আর কয়েক দিন পরই শুরু হচ্ছে রমজান মাস। যাঁদের সামর্থ্য আছে, তাঁদের রোজা রাখতে ডায়াবেটিস কোনো বাধা নয়। তবে প্রয়োজন পূর্বপ্রস্তুতি। চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে রোজা রাখার প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন। ডায়াবেটিসের রোগীদের রোজা রাখা সহজ ও নিরাপদ। এ প্রতিবেদন ডায়াবেটিক রোগীদের রোজা রাখা নিয়ে।
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বেশির ভাগ ডায়াবেটিক রোগী রোজা রাখেন। ডায়াবেটিসের রোগী, যাঁরা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া রোজা রাখেন, তাঁরা বেশ কিছু জটিলতার সম্মুখীন হতে পারেন। বিশেষ করে রক্তে শর্করা বা চিনির স্বল্পতা (হাইপোগ্লাইসেমিয়া), রক্তে শর্করা বা চিনির আধিক্য (হাইপারগ্লাইসেমিয়া), ডায়াবেটিস কিটোএসিডোসিস ও পানিশূন্যতা। যাঁরা শুধু খাবার ও ব্যায়ামের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখেন, তাঁদের রোজা রাখার ঝুঁকি কম। যাঁরা মেটফরমিন ও গ্লিটাজোনস-জাতীয় ওষুধ গ্রহণ করেন, তাঁদেরও এ সময় ঝুঁকি কম।
তবে যাঁরা সালফোনাইলইউরিয়া ও ইনসুলিন গ্রহণ করেন, তাঁদের ঝুঁকি বেশি। যাঁদের সামর্থ্য আছে, তাঁদের রোজা রাখতে ডায়াবেটিস কোনো বাধা নয়। তবে প্রয়োজন পূর্বপ্রস্তুতি। চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে রোজা রাখার প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন। ডায়াবেটিসের রোগীদের রোজা রাখা সহজ ও নিরাপদ। রোজা রাখা অবস্থায় রক্ত পরীক্ষা করা এবং প্রয়োজন হলে চামড়ার নিচে ইনসুলিন ইনজেকশন নেওয়া যেতে পারে। ধর্মবিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে আমরা জেনেছি, এতে রোজার কোনো ক্ষতি হয় না। সুতরাং এসব নিয়ম মেনে ডায়াবেটিক-রোজাদার রোজা রাখতে পারবেন। ডায়াবেটিসের সঙ্গে অন্য জটিলতা যাঁদের আছে, তাঁদের রোজা রাখা ঠিক নয়। এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া ভালো।
রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে যাওয়া (হাইপোগ্লাইসেমিয়া)
দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকার কারণে দিনের শেষভাগে স্বাস্থ্যের দিকে বেশি নজর দিতে হবে। অতিরিক্ত কাজ করায় রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে যেতে পারে। বড় ধরনের শারীরিক বা কায়িক পরিশ্রম রক্তের গ্লুকোজের বড় একটা অংশ কমিয়ে দেয়। অতিরিক্ত ইনসুলিন অথবা ট্যাবলেট গ্রহণ করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। ইনসুলিন ও সিরিঞ্জ একই মাপের না হলে, বরাদ্দের চেয়ে খাবার খুব কম খেলে বা খাবার খেতে ভুলে গেলে এ অবস্থা হতে পারে।
হাইপোগ্লাইসেমিয়ার লক্ষণ
অসুস্থ বোধ করা। বুক ধড়ফড় করা। শরীর কাঁপতে থাকা। চোখ ঝাপসা হয়ে আসা। অজ্ঞান হয়ে যাওয়া। খিদে বেশি পাওয়া। বেশি ঘাম হওয়া। শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা। অস্বাভাবিক আচরণ করা। খিঁচুনি হওয়া।
হাইপোগ্লাইসেমিয়া হলে কী করতে হবে
রোজাদার ডায়াবেটিক রোগীর এসব লক্ষণ দেখা দিলে অথবা রক্তে সুগারের পরিমাণ ৬০ মিলিগ্রামের (৩·৬ মিলিমোল) নিচে হলে রোজা ভেঙে ফেলতে হবে। পরবর্তী সময়ে কাজা রোজা রাখতে হবে। হাইপোগ্লাইসেমিয়া একটি জরুরি অবস্থা। এ রকম হলে রোগীকে সঙ্গে সঙ্গে চা-চামচের চার থেকে ছয় চামচ গ্লুকোজ বা চিনি এক গ্লাস পানিতে গুলে খাওয়াতে হবে। গ্লুকোজ বা চিনি না থাকলে যেকোনো খাবার সঙ্গে সঙ্গে দিতে হবে। রোগী অজ্ঞান হয়ে গেলে মুখে কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা না করে গ্লুকোজ ইনজেকশন দিতে হবে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
হাইপোগ্লাইসেমিয়া এড়ানোর উপায়
এমন খাবার ও ওষুধ খেতে হবে, যা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রাকে স্বাভাবিক পর্যায়ে রাখবে। খাবার ও ওষুধ খাওয়ায় সমন্বয় সাধন করতে হবে। নিচের নিয়মগুলো মেনে চললে হাইপোগ্লাইসেমিয়া এড়ানো সম্ভব। কঠিন শারীরিক বা কায়িক পরিশ্রমের কাজ বাদ দিতে হবে। কেননা, এটি কোনো রকম আভাস ছাড়াই রক্তে গ্লুকোজের মাত্রাকে অত্যন্ত নি্নমুখী করে দেয়। দেরিতে ইফতার করায়ও এমন অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। বারবার ওষুধের মাত্রার হিসাব সংরক্ষণ করতে হবে, সেটি ইনসুলিন হোক কিংবা ট্যাবলেট। একইভাবে খাবারের পরিমাণেরও হিসাব রাখতে হবে, বিশেষ করে শর্করার পরিমাণ। এরপর এই হিসাব বিশেষজ্ঞ-চিকিৎসককে জানাতে হবে, যেন খাবারের মাধ্যমে রক্তে গ্লুকোজের প্রভাব উচ্চমাত্রা এবং ওষুধের সাহায্যে রক্তে গ্লুকোজের প্রভাব নি্নমাত্রা এই দুইয়ের সমতা রক্ষা হয়।
গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যাওয়া (হাইপারগ্লাইসেমিয়া)
ডায়াবেটিস রোগে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে গেলে অনেক রকম জটিলতা সৃষ্টি হয়। ইনসুলিনের ঘাটতির কারণে কম সময়ে এসিটোন বেড়ে অবস্থা জটিল হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে প্রধান যে অবস্থাগুলো প্রকাশ পায়, সেগুলো হলো মাথা ঘোরা, দুর্বলতা, কখনো কখনো ঝিমুনি, বমি প্রভৃতি।
এ ছাড়া রক্তের গ্লুকোজের কার্যক্রম অনিয়মতান্ত্রিক হয়ে পড়ায় অতিরিক্ত প্রস্রাব, পিপাসা ও পানিশূন্যতা দেখা যায়। এ সময় রক্তচাপ নি্নমুখী হয়, ত্বক শুকিয়ে যায়, প্রস্রাবে গ্লুকোজ বেশি মাত্রায় প্রকাশ পায় এবং সেই সঙ্গে প্রস্রাবে এসিটোন দেখা যায়। এ অবস্থায় যদি দ্রুত চিকিৎসা করানো না হয়, তাহলে কিটোএসিডোসিস হবে এবং রোগী বিপজ্জনক অবস্থায় পৌঁছাবে।
রোজা থাকা অবস্থায় এ রকম হলে রোজা ভেঙে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কিটোএসিডোসিস ছাড়াও যদি রক্তের সুগার বিপজ্জনক অবস্থায় পৌঁছায় (১৬·৭ মিলিমোল/লি· বা ৩০০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার), তাহলে ত্বকের নিচে ইনসুলিন দিয়ে সুগার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এতে রোজার কোনো ক্ষতি হবে না। পরবর্তী সময়ে শুধু ডায়াবেটিসের ওষুধ সমন্বয় করতে হবে।
জরুরি পরামর্শ
— ডায়াবেটিস সম্পর্কে ভালোভাবে জানাকেও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের অন্যতম ব্যবস্থা বলে গণ্য করা হয়। এ জন্য কোন কোন অবস্থায় রোজা রাখা ঝুঁকিপূর্ণ, তা জানতে হবে এবং কী ধরনের জটিলতা দেখা দিলে কীভাবে সমাধান করতে হবে, তা রোগী ও তাঁর পরিবারের সদস্যদেরও রমজানের আগেই শিখতে হবে।
— মনে রাখতে হবে, সবার জন্য একই ব্যবস্থা প্রযোজ্য নয়। প্রত্যেক ডায়াবেটিক রোগীর অবস্থা অনুসারে আলাদা ব্যবস্থা নিতে হবে।
— রোজার সময় রক্তে সুগারের পরিমাণ স্বাভাবিক রাখার জন্য রোগীর কী কী করণীয়, সে সম্পর্কে চিকিৎসক আপনাকে পরামর্শ দেবেন। বিশেষ করে হাইপোগ্লাইসেমিয়া যাতে না হয়, সে জন্য সব সময় সতর্ক থাকতে হবে।
— রোজার সময় চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ডায়াবেটিসের ওষুধ সমন্বয় করবেন না, এতে মারাত্মক পরিণতি হতে পারে।
— রোজার সময় দিনে ও রাতে সুগার মাপা উচিত। ধর্মবিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে জানা গেছে, এতে রোজার কোনো ক্ষতি হয় না।
— সেহরির খাবার সেহরির শেষ সময়ের কিছু আগে খাওয়া উচিত। ইফতারের সময় বেশি চিনিযুক্ত খাবার খাবেন না।
— রোজার সময় দিনের বেলা অতিরিক্ত ব্যায়াম করা উচিত নয়।
— রোজার সময় রাতের বেলা পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উচিত।
মো· ফরিদ উদ্দিন
সহযোগী অধ্যাপক, অ্যান্ডোক্রাইন মেডিসিন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ১৯, ২০০৯
Leave a Reply