বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় হৃদরোগের প্রকোপ পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে ৫০-৬০ গুণ বেশি। বাংলাদেশে প্রায় দুই কোটি হৃদরোগী রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান রোগগুলো হচ্ছে করোনারী ধমনীর রোগ, হার্ট ভাল্বের রোগ, শিশুদের জন্মগত হার্টের সমস্যা ইত্যাদি। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের হৃদরোগে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা তিন লাখের ওপর। আর প্রতিদিনই এ সংখ্যা বাড়ছে।
বিপুলসংখ্যক বয়স্ক ও শিশু হৃদরোগী সমাজ তথা দেশের ওপর একটি বিরাট বোঝা। এ ধরনের রোগের চিকিৎসার জন্য প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও খরচ হয়ে যাচ্ছে। দেশে হৃদরোগের চিকিৎসা সাম্প্রতিক সময়ে উন্নত হওয়ায় যদিও দিন দিন বিদেশগমনকারী হৃদরোগীর সংখ্যা কমছে, তবু এখনো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগী উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ যায়। বেসরকারি খাতে অনেকগুলো নতুন হাসপাতালে হৃদরোগের সেবার মান তুলনামূলকভাবে বাড়লেও এসব হাসপাতালে চিকিৎসাসেবার খরচ সাধারণ জনগণের সীমার বাইরে রয়ে গেছে। দেশে হৃদরোগের চিকিৎসার জন্য সরকার পরিচালিত হাসপাতাল শুধু একটি, বাকি সব কটি বেসরকারি। দরিদ্র জনগোষ্ঠীসহ সবাইকে সুলভে, সহজে এবং উন্নত হৃদরোগের সেবা দিতে হলে সারা দেশে সরকারিভাবে কার্ডিয়াক কেয়ার ইউনিটের বিস্তৃৃতি ঘটানো ছাড়া গত্যন্তর নেই। স্বাধীনতা-উত্তরকাল থেকে হৃদরোগসহ বিভিন্ন রোগের ক্ষেত্রে সাধারণ জনগণের জন্য স্বাস্থ্যসেবা থেকে গেছে সব সময়ই অবহেলিত। তবে আশার কথা, বর্তমান সরকার স্বাস্থ্যসেবা তথা হৃদরোগের চিকিৎসা বাড়ানোর ব্যাপারে দৃষ্টি দিয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এই সেবাকে ঢাকাকেন্দ্রিক না রেখে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সম্প্রতি একটি দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। উন্নত বিশ্বে যেখানে ১০-১৫ লাখ লোকের জন্য একটি হৃদরোগের সেন্টার বা হাসপাতাল রয়েছে, যেখানে সব ধরনের ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা থেকে শুরু করে হৃদযন্ত্রে অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করা হয়, সেখানে আমাদের দেশে প্রতি এক কোটি মানুষের জন্য সরকারিভাবে অন্তত একটি পূর্ণাঙ্গ কার্ডিয়াক সেন্টার বা হাসপাতাল স্থাপন করা দরকার।
বাংলাদেশ কার্ডিওলজিস্টদের সংখ্যা ৩০০ জনের কিছু বেশি, কার্ডিয়াক সার্জনের সংখ্যা ৮০ জনের মতো, আর কার্ডিয়াক অ্যানেসথেসিস্ট ও পারফিউশনিস্ট আছেন হাতে গোনা কয়েকজন। আর তাঁদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি বেসরকারি খাতে কর্মরত। এই অল্পসংখ্যক জনশক্তি নিয়ে দেশব্যাপী কার্ডিয়াক সার্ভিস বা হৃদরোগের সেবা দেওয়া দুরূহ, তবে অসম্ভব নয়। দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পরিকল্পনা নিয়ে এগোলে আগামী তিন থেকে চার বছরের মধ্যে সারা দেশের সাধারণ জনগোষ্ঠীকে সরকারিভাবে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে হৃদরোগের সেবার আওতায় আনা সম্ভব।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো হচ্ছে গ্রামবাংলার চিকিৎসার প্রাণকেন্দ্র। অনেক উপজেলা হাসপাতালে কার্ডিওলজিস্টের পদ থাকলেও জনবলের অভাবে এ রোগের সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, আনুষঙ্গিক জনবল নিয়োগের মাধ্যমে মেডিসিন স্পেশালিস্টকে স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁদের মাধ্যমে প্রাথমিক হৃদরোগের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। জটিল হৃদরোগীদের উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব না হলে সরাসরি কাছের জেলা হাসপাতালের জরুরি কার্ডিয়াক কেয়ার সেন্টারে স্থানান্তর করা যেতে পারে। এ জন্য সব জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনীয় ডায়াগনস্টিক সুবিধাসহ করোনারি কেয়ার ইউনিট স্থাপন করা দরকার। দেশে বর্তমানে কার্ডিওলজির প্রশিক্ষিত যে জনবল রয়েছে, তাতে সহজেই জেলা হাসপাতালগুলোতে হৃদরোগের জরুরি ও রুটিন চিকিৎসাসেবা দেওয়া যেতে পারে।
যেসব রোগীর এনজিওগ্রাম বা অন্য ইনভেসিভ পরীক্ষার দরকার হবে, তাদের কাছের হাসপাতালে পাঠানো যেতে পারে, যেখানে এনজিওগ্রাম বা এ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ রয়েছে। পুরোনো জেলা হাসপাতালগুলোতে সরকারি উদ্যোগে পর্যায়ক্রমে এ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ‘ক্যাথ ল্যাব’ স্থাপন করা যেতে পারে।
দেশে ১৪টি কার্ডিয়াক সার্জিক্যাল হাসপাতালের মধ্যে ১৩টি ঢাকায় অবস্থিত। দূরদূরান্ত থেকে ঢাকায় এসে হৃদযন্ত্রে অস্ত্রোপচার করা রোগীর চিকিৎসা নেওয়া রোগী ও তার আত্মীয়স্বজনের জন্য ব্যয়বহুল, অসুবিধাজনক ও ভোগান্তির। এ জন্য বিভাগীয় সদরে বা পুরোনো মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে কার্ডিয়াক সার্জারি ইউনিট স্থাপন করা দরকার। এসব হাসপাতালে বয়স্ক রোগী, শিশু ও কম ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের হৃদযন্ত্রে অস্ত্রোপচার করা যেতে পারে। তবে জটিল শিশু হৃদরোগীদের অস্ত্রোপচারের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল ও শিশু হাসপাতালে দুটি পৃথক ইউনিট খোলা দরকার, যেখানে সারা দেশের জটিল শিশু হৃদরোগীরা সেবা পেতে পারে। তবে প্রতিকারের পাশাপাশি হৃদরোগ প্রতিরোধের ওপরও জোর দিতে হবে। আর এ জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকেও এগিয়ে আসতে হবে।
এমএইচ মিল্লাত
কার্ডিওথোরাসিক সার্জন
ইব্রাহিম কার্ডিয়াক সেন্টার, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ০২, ২০০৯
Leave a Reply