্ভকের সময় সীৎকারী প্রাণায়ামের মতোই চিন্তা করতে হবে- আমার আলস্য নিদ্রা ও তমোভাব দূর হয়ে যাচ্ছে এবং আমার দেহমন দিব্য-শক্তির অধিকারী হয়ে উঠছে।
উপকারিতা:
এই প্রাণায়াম অভ্যাস রক্ত শুদ্ধ হয় এবং দারুণভাবে প্রাণশক্তি বৃদ্ধি পায়। পিত্তরোগীদের জন্য, যাদের হাতে পায়ে গায়ে জ্বালা বোধ হয় তাদের জন্য এই প্রাণায়াম বিশেষ উপকারী। চর্মরোগ থেকে মুক্ত থাকা যায় এবং উচ্চরক্তচাপ রোগীদের জন্য আশ্চর্য সুফল আনে, তবে তাদের জন্য কুম্ভক বাদ দিয়ে শুধু পূরক ও রেচক অভ্যাস বাঞ্ছনীয়।
নিষেধ:
ঠাণ্ডা আবহাওয়া কিংবা শীতকালে সূর্য না ওঠা পর্যন্ত এই প্রাণায়াম অভ্যাস করা নিষেধ। কফপ্রধান ব্যক্তিদের জন্যেও প্রাণায়ামটি করা উচিত নয়।
(০৫) ভ্রামরী প্রাণায়াম (Bhramari Pranayama):
পদ্ধতি:
বজ্রাসন বা সুখাসনে সোজা হয়ে বসুন। এবার দু’হাতের বৃদ্ধাঙুল বা তর্র্জনি দিয়ে দু’কানের ছিদ্র হালকাভাবে বন্ধ করে নিন। এখন দুই নাক দিয়ে দম ভরে পূরক বা শ্বাস গ্রহণ করুন। পুরক শেষে আকর্ষিত বায়ু ধারণ করে ৮/১০ সেকেন্ড কুম্ভক করুন।
এরপর ধীরে ধীরে ভ্রমরের ডাকের মতো শব্দ করতে করতে দুই নাক দিয়ে রেচক বা শ্বাস ত্যাগ করুন। আবার পূরক বা স্বাভাবিক দম নিয়ে ৮/১০ সেকেন্ড কুম্ভক করে ধীরে ধীরে পুনরায় ভ্রমরের ডাকের মতো শব্দ করতে করতে শ্বাসত্যাগ বা রেচক করুন। রেচকের সময় খেয়াল রাখতে হবে, আমাদের স্বরযন্ত্র বা ভোকাল কর্ড যখন কাঁপবে তখন স্বরযন্ত্রের কম্পন যেন আমাদের কানের পর্দা বা টিমপ্যানিক মেমব্রেন-এ অনুভূত হয়।
এইভাবে পূরক, কুম্ভক ও রেচক অভ্যাস করলে একবার ভ্রামরী অভ্যাস করা হয়। প্রতি দফায় পাঁচবার পূরক, কুম্ভক ও রেচক করে এই প্রাণায়াম চার দফায় অভ্যাস করুন। প্রতি দফা অভ্যাসের পর ১৫ সেকেন্ড করে শবাসন অভ্যাস করতে হবে।
উপকারিতা:
এ প্রাণায়াম নিয়মিত অভ্যাস করলে শ্রবণেন্দ্রিয় সতেজ থাকে, গলার স্বর মিষ্ট হয় এবং গলায় শ্লেষ্মা জমতে পারে না। যারা কানে কম শোনে, এই প্রাণায়াম অভ্যাসে শ্রবণেন্দ্রিয়ের উন্নতি হয় এবং স্বাভাবিক শ্রবণক্ষমতা ফিরে আসে।
(০৬) ভস্তিকা প্রাণায়াম (Bhastrika Pranayama):
পদ্ধতি:
পদ্মাসনে সোজা হয়ে বসুন। এবার ডানহাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে ডান নাক চেপে ধরে বাঁ নাক দিয়ে সজোরে থেমে থেমে কপালভাতি প্রাণায়ামের অনুরূপ দ্রুত রেচক বা শ্বাস ত্যাগ করে উদর বায়ুশূন্য করুন এবং পেট ও তলপেট আকুঞ্চিত করে মেরুদণ্ডের সাথে লাগানোর চেষ্টা করুন। পেটের পেশীতে যেন হঠাৎ টান না পড়ে।
রেচকান্তে ডান নাক থেকে বুড়ো আঙুল আলগা করে অনামিকা ও কনিষ্ঠা আঙুল দিয়ে বাঁ নাক চেপে ধরে আকুঞ্চন শিথিল করে ডান নাক দিয়ে বুক ভরে দ্রুত দম নিয়ে পূরক করুন। পুরকান্তে চিবুক কণ্ঠকূপে স্থাপন করে আকর্ষিত বায়ু জালন্ধরবন্ধ করে নিজ সাধ্যানুযায়ী কুম্ভক করুন। এরপর আবার বাঁ নাক মুক্ত করে বুড়ো আঙুল দিয়ে ডান নাক চেপে বাঁ নাক দিয়ে সজোরে দ্রুত রেচক বা শ্বাসত্যাগ করুন। এভাবে ২/৩ বার প্রাণায়ামটি অভ্যাস করুন।
(০৭) মূর্চ্ছা প্রাণায়াম (Moorcha Pranayama):
(০৮) প্লাবনী প্রাণায়াম (Plavini Pranayama):
Leave a Reply