পারস্পরিক সম্পর্কের বাঁধন ছাড়া মানুষ কখনোই আধুনিক সভ্যতার এই স্তরে পৌঁছাতে পারত না। বর্তমানে হয়তো প্রস্তরযুগের মতো খাবার খুঁজতে বের হওয়ার জন্য বা হিংস্র শ্বাপদের আক্রমণ থেকে জীবন রক্ষা করতে একত্র হওয়ার প্রয়োজন তেমন পড়ে না, কিন্তু এ যুগেও সুস্থ, সুখী, দীর্ঘ জীবনের জন্য বন্ধুত্বের ভূমিকা অপরিসীম। অভিজ্ঞতা থেকে যেমন আমরা তা বুঝতে পারি, তেমনি বিজ্ঞানসম্মত গবেষণার মাধ্যমেও এই ভূমিকা প্রতিষ্ঠিত।
হৃদ্যন্ত্রের সুস্থতার ওপর বন্ধুত্বের প্রভাব রয়েছে। সুইডেনের একদল গবেষক ১৩ হাজার ৬০০ জনের ওপর তিন বছর গবেষণা চালিয়ে দেখতে পান, যাদের বন্ধুবান্ধব কম বা নেই, তাদের ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ৫০ শতাংশ বেশি। নিউইয়র্কের গবেষকেরাও এ বছর প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে জানিয়েছেন, বন্ধুহীন ব্যক্তিরা হৃদরোগ, উদ্বেগজনিত রোগ ও বিষণ্নতায় বেশি ভোগে। বন্ধুত্ব কীভাবে হৃদ্যন্ত্র বা আমাদের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করতে পারে? উত্তরে ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জার্নাল অব দ্য ন্যাশনাল মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন-এ বলা হয়েছে, ভালো বন্ধুত্ব মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। এই মানসিক চাপের সঙ্গে সম্পর্ক আছে হৃদরোগের। মানসিক চাপের ফলে রক্তনালির ভেতর প্রদাহের ঝুঁকি বাড়ে, যা পরবর্তী সময়ে রক্তের স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত করতে পারে; নালির ভেতর রক্ত জমে রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে।
হামবোল্ট স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী তাশা আর হাউই বলেন, মানুষের ক্রমবিকাশের ধারা বা অভিব্যক্তিবাদেই রয়েছে এর উত্তর। মানুষ সামাজিক জীব। তাদের জন্মই হয়েছে সমাজবদ্ধ হিসেবে বাস করার জন্য। আর তাই সামাজিক বন্ধন দৃঢ়, এমন ব্যক্তিরা অন্যদের চেয়ে বেশি মানসিক প্রশান্তি অনুভব করে, যা সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজন। ফলে তাদের হৃদরোগ কম হয়, রোগ-প্রতিরোধক্ষমতা বেশি থাকে এবং চাপসঞ্চারী হরমোন কর্টিসোলের পরিমাণ দেহে কম থাকে। পিটসবার্গের কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শেলডন কোহেন বলেন, জীবনের কষ্টকর সময়গুলো মোকাবিলা করতে বন্ধু সহায়তা করে।
তারা চাপ মোকাবিলার জন্য মানসিক অবলম্বন হিসেবে দুঃসময়ে পাশে থাকে। যাদের সামাজিক যোগাযোগ বেশি, তারা অধিকতর আত্মবিশ্বাসী হয় এবং জীবন ও পরিবেশের ওপর নিজেদের পর্যাপ্ত নিয়ন্ত্রণ অনুভব করে। বন্ধুত্ব স্বাস্থ্যকর জীবনাচরণকেও উৎসাহিত করে। একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, সুখ সংক্রামক।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষকেরা বলেছেন, সুখ ব্যাপারটি সংক্রামক ভাইরাসের মতোই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে একজনের কাছ থেকে অন্যজনে ছড়ায়। সুতরাং আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু যদি সুখী হয়, সে ক্ষেত্রে আপনারও সুখী হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। অপরদিকে সমাজবিচ্ছিন্ন, বান্ধবহীন জীবন একই সঙ্গে অসুস্থ ও অসুখীও। বয়সী একাকী ব্যক্তিরা উচ্চ রক্তচাপ ও নিদ্রাহীনতায় বেশি ভোগেন। অস্থিরতা ও উদ্বেগে আক্রান্ত হন। তাঁদের দেহে স্ট্রেস হরমোনের পরিমাণ বেশি থাকে। রোগ-প্রতিরোধক্ষমতা থাকে কম।
হার্ট অ্যাটাকের পর দ্রুত মৃত্যুর ঝুঁকি তাঁদের ক্ষেত্রে বেশি। শিকাগোর রাশ ইউনিভার্সিটি মেডিকেল সেন্টারের গবেষকেরা দেখেছেন, একাকিত্বে ভোগা ব্যক্তিদের ্নৃতিভ্রংশ রোগ ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি দ্বিগুণ। ২০০৬ সালে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত তিন হাজার সেবিকার ওপর পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, ঘনিষ্ঠ বন্ধুহীন রোগীদের ক্যান্সারে মারা যাওয়ার ঝুঁকি, যাদের দশের অধিক বন্ধু আছে তাদের চেয়ে চার গুণ বেশি। একইভাবে, জরায়ুর ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের ওপর চালানো অন্য গবেষণায় প্রায় একই ধরনের ফল পাওয়া গেছে। বন্ধুত্বের যেসব উপকারিতার কথা বলা হচ্ছে, অবশ্যই মনে রাখতে হবে, সেগুলো ভালো বন্ধুত্বের ফল।
বিপথগামী বন্ধুরা অবশ্যই আপনার স্বাস্থ্যের জন্যও বড় হুমকি। যারা অনিয়ন্ত্রিত ও অসুস্থ জীবনাচরণে অভ্যস্ত, তারা আপনাকেও স্বাস্থ্যঝুঁকিপূর্ণ জীবন যাপনের পথে নিয়ে যেতে পারে। আপনি হয়ে পড়তে পারেন ধূমপায়ী, মাদকাসক্ত, শারীরিক বা মানসিকভাবে অসুস্থ। তাই সুস্থ, দীর্ঘ জীবনের জন্য খুঁজে নিন প্রাণবন্ত, সুখী, পরোপকারী, বিশ্বস্ত, ভালো বন্ধু; গড়ে তুলুন নির্মল বন্ধুত্ব।
মুনতাসীর মারুফ
চিকিৎসা কর্মকর্তা
মাদারগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জামালপুর
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ১২, ২০০৯
Leave a Reply