রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় রাখা হলো স্বাস্থ্যকর জীবন যাপনের একটি বড় শর্ত। আর শরীর তা করতে সক্ষম না হলে, ডায়াবেটিস হলে যা হয় এবং ক্রমেই যদি সুগার নিয়ন্ত্রণে না থেকে থেকে বেয়ারা হয়ে যায় তখন হয় কতরকমের জটিলতা!
উন্নত বিশ্ব, উন্নয়নশীল বিশ্ব সবখানেই ডায়াবেটিস বাড়ছে মানুষের মধ্যে। আর একটি বিষয় যা লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা হলো অনেকের হচ্ছে ‘প্রাক্-ডায়াবেটিস’। প্রি-ডায়াবেটিস হলে রক্তের সুগার বাড়ে তবে ডায়াবেটিস হিসেবে চিহ্নিত হবার মত ততটা বাড়ে না। আর এক্ষেত্রে প্রতিরোধ করা গেলে ডায়াবেটিস হওয়াকেও অনেকটা ঠেকানো যায়।
পৃথিবী জুড়ে ডায়াবেটিস রোগীদের ৯৫ শতাংশের হচ্ছে টাইপ২ ডায়াবেটিস। এর মূলে রয়েছে দেহের ওজন বৃদ্ধি, স্থূলতা এবং ব্যায়ামের অভাব। বাড়ছে কেন ডায়াবেটিস? কেন বেশি করে তা বাড়ছে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে? কিছু একটা গোলমাল তো হয়েছেই। কেন এই বিষন্ন ছায়া? তবে একে অতিক্রম করা সম্ভব।
যদি থাকে ডায়াবেটিস, যদি রক্তে থাকে সুগারের উঁচুমান, তখন শরীরের ক্ষতিকে খন্ডানো সম্ভব। এ জন্য প্রয়োজন আমাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন ঘটানো। খাওয়ার যে চর্চা, যে অভ্যাস আমাদের পূর্বসূরীদের ছিল, পুরোনো সেসব খাদ্যাভ্যাস আমাদের আবার অনুসরণ করতে হবে। তাহলে ঘটাবে কাঙিক্ষত পরিবর্তন।
প্রক্রিয়াজাত খাদ্য পরিহার করুন। এসব কৃত্রিম, প্রক্রিয়াজাত খাবার আপাত: স্বাস্থ্যকর হলেও তা বর্জন করতে হবে। এই হচ্ছে মূলনীতি। সবার জন্য এটি প্রযোজ্য। খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প-খাদ্যকে সংরক্ষণ করা, সঠিক বুননে আনা, ইমালসিফাই করা, কোমল করা, সুবাসিত করা বা সুস্থির করার জন্য ৬ হাজারের মত রাসায়নিক ব্যবহার করে। এরপর সেসব খাদ্য হয় প্যাকেটজাত অথবা মাইক্রোওয়েভে সেসব খাদ্য পায় আশ্রয়। অনাবশ্যক এসব রাসায়নিক খাদ্যে যোগ করা হয় খাদ্যকে সুদৃশ্য, সুবাসিত ও মনোলোভা করার জন্য। কিন্তু এতে আদতে খাদ্যের ক্ষতি করা হয়।
কেন প্রক্রিয়াজাত খাদ্য পরিহার করবেন?
০ খাদ্যের এমন পরিবর্তনে হারিয়ে যায় প্রয়োজনীয় খনিজ ও ভিটামিন। শরীরের জন্য যা অত প্রয়োজন। ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তের অম্লধর্মী হবার প্রবণতা থাকে যে জন্য খনিজ ঘাটতি হয়ে উঠে গুরুতর।
০ ডায়াবেটিসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে, ভিটামিন ও খনিজ খাদ্যে প্রচুর পরিমাণে থাকা প্রয়োজন। আর খাদ্য প্রক্রিয়াজাত হলে এসব পুষ্টি উপকরণ বিনষ্ট হয় নয়ত অনেকটা হ্রাস পায়।
০ যে খাদ্য আমরা গ্রহণ করি তা অন্ত্রের ভেতর বিচূর্ণ হতে হয় এবং যকৃতের মধ্য দিয়ে পরিশ্রুত হতে হয়। প্রক্রিয়াজাত খাবার খেলে যকৃতের উপর পড়ে বিশেষ বাড়তি চাপ, নির্বিষ করার এই বাড়তি চাপে যকৃত হয় পরিশ্রান্ত, অবসন্ন এবং শক্তিহীন। এক সময়, নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারে এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটি। পরিপাকের সব কাজে এই যন্ত্রকে কতই না শ্রম করতে হয়, আর রক্তের সুগার মান নিয়ন্ত্রণে এর ভূমিকা সর্বজন স্বীকৃত।
ডায়াবেটিস রোগীদের যকৃতের রোগ হবার ঝুঁকি থাকে আর সেজন্য প্রক্রিয়াজাত খাবার বর্জন করে যকৃতকে সুরক্ষা দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে পরিশোধিত, ব্লিচ করা এবং গন্ধ নাশকরা চর্বি ও তেল বর্জন করা খুবই প্রয়োজন।
০ প্রক্রিয়াজাত খাবার বিনষ্ট করে দেহের অন্তর্গত বাস্তুসংস্থান বা ইকোসিস্টেমকে। বিশেষ করে পাচকনদের ভেতরে দেহবান্ধব মাইক্রোফ্লোরা অর্থাৎ বন্ধুভাবাপন্ন ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক আমাদের শরীরের শক্তিশালী দেহপ্রতিরোধ ব্যবস্থা বজায় রাখার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। রক্তের সুগারের মান ঠিক রাখার জন্য এটি প্রয়োজন, আর যকৃতকে সাহায্য করে যাতে এই যন্ত্রকে বাড়তি বিষদূষণকে মোকাবেলা না করতে হয়। সবার জন্যই চাই সজীব, প্রাণবন্ত ইকোসিসটেম আর ডায়াবেটিসকে ঠেকাবার জন্য এর প্রয়োজন আরও বেশি।
০ ডায়াবেটিস যদি থাকে তাহলে ক্যানডিডা বা জীবাণুছত্রাক সংক্রমন থাকা খুব স্বাভাবিক যা প্রক্রিয়াজাতক খাবারের শর্করা বা বকস্রোতের সুগারের উপর দ্রুত বাড়তে থাকে। ক্যানডিডা সংক্রমণ হলে হতে পারে ওজন বৃদ্ধি, অম্লধর্মী রক্ত, খনিজ ঘাটতি, পাচকনলে সমস্যা এবং দুর্বল রোগ প্রতিরোধ। এ সবগুলোই বাড়ায় ডায়াবেটিসের ঝুঁকি।
০ গোটা শস্য বা Whole Grain বা জটিল শর্করা দেখে প্রতারিত হতে হয় অনেক সময়। আঁশ এর উৎস হওয়াতে ডায়াবেটিসের জন্য উপকারী তবে প্রক্রিয়াজাত হলে অনেকটাই গুণ কমে যায়।
০ কৃত্রিম মিস্টক বা artificial sweetener চিনির স্বাস্থ্যকর বিকল্প নয়। সব কৃত্রিম মিষ্টক ভাল নয়, ঝুঁকি আছে একে গ্রহণ করলে। ডায়াবেটিক হলে একে নির্বিবাদে গ্রহণ করা উপকারী না হতে পারে, এতে রক্ত অম্লধর্মী হতে পারে, দেহ প্রতিরোধ দুর্বল হয়ে পড়তে পারে, ওজন বাড়তে পারে- রক্ত সুগার সুমিত রাখা এজন্য কঠিন হতে পারে। তবে কিছুটা নিরাপদ কৃত্রিম মিষ্টকও আছে। এক্ষেত্রে স্টেভিয়া বা লাকানতোর নাম করা যায়। জাপানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ- লাকানতো।
০ গ্রহণ করতে হবে : স্বাস্থ্যকর চর্বি বা তেল। যেমন জলপাই তেল, মাছের তেল। আছে ভিটামিন, খনিজ এবং অত্যাবশ্যকীয় মেদঅম্ল।
স্যালাড ড্রেসিং এর জন্য একটি স্বাস্থ্যকর অপরিশোধিত তেল বেছে নেবেন, কেন নয় জলপাই তেল আর সেসঙ্গে যোগ করবেন এপল সিডার ভিনেগার। ডায়াবেটিস চিকিৎসায়, রক্ত সুগার নিয়ন্ত্রণে ভিনেগার উত্তম ওষুধ।
আবিষ্কার করুন ফারমেন্টেড খাদ্য ও পানীয়
আমাদের পূর্বপুরুষরা নিয়মিত খেতেন ফারমেন্টেড খাদ্য ও পানীয়। তারা খাদ্য সংরক্ষণে ফার্মেন্টেশন ব্যবহার করতেন আর কিছু কিছু শস্য প্রাক-পরিপাক করিয়ে নিতেন। ডায়াবেটিস যদি থাকে তাহলে ফার্মেন্টেড খাদ্য ও পানীয় গ্রহণে হয় উপকার। যেমন অংকুরিত ছোলা, টক দইঃ। এতে হজম হয় ভাল, দেহের অন্তর্গত ইকোসিসটেম ঠিক থাকে, খাবারে লোভ ও অতি আগ্রহ কমে, ওজন হ্রাস হয়, উজ্জীবিত হয় দেহ প্রতিরোধ ব্যবস্থা। দেহের ইকোলজি বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য- ‘Go back to nature’ ।
অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক ল্যাবরেটরী সার্ভিসেস, বারডেম, ঢাকা
সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক, আগস্ট , ২০০৯
Leave a Reply