ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম দীর্ঘদিন ধরে কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিষয়টি পড়াচ্ছেন। তিনি আপনার মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন। আপনার সঠিক পরিচয় না দিতে চাইলে অন্য কোনো নাম ব্যবহার করুন।—বি.স.
সমস্যা: আমি একটি ছেলেকে ভালোবাসতাম। ২০০৪ সাল পর্যন্ত আমাদের সম্পর্ক ঠিকমতো চলছিল। কিন্তু ২০০৪ সালে সে এইচএসসি পাস করে। আমি তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। ২০০৫ সালের জানুয়ারি মাসে সে আমাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে। তখন আমার পরিবারের কেউ তাঁর প্রস্তাব মেনে নিতে পারেনি। শেষে,আমি আমার পরিবারের লোকজনকে স্বাভাবিকভাবে রাজি করাই। মা-বাবার শর্ত ছিল, ছেলে পছন্দ হলে আমরা বিয়ে দিতে রাজি আছি। এদিকে ছেলের বাড়িতে গিয়ে বাবা জানতে পারেন, তাঁর হাঁপানি রোগ আছে। তখন আমার পরিবার বিয়ে দিতে রাজি হয়নি। এরপর
সে অন্য একটি মেয়েকে বিয়ে করে। কিন্তু এখনো আমি ওকে ভুলতে পারছি না। আমার স্বামীর ব্যবহারও মানতে পারছি না।
শেলিনা
পরামর্শ: ওই ছেলেটি যদি ২০০৫ সালে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসে থাকে, তাহলে তো তোমার তখনো বিয়ের বয়স হয়নি। বোঝা যাচ্ছে, দুজনই তোমরা তখন অপরিণত বয়সে ছিলে, আর এ কারণেই মনের ইচ্ছাটি খুব জোর দিয়ে পরিবারে প্রতিষ্ঠিত করতে পারোনি। তোমার চিঠি পড়ে মনে হচ্ছে, তুমি এরপর খুব অল্প বয়সেই বিয়ে করেছ। তার অর্থ কি এই দাঁড়াচ্ছে যে তুমি এরপর আর লেখাপড়া করোনি? আমি তোমাকে অনুরোধ করব, তুমি অন্তত নিজেকে আরও শিক্ষিত করে তোলো। বিয়ে যেহেতু জীবনের একটি বড় সিদ্ধান্ত, তাই বিয়ে করার আগে এবং তা ভাঙার আগে আমাদের আবেগের চেয়ে যুক্তিকে বেশি প্রাধান্য দিতে হবে। বর্তমানে তুমি এবং ওই ছেলেটি—দুজনই এখন বিবাহিত, তবে তোমাদের কোনো সন্তান আছে কি না তা জানাওনি। যদি সন্তান থাকে, তাহলে তোমার অতীতের কার্যক্রম এবং বর্তমানের আবেগের কারণে তাকে ভোগান্তিতে ফেলে দেওয়ার অধিকার তোমাদের কারও নেই। তোমার এই আবেগ কিন্তু দুটি পরিবারকেই বিপর্যস্ত করে দেবে। তোমাকেই সবকিছুর দায়িত্ব নিতে হবে। এখন স্বামীর দুর্ব্যবহার এবং আগের প্রেমিকের প্রতি ভালোবাসাকে আলাদা জায়গায় রেখে তোমাকে বিচার-বিবেচনা করতে হবে। যদি মনে হয় স্বামীর সঙ্গে তুমি থাকতে পারবে না, তাহলে তোমাকে সেভাবেই উদ্যোগ নিতে হবে। যদি সারাক্ষণ মনে হয় ওই ছেলেকে ছাড়া তুমি বাঁচবে না, তাহলে ধরে নিতে হবে, স্বামীর সঙ্গে তুমি প্রতারণা করছ। বিয়ের শর্তগুলো মেনে চলার জন্য আমাদের নৈতিক মূল্যবোধগুলো চর্চা করা খুব প্রয়োজন। যদি বর্তমান স্বামীর সংসারে তুমি থেকে যাও তাহলে তোমাকে অবশ্যই নৈতিক মূল্যবোধগুলো সব সময় মাথায় রাখতে হবে।
সমস্যা: আমার বয়স ১৫ বছর। একটি মেয়েকে খুব ভালোবাসি। সেও আমাকে ভালোবাসে। আমাদের মধ্যে সম্পর্ক ছয় মাসের। কিন্তু সে আমাকে কয়েক দিন থেকে এড়িয়ে চলছে। আমি যত তাকে দেখতে চাই, সে ততই আমাকে এড়িয়ে চলে। সে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে। এবার যখন সে ঢাকা থেকে কুমিল্লায় চলে যায়, তার পর থেকে সে অন্য মানুষ হয়ে গেছে। আমাকে সে দেখতেই পারে না। কিন্তু কয়েক মাস আগে সে আমাকে বলে, আমাকে সে এক দিন না দেখলে থাকতে পারবে না। আর সে এখন আমাকে দেখতে পারে না। আমি তাকে বলি, তোমাকে ছাড়া আমি কাউকে বিয়ে করব না। আমি এখন সারাক্ষণ কাঁদি। সারাক্ষণ রাগে-দুঃখে নিজেই নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করি।
সাকিব
পরামর্শ: এত ছোট বয়সে তুমি তোমার চেয়েও ছোট একটি মেয়ের প্রতি অনুরক্ত হয়েছ, আর তাই কষ্টও পেয়েছ খুব বেশি। বয়ঃসন্ধিতে এমনটি হয়েই থাকে। এই সময়ে আমাদের আবেগগুলো এত বেশি কাজ করে যে আমরা প্রায় দিশেহারা হয়ে যাই। আরেকটি কথা, কাউকে কি নিজের জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসা সম্ভব? তোমার কিন্তু সবচেয়ে প্রথমে নিজেকে ভালোবাসতে হবে। মেয়েটি যে বলেছিল, তোমাকে দেখতে না পেলে সে এক দিনও থাকতে পারে না, সেই কথাটা কিন্তু সত্য প্রমাণিত হয়নি। মানুষের মন পরিবর্তন হতেই পারে এবং এই বয়সে পরিবর্তনটা খুব দ্রুতই ঘটতে থাকে। আর যেহেতু এই বয়সে আবেগের প্রচণ্ডতা খুব বেশি থাকে, সে কারণেই সিদ্ধান্তগুলো যুক্তিনির্ভর হয় না। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তুমি প্রতিষ্ঠিত হয়ে কাকে বিয়ে করবে, সে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা বাস্তবসম্মত নয়। তুমি নিজেও অবাক হয়ে যাবে, যখন ভবিষ্যতে তোমার মনের পরিবর্তনগুলো লক্ষ করবে। মেয়েটির মতামতকে শ্রদ্ধা করতে চেষ্টা করো। কারণ, নিজের মতামত প্রকাশের অধিকার প্রত্যেকেরই আছে। তুমি যে নিজেকে আঘাত করছ, সেটা তোমার বাড়ির কেউ কি লক্ষ করছেন না? পরিবারে তুমি যার সঙ্গে বেশি অন্তরঙ্গ হতে পারো, তার কাছে তোমার মানসিক অবস্থাটি প্রকাশ কর। পরিবার থেকে যথেষ্ট মানসিক সহায়তা পেলে এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা অনেক সহজ হয়। তুমি নিজেকে এভাবে আঘাত করে নিজের প্রতি অবিচার করবে না। তোমার জীবনের অনেক মূল্য আছে এবং তুমি একদিন নিজেকে সুন্দরভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে—এই বিশ্বাসটি মাথায় নিয়ে চলো, কেমন?
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ২৪, ২০১০
Leave a Reply