স্বাস্থ্য সমস্যাটি শিল্পোন্নতদেশগুলোয় প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে এবং এরা একে মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে। কিন্তু উদ্বেগের ব্যাপার হচ্ছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোয় এমনকি বাংলাদেশেও শিশু ও তরুণেরা স্থূল হচ্ছে সমাজের কোনো কোনো স্তরে। বাচ্চারা, তরুণেরা ফাস্টফুড খাচ্ছে, টিভির সামনে একটানা অনেক সময় বসে আছে, চিবুচ্ছে চিপস, পান করছে কোমল পানীয়, ভিডিও গেম খেলছে, খেলা জীবন থেকে নির্বাসিত এরা। স্কুল আছে, খেলার মাঠ নেই, হাঁটাপথও নেই, সেখানে রিকশার গ্যারেজ ও দোকান, যানজট, পরিবেশদূষণ, তেলেভাজা খাবার-ভুঁড়ি হবে না তো কী হবে?
কেন এই উদ্বেগ? স্থূল হলে নানারকমের রোগ শরীরে বাসা বাঁধে আর ধীরে ধীরে জীবনশক্তিকে হরণ করে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, যেসব শিশুর শরীরের ওজন বেশি, তাদের মধ্যে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি খুব বেশি। অথচ এ ধরনের ডায়াবেটিস বয়স্কদের মধ্যেই দেখা দেওয়ার কথা। অথচ যুক্তরাষ্ট্রে, বিশেষ করে শিশুদের স্থূলতার একটি মহামারি হওয়ায় এমন ধরনের ডায়াবেটিস প্রবলভাবে দেখা দিচ্ছে তাদের মধ্যে। সে দেশের একটি পরিসংখ্যান দিই। ন্যাশনাল হেলথ অ্যান্ড নিউট্রিশন হেলথ অ্যান্ড নিউট্রিশন এক্সামিনেশন সার্ভের সত্তর দশকের একটি সমীক্ষায় দেখা যায়-
দুই থেকে পাঁচ বছর শিশুদের মধ্যে স্থূলতা ৫ শতাংশ, ছয় থেকে ১১ বছর শিশুদের মধ্যে স্থূূলতা ৪ শতাংশ, ১২ থেকে ১৯ বছর শিশু বা তরুণদের মধ্যে ৬·১ শতাংশ
২০০৪ সালে কী হলো? দুই থেকে পাঁচ বছর শিশুদের মধ্যে স্থূূলতা ১৩·৯ শতাংশ, ছয় থেকে ১১ বছর শিশুদের মধ্যে ১৮·৮ শতাংশ ১২ থেকে ১৯ বছর তরুণদের মধ্যে ১৭·৪ শতাংশ।
সমস্যাটি তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ যেসব শিশু ও তরুণের টাইপ-২ ডায়াবেটিস হয়, তারা মুখোমুখি হয় জীবনব্যাপী জটিলতার। কিডনি নিষ্ত্র্নিয় হওয়া, হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপ এসব জটিলতার মধ্যে কয়েকটি মাত্র। বাংলাদেশে এ রকম প্রবণতা লক্ষ করা গেছে, যদিও সমীক্ষা ও পরিসংখ্যান কমই রয়েছে এ ক্ষেত্রে। দেখা গেছে, টাইপ-২ ডায়াবেটিস শিশু ও তরুণদের মধ্যে বাড়ছে এবং এ জন্য তাদের ফাস্টফুড খাওয়া ও শরীরচর্চা না করা এবং বসে বসে টিভি দেখা, ভিডিও দেখা ও ভিডিও গেম খেলাকেই দায়ী করা হচ্ছে। সত্যি তাই। ডায়াবেটিসের এ ধরনটি শিশু ও তরুণদের মধ্যে পৃথিবীজুড়ে বাড়ার কারণ হিসেবে দিনের বেশি সময় বসে থাকার অভ্যাসকেই দায়ী করা হচ্ছে।
১৯৮০ সালের শেষ দিকে শিশুদের মধ্যে সচরাচর দৃষ্ট ডায়াবেটিস ছিল টাইপ-১ ডায়াবেটিস। অগ্নাশয় যদি ইনসুলিন খুব সামান্য উৎপাদন করে অথবা অনেক ক্ষেত্রে একেবারেই করে না তখন টাইপ-১ ডায়াবেটিস হয়।
আবার শরীর যদি কমই ইনসুলিন তৈরি করে বা ঠিকমতো করলেও ওই ইনসুলিন কার্যকর হয় না, তখন টাইপ-২ ডায়াবেটিস হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে শৈশবে স্থূলতা টাইপ-২ ডায়াবেটিসের এই বৃদ্ধির কারণ। এছাড়াও রয়েছে আরো কিছু কারণ।
যেমন-
— শিশুদের মধ্যে শরীরচর্চা কমে যাওয়া। বাচ্চারা আর স্কুলে হেঁটে যাচ্ছে না, ঘরের কাজও করছে না তেমন, স্কুলে ব্যায়াম চর্চা নেই, খেলাও নেই তেমন।
— ‘অলস শখ’ বেড়ে যাওয়া। যেমন-টিভি দেখা ও কম্পিউটার গেমস খেলা। আট থেকে ১৬ বছরের চারজনের মধ্যে একজন শিশু দিনে অন্তত চার ঘণ্টা টিভি দেখে।
যেসব শিশু যে পরিমাণ সময় টিভি দেখে, তাদের বিএমআই (বডিমাস ইনডেক্স, স্থূলতার একটি পরিমাপ) অনেক বেশি। যারা দুই ঘণ্টার কম সময় টিভি দেখে, তাদের তুলনায় তো বটেই।
— খাদ্য গ্রহণে ত্রুটিপূর্ণ অভ্যাস, ঘরে রান্না হচ্ছে না, বাইরে খাওয়া হচ্ছে বেশি।
নি্নবিত্ত পরিবারে সমস্যা আরও বেশি। তাদের অনেকের পক্ষে বাচ্চাদের জন্য খেলার বা ব্যায়ামের নিরাপদ স্থান পাওয়া কঠিন। স্বাস্থ্যকর খাবার জোগাড় করাও কঠিন তাদের জন্য। নি্নবিত্ত পরিবারের বাচ্চারা ফলমূল, সবজির চেয়ে বরং তেলভাজা দূষিত খাবারই খাচ্ছে বেশি। মা-বাবারা যেসব খাবার খেতে পছন্দ করেন এর প্রভাব অনেকটাই পড়ে বাচ্চাদের ওপর। মা-বাবারা স্বাস্থ্যকর খাবার খেলে; তেল, চর্বি, চিনি, লবণ কম খেলে, বেশি ফল, শাকসবজি খেলে বাচ্চারা ধীরে ধীরে এসব খেতে অভ্যস্ত হতে পারে। আরও আছে টিপস-
— টিভি বন্ধ করে দিন। টিভি দেখার সময় কমিয়ে নিতে পারলে, এর একটি সীমারেখা টানতে পারলে স্থূলতা প্রতিরোধ করা যাবে অনেকটা। স্থূল হওয়ার পথ সুগম হয়, এমনকি ছোট বাচ্চাদের স্থূল হওয়ার জন্য পথ সুগম হয় বেডরুমে টিভি রাখলে।
— হাঁটতে, চলতে, দৌড়াতে উৎসাহ দিন বাচ্চাদের। দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন। বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে হাঁটুন অথবা সাইকেল চালান।
সব ধরনের বসে থেকে বিনোদন করা, যেমন-কম্পিউটার গেম বা ইন্টারনেটে খুব বেশি সময় ব্যয় করা কমাতে পারলে বেশ কাজ হয়।
— এক সঙ্গে বসে খান। পরিবারে একত্রে বসে যত কম খাবেন, তত কম খাওয়া হয় ফল ও সবজি। বেশি খাওয়া হয় ফাস্টফুড ও কোমল পানীয়।
— শিশুদের ওপর বেশি নিয়ন্ত্রণ নয়। নিয়ন্ত্রণ যেন খেয়ালের ঘোড়া না হয়। শিশুদের স্বাস্থ্যকর খাবার পছন্দ করারও সুযোগ দিতে হবে।
— তাই অনবরত শরীরের ওজন নিয়ে বকাঝকা করবেন না। প্লেটে যা কিছু আছে সবকিছু খেয়ে প্লেট সাফ করতে বাচ্চাদের বাধ্য করবেন না।
— খাবারকে পুরস্কার বা শাস্তি হিসেবে ব্যবহার করবেন না।
শিশুর জন্য মা-বাবা যেন একজন ভালো রোল মডেল হতে পারেন। শিশুদের স্বাস্থ্যকর খাবার ও অভ্যাস রপ্ত করতে, পছন্দ করতে সাহায্য করুন।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম হাসপাতাল, সাম্মানিক অধ্যাপক
ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ০২, ২০০৯
Leave a Reply