মৃগীরোগ নিয়ে ভুল ধারণা
বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নয়নশীল, এমনকি উন্নত দেশেও একসময় মৃগীরোগ বা এপিলেপসি সম্পর্কে ভুল ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধারণা ছিল। এ ধরনের ভ্রান্ত ধারণা মৃগীরোগে আক্রান্ত ব্যক্তি চিকিৎসা ও সেবায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
ভ্রান্ত ধারণা ও নেতিবাচক চিন্তা ব্যক্তি, তাদের পরিবার ও সমাজে এখনো কম-বেশি রয়েছে। এ কারণেই অনেক ব্যক্তিরই রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা, লেখাপড়া, পুনর্বাসন ও সামাজিক অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পেতে ব্যাঘাত ঘটায়।
মৃগীরোগে আক্রান্ত অনেক ব্যক্তি চিকিৎসাসেবার বিষয়ে উদাসীন। তারা মনে করে এই রোগ ভালো হয় না। তারা এও মনে করে· মৃগীরোগ হচ্ছে অতীত কর্মের ফল কিংবা ধর্মীয় অনুশাসনের বিষয়। ফলে চিকিৎসার জন্য অনেকেই কবিরাজ, ওঝা অথবা ফকিরের সাহায্য নিতে যায়।
মৃগীরোগ কী
মৃগীরোগ বলতে বারবার হওয়া খিঁচুনির প্রবণতাকেই বোঝায়। এটি মস্তিষ্কের একটি রোগ, যা মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক তরঙ্গের সাময়িক ব্যাহত অবস্থার (শট সার্কিটের মতো) কারণে হয়ে থাকে।
মস্তিষ্ক আমাদের শরীরে বিভিন্ন ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক, সংক্ষিপ্ত ও সাময়িক অতিরিক্ত বৈদ্যুতিক তরঙ্গের জন্য খিঁচুনি হয়ে দেহের নিশ্চলাবস্থা হতে পারে, যার ফলে অনেকে পড়েও যেতে পারে।
কী কী কারণে হয়?
অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো কারণ ছাড়াই খিঁচুনি হতে পারে। একে বলে ইডিওপ্যাথিক এপিলেপসি। অন্যান্য ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের ক্ষতির মাধ্যমে হয়ে থাকে, যাকে বলে সিম্পটোমেটিক এপিলেপসি। যেমন-
* মাথায় আঘাত পাওয়ার কারণে।
* মস্তিষ্কে বা তার ঝিল্লিতে প্রদাহের কারণে।
* স্ট্রোক বা পক্ষাঘাত হলে।
* বিপাকীয় সমস্যার জন্য।
* ব্রেইন টিউমারের কারণে।
রোগ নির্ণয়
* একটি নির্দিষ্ট পরীক্ষায় এ রোগ নির্ণয় করা যায় না।
* কোনো ব্যক্তি মৃগীরোগী কি না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সবচেয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হলো রোগীর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বর্ণনা।
হাসপাতালে যে পরীক্ষাগুলো করা হয়
রক্তের বিভিন্ন পরীক্ষা।
ইইজি বা ইলেকট্রো এনসেপালোগ্রাম।
সিটি (কম্পিউটার টমোগ্রাফি) স্ক্যান।
এমআরআই (ম্যাগনেটিক রেজন্যান্স ইমেজিং) স্ক্যান।
খিঁচুনির শুরু
কিছু কিছু জিনিস বা বিষয় খিচুনির সূত্রপাত ঘটাতে পারে। যেমনঃ
* মানসিক চাপ।
* ক্লান্তি।
* ঘুমের সমস্যা।
* অতিরিক্ত মদ্যপান।
* খাবার গ্রহণে ব্যাঘাত।
* ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ওষুধ না খাওয়া।
* আলোর ঝলক বা কম্পমান আলো (সামান্য কিছু ক্ষেত্রে)।
চিকিৎসা
সঠিক ওষুধ ব্যবহারই হচ্ছে এপিলেপসি চিকিৎসার প্রধান উপায়।
প্রতিদিন সঠিক মাত্রায় সঠিক ওষুধ নির্দিষ্ট সময়ে গ্রহণের পর অধিকাংশ ব্যক্তি খিঁচুনিমুক্ত থাকে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করা হয়ে থাকে। অ্যারোমাথেরাপির মতো সম্পূরক চিকিৎসাও সহায়ক হয়ে থাকে। এ রোগের মৌলিক প্রাথমিক চিকিৎসা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা খুব দরকার। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির ঝঁুকি অনেকাংশেই কমানো সম্ভব।
কিছু ভুল ধারণা
ধারণাঃ এপিলেপসি মানসিক রোগ।
সত্যঃ এর সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্য ও বুদ্ধিমত্তার কোনো সম্পর্ক নেই। মৃগীরোগ অন্যান্য রোগের মতোই মস্তিষ্ক বা ব্রেইনের অসুখ।
ধারণাঃ মৃগীরোগ ছোঁয়াচে।
সত্যঃ খিঁচুনি আছে এ রকম ব্যক্তির কাছ থেকে খিঁচুনি হয় না।
ধারণাঃ চামড়া অথবা জুতা শুঁকলে খিঁচুনি বন্ধ হতে পারে।
সত্যঃ এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
ধারণাঃ মুখে চামচ বা অন্য কিছু ঢুকিয়ে দিলে খিঁচুনি আক্রান্ত ব্যক্তির জিহ্বা কাটা অথবা গিলে ফেলা রোধ ধরা যায়।
সত্যঃ আসলে খিঁচুনির সময় জিহ্বা গিলে খাওয়ার কোনো আশঙ্কাই নেই। কোনো কিছু প্রবেশ করানোর ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির দাঁত ভেঙে যেতে পারে, মাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। মুখে বাতাস প্রবাহ কমে যেতে পারে।
ধারণাঃ মৃগীরোগে আক্রান্ত ব্যক্তি দেখতে আলাদা।
সত্যঃ এটা হাস্যকর ধরনের ভুল ধারণা।
ধারণাঃ আক্রান্ত ব্যক্তির যেকোনো সময় খিঁচুনি হতে পারে।
সত্যঃ এটি বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। প্রতিটি মানুষই আলাদা। অনেকেই কোনো খিঁচুনি ছাড়াই বছরের পর বছর পার করে; আবার অনেকেরই তা ঘন ঘন প্রকাশ পেতে পারে।
ধারণাঃ ধরে বা চেপে রাখলে খিঁচুনি বন্ধ করা যায়।
সত্যঃ খিঁচুনির সময় কখনোই রোগীকে ধরে রাখবেন না। এতে তারা আঘাত পেতে পারে। তাদের শক্ত জায়গায় অথবা ধারালো বস্তু থেকে সরিয়ে দিন।
শেষ কথা
মৃগীরোগে আক্রান্ত অধিকাংশ ব্যক্তি অন্য কোনো লোকের মতো যেকোনো কার্যক্রমে অংশ নিতে পারে। এর জন্য প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বনই যথেষ্ট। আর এ জন্য শুধু প্রয়োজন জনসচেতনতা, কুসংস্কার ঝেড়ে ফেলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া।
আমরা এমন একটি সমাজে বাস করতে চাই, যেখানে সবাই এপিলেপসি বা মৃগীরোগটিকে বোঝে এবং যেখানে এপিলেপসি আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ভুল ধারণার ওপর নির্ভরশীল না হয়ে সত্যের ওপর নির্ভরশীল হবে।
লেখকঃ ডা· এ কে এম আনোয়ার উল্লাহ
দৈনিক প্রথম আলো, ২৬ ডিসেম্বর ২০০৭
Leave a Reply