বিশ্বজুড়ে মহামারির আশঙ্কা-এমন একটি সতর্কবাণী উচ্চারণ করল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এ বছর ১১ জুন। সংস্থাটি সংকেত দিল ইনফ্লুয়েঞ্জা-এ (এইচ১এন১) বিশ্বজুড়ে মহামারি হয়ে আসছেঃ সতর্কতার মান ৬-এ উন্নীত করা হলো। এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে নতুন এইচ১এন১ ভাইরাসের বিস্তারের ব্যাপকতা প্রতিফলিত হলো, ভাইরাসে রোগ গুরুতর কতখানি হলো, তা বিচার্য বিষয় ছিল না। ইতিমধ্যে ৭০টিরও বেশি দেশে ইনফ্লুয়েঞ্জাএ (এইচ১এন১) সংক্রমণের কথা শোনা গেছে, আর বিশ্বের নানা অংশে এইচ১এন১ সংক্রমণ জনগোষ্ঠীতে প্রাদুর্ভাবের কথাও জানা গেছে।
বিশ্বব্যাপী মহামারি হিসেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ঘোষণার পর থেকে নতুন এইচ১এন১ ভাইরাস ক্রমেই আরও বিস্তার লাভ করতে থাকল।
এই ভাইরাস সংক্রমণের প্রতিবেদন পাওয়া গেল আরও অনেক দেশে, বর্তমানে প্রায় দ্বিগুণ। দক্ষিণ গোলার্ধে ফ্লুর প্রাদুর্ভাব যে ঋতুতে হয়, তাও এগিয়ে এল। আর জানা গেল নিয়মিত ফ্লুর সংক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে নতুন ইনফ্লুয়েঞ্জার সংক্রমণের কথাও। যুক্তরাষ্ট্রে এই এইচ১এন১ ভাইরাস সংক্রমণ গ্রী্নেও বেড়েছে। বড় রকমের প্রাদুর্ভাবও হচ্ছে।
এই ভাইরাস যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ ঘটেছে। তবে বেশির ভাগ অসুস্থ মানুষ চিকিৎসা ছাড়াই ভালো হয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের (সিডিসি) ধারণা, রোগ আরও বাড়বে এবং যুক্তরাষ্ট্রে আরও মৃত্যু ঘটবে গ্রী্ন পেরিয়ে শীতকাল পর্যন্ত। নতুন এইচ১এন১ ভাইরাস, সেই সঙ্গে নিয়মিত ফ্লু, দুটি মিলে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হবে। ইনফ্লুয়েঞ্জা এইচ১এন১ ভাইরাস হলো শূকরের উৎস থেকে আসা একটি নতুন ফ্লু ভাইরাস। এই ভাইরাস সংক্রমণ প্রথম ঘটেছিল মেক্সিকো ও যুক্তরাষ্ট্রে, ২০০৯ সালের মার্চ ও এপ্রিলে।
ধারণা করা হয়েছিল যে নতুন ইনফ্লুয়েঞ্জা-এ ভাইরাস ছড়ায় নিয়মিত ফ্লুর সংক্রমণের মতোই, মূলত ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের কফ ও হাঁচির মাধ্যমে। তবে সংক্রমিত বস্তু স্পর্শ করে হাত, নাক ও মুখে লাগালেও তা সংক্রমিত হতে পারে। নতুন এইচ১এন১ সংক্রমণ নানা রকমের উপসর্গ ঘটাতে পারে ফ্লু জ্বরের, যেমন-জ্বর, কফ, গলা খুসখুস, শরীরে ব্যথা, মাথা ধরা, গা শিরশির করা ও ক্লান্তি। অনেকের হয় বমি ভাব, বমি ও তরল মল।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম এইচ১এন১ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী সিডিসির ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় প্রমাণিত হলো এ বছর ১৫ এপ্রিল। দ্বিতীয় রোগী প্রমাণিত হলো এর দুই দিন পর। এতে বোঝা গেল, ভাইরাসটি একজন লোকের কাছ থেকে অন্যের দেহে সংক্রমিত হতে পারে।
নতুন পরিস্থিতিতে সিডিসি নানা রকম নির্দেশিকাও দিল
চিকিৎসকদের জন্যও এল গাইডলাইন। নতুন এইচ১এন১ ভাইরাস রোগী শনাক্ত করা, তাদের পরিচর্যা এবং ভাইরাসরোধী ওষুধ ব্যবহারের জন্য দেওয়া হলো অন্তর্বর্তী বিশেষ নির্দেশিকা। এ ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাবে এসব ওষুধ ব্যবহারের অগ্রাধিকার দেওয়া হলো-ফ্লুতে আক্রান্ত ও হাসপাতালে ভর্তি রোগী, গুরুতর রোগের আশঙ্কা এমন লোক, গর্ভবতী মহিলা, ছোট শিশু এবং ডায়াবেটিস, হাঁপানি, হৃদরোগ ও ফুসফুসের ক্রনিক রোগে আক্রান্ত লোককে।
জনগণের জন্যও এল নির্দেশিকা
ফ্লুজনিত উপসর্গে অসুস্থ হলে কী করা উচিত, সে সম্পর্কে নির্দেশিকা দেওয়া হলো জনগণের জন্য। কীভাবে ঘরে অসুস্থ লোকের পরিচর্যা করা যায়, নতুন ইনফ্লুয়েঞ্জার সংক্রমণ কমানোর জন্য মুখের মাস্ক ও রেসপিরেটর কী করে ব্যবহার করা যায়-এ নিয়েও নির্দেশিকা এল। জীবাণুর বিস্তার রোধে প্রত্যেকেরই প্রতিদিন নেওয়া উচিত প্রতিষেধক ব্যবস্থা, যেমন-বারবার হাত ধুয়ে ফেলা। যারা অসুস্থ তারা গৃহবাসী হয়ে থাকবে। বাইরে বেরোবে না কিছুদিন। আর রোগের আরও বিস্তার যাতে না হয় সে জন্য সুস্থ লোকের সঙ্গে সংস্পর্শ এড়িয়ে চলবে।
ভাইরাস পরীক্ষা করে দেখার জন্য পদ্ধতিও উদ্ভাবিত হয়েছে
এই নতুন এইচ১এন১ ভাইরাস শনাক্ত করার জন্য একটি পিসিআর রোগ-নির্ণয়ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেছে সিডিসি। এটি প্রাপ্তি সাধ্য করা হচ্ছে সব দেশে।
টিকাঃ এ নিয়ে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সিডিসি ও আমেরিকান সরকার। সিডিসি শনাক্ত ও পৃথক করেছে নতুন এইচ১এন১ ভাইরাস। তবে টিকা আবিষ্কার সহজ নয়। এতে সময় লাগবে।
ইনফ্লুয়েঞ্জাঃ নিয়মিত তদারকির মাধ্যমে নতুন এই ভাইরাসের সন্ধান মিলেছে। দেখা যাচ্ছে, অনেক দেশে নতুন ফ্লু বেশি হচ্ছে।
দায়িত্ব ভাগ করে নিতে হবে সবার
— সবাইকে জানতে হবে নতুন এই ফ্লু সম্পর্কে।
— স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা সবাইকে এ সম্পর্কে অবগত করবেন এবং বাড়তি সংবাদ পাওয়ামাত্র সবাইকে জানাবেন।
যে স্থানে এর প্রাদুর্ভাব হয়, সেখানে প্রত্যেকে প্রতিদিন স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য ও নতুন ভাইরাসের বিস্তার রোধ করার জন্য যেসব পদক্ষেপ নেবেনঃ
— কফ, কাশি বা হাঁচি দেওয়ার সময় নিজের নাক-মুখ টিস্যু নিয়ে ঢেকে নিতে হবে। ব্যবহারের পর এই টিস্যু আবর্জনার পাত্রে ফেলে দিতে হবে।
— হাত দুটি বারবার সাবানপানি দিয়ে ধুতে হবে, বিশেষ করে কফ-কাশি বা হাঁচি দেওয়ার পর। অ্যালকোহলভিত্তিক হ্যান্ড ক্লিনার বেশ উপযোগী।
— চোখ, নাক ও মুখ স্পর্শ করা এড়াতে হবে। জীবাণু এভাবে ছড়ায়।
— রোগীদের কাছাকাছি যাওয়া চলবে না।
— ফ্লুর মতো অসুখে আক্রান্ত মনে হলে, লক্ষণ উপসর্গ শুরু হওয়ার পর সাত দিন অথবা লক্ষণ উপসর্গ মুক্ত হওয়ার পর আরও ২৪ ঘণ্টা, সে সময়টি দীর্ঘ, তত দিন ঘরে অবস্থান করতে হবে। এতে অন্যজন সংক্রমিত হওয়া বা ভাইরাসের আরও বিস্তার হওয়া রোধ হবে।
— কোথাও ফ্লুর প্রাদুর্ভাব ঘটলে সে অঞ্চলে জনস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের পরামর্শমতো স্কুল বন্ধ করা, ভিড় এড়ানো এবং সামাজিক সম্মেলন বা মেলামেশা এড়ানোর মতো কাজ করতে হবে।
প্রচণ্ড তাপমাত্রায় জ্বর, জ্বরের সঙ্গে শ্বাসকষ্ট, হাঁচি, কাশি। এ হলো লক্ষণ। হাঁচি-কাশির সময় রুমাল, গামছা, কাপড়, টিস্যু দিয়ে নাক-মুখ ঢাকা, দিনে কয়েকবার সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলা। এমন লক্ষণ হলে বাড়িতে থাকা এবং চিকিৎসাকেন্দ্রে গিয়ে পরামর্শ নেওয়া। তবে জ্বর ছাড়াও এই ফ্লু হওয়ার খবর রয়েছে কিছু দেশের বেশ কিছু রোগীর।
আমাদের দেশে ইনফ্লুয়েঞ্জা-এ এইচ১এন১ ভাইরাসে আক্রান্ত লোক পাওয়া গেছে কয়েকজন, যারা সবাই বিদেশ প্রত্যাগত। এই ভাইরাস সংক্রমণকে সফলভাবে মোকাবিলা করেছে দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তবে এ ব্যাপারে জনসচেতনতা সৃষ্টি, প্রতিরোধব্যবস্থা বজায় রাখা এবং তদারকি ও নজরদারি রাখতে হবে। গত পরশু পর্যন্ত যা খবর তা হলো, দেশে ৩৪ ব্যক্তি এতে আক্রান্ত। তবে এ সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। সরকার সব হাসপাতালে সোয়াইন ফ্লু ইউনিট গঠনের নির্দেশ দিয়েছে। এ রোগ হলে রোগীর নমুনা পরীক্ষা করা যেতে পারে মহাখালী রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআরএ) এবং আর্ন্তজাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রে (আইসিডিডিআরবি)। তবে কেবল সরকার নয়, ফ্লু ঠেকাতে সবাইকে দলমতনির্বিশেষে এগিয়ে আসতে হবে।
লালা ও রক্ত পরীক্ষার জন্য ব্যবস্থা রয়েছে আইইডিসিআরএতে, চিকিৎসার জন্য ওষুধও রয়েছে সেখানে।
বর্তমানে একে এক নম্বর স্বাস্থ্য-সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে সবাইকে নিয়ে সরকার সোয়াইন ফ্লু মোকাবিলার উদ্যোগ নিয়েছে।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরীর কলম থেকে
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস বারডেম হাসপাতাল, সাম্মানিক অধ্যাপক
ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, ঢাকা
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ১৯, ২০০৯
Leave a Reply