সুপার-পোষক সমূহ বর্তমানে মেডিক্যাল আর বৈজ্ঞানিক রিসার্চের মনোযোগ আকৃষ্ট করেছে। এগুলো হচ্ছে ভিটামিন-এ, ভিটামিন-সি আর ভিটামিন-ই-র অগ্রদূত। এই সব পোষক এক সাথে মিলে এমন শক্তিশালী জোট তৈরী করে, যেটা শরীরকে বেশ কিছু রোগের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে আর বয়স বাড়ার ক্রিয়াকেও কম করতে পারে।
এই সব ভিটামিন বেশ কয়েক ধরনের খাদ্য পদার্থে পাওয়া যায় আর প্রাকৃতিক রূপে ফল আর সব্জীর মধ্যে পাওয়া যায়, যেগুলো আমরা বেশী পরিমাণে খেতে পারিঃ বিশেষ করে যখন সেগুলোর মরশুম থাকে। অন্য দিকে ওষুধ খেলে তার সাইড এফেক্টস হতে পারে আর প্রাকৃতিক পোষকগুলোর সঙ্গে এর কোন মিলই নেই। আসলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংগঠন আর অন্য খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রাণালয়গুলোর সমর্থনে এই দিকে যথেষ্ট অনুসন্ধান চালানো হয়েছে।
বিটা-ক্যারোটিন, ভিটামিন-সি আর ভিটামিন-ই-র অদ্ভুত শক্তির ব্যাপারে প্রচুর অধ্যয়ন করা হয়েছে। স্বাধীন ভাবে ভিটামিন-এ ভিটামিন-সি, ভিটামিন-ই সেবন করা ব্যক্তিদের মধ্যে ক্যান্সার, এ্যাঞ্জাইনা আর হৃদয় রোগ কম দেখতে পাওয়া যায় আর তাদের আয়ুও লম্বা হয়।
শরীরকে চালানোর জন্য ভোজন থেকে প্রাপ্ত অক্সিজেনের সঞ্চার হিমোগ্লোবিনের লাল রং-য়ের কণাগুলো দ্বারা হয়, যাতে লৌহ থাকে। রক্ত-প্রবাহে অক্সিজেন কোশিকাগুলোকে জীবিত রাখার জন্য গ্রহণ করা হয়। এই ক্রিয়াকে অক্সিডেশন বলা হয়। যদিও এই অক্সিজেন মুক্ত কণার নির্মাণও করে, যেটা অধিক পরিমাণে হয়ে পড়লে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
মুক্ত কণা অক্সিডেশনের ক্রিয়ার সময় সৃষ্টি হয়। যখন শরীর অক্সিজেনের ব্যবহার করে, তখন সেটা এনার্জি তৈরী করার জন্য ভোজনকে বিঘটিত করে। এটা কীটানু, ওজোন আর কর্বন মোনো-অক্সাইডের মত বিষাক্ত তত্ত্বগুলোকেও নষ্ট করে দেয়। এই প্রক্রিয়ায় মুক্ত কণাও সৃষ্টি হয় এই সব কণা কোশিকাগুলোর ঝিল্লীকে নষ্ট করে দেয় আর ক্রোমোসোন্স এবং জৈবীয় সামগ্রীগুলোর ক্ষতিসাধন করে। এটা মুল্যবান এঞ্জাইমগুলোকেও নষ্ট করে ফেলে, যার কারণে পুরো শরীরে নষ্ট হয়ে পড়ার এক প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে পরে। এই ভাবে মুক্ত কণা করোনারী হৃদয় রোগ, ফসফুসের রোগ, কয়েক ধরনের ক্যান্সার, চোখের ছানি, আর্থারাইটিস, পার্কংসন্স রোগ আর বার্ধক্যের মত কমপক্ষে ৫০ শতাংশ রোগের এক বড় কারণ হয়ে ওঠে।
মুক্ত কণা থেকে হওয়া ক্ষতিকে আমরা দু ভাবে কম করতে পারি। প্রথম, আমাদের এমন তত্ত্ব আর গতিবিধির হাত থেকে বাচতে হবে, যেগুলো মুক্ত কণা সৃষ্টি হতে সহায়তা করে, যেমন-সিগারেট, প্রদুষণ আর সুর্যের আল্ট্রাভায়োলেট কিরণ।
দ্বিতীয়তঃ এটা সুনিশ্চিত করতে হবে যে, আমরা নিজেদের দৈনিক আহারে ভিটামিন-এ, ভিটামিন-সি আর মিটামিন-ই সেবন করে, বেশী মাত্রায় এ্যান্টী-অক্সিডেন্ট গ্রহণ করব।
যদিও ভিটামিন-এ, ভিটামিন-সি আর ভিটামিন-ই মুক্ত কণা থেকে হওয়া ক্ষতির সঙ্গে লড়তে সহায়তা করে, বায়ু প্রদুষনও এই সব গুরুত্বপূর্ণ পোষকগুলোর সাপ্লাইকে কম করে তোলে। অধ্যয়ন থেকে এটা জানতে পারা গেছে যে, শহরে বাস করা ব্যক্তিদের মধ্যে, যারা প্রদুষিত হাওয়ায় শ্বাস নেন, এ্যান্টি-অক্সিডেন্টের স্তর কম থাকে। এর ফলে শরীরে ভিটামিন-এ, ভিটামিন-সি আর ভিটামিন-ই-র আপুর্তি বিপজ্জনক ভাবে কমে আসে। এমনটা হলে এগুলোর জায়গা মুক্ত কনা নিয়ে আর অক্সিডেটিভ চাপয়ের সৃষ্টি হয়ে পড়ে। আমাদের ভোজনে মুক্ত কণা থাকাটা আমাদের পক্ষে বিপজ্জনক হয়। এর মুখ্য উৎস হচ্ছে ফ্যাট (যেমন বেশী তাপমাত্রায় গরম করা রান্না করার তেল) ফ্যাটকে যে মুহুর্তে গরম করা হয়, তার রাসায়নিক রচনা ভেঙে বিপজ্জনক হাইড্রোক্সিল কণা তৈরী করে। কোশিকাগুলোর আর ডিএনএয়ের প্রচণ্ড ক্ষতি করে। (সুর্যমুখীর তেলের মত পোলি-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট বেশী তাপমাত্রায় কম স্থায়ী থাকে। এটা জৈতুনের তেলের মত মোনো-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট-য়ের তুলনায় দ্রুত অক্সিডেটেড হয়ে পড়ে।) মেডিক্যাল সায়েন্স সর্বদা ভিটামিনের লাভের প্রচার করে এসেছে আর বৈজ্ঞানিকেরাও এই জাদু তত্ত্বের সার্থকতা প্রমানিত করার জন্য কঠোর প্ররিশ্রম করেছেন। এ্যান্টী-অক্সিডেন্টসের বিচার সম্বন্ধিত রূপে কিছুটা নতুন।
এ্যান্টী-অক্সিডেন্টস প্যাথোলোজিক্যাল পরিস্থিতি গুলোয় চিকিৎসায় নতুন পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে যেমন :
০ কার্ডিয়োভাস্কুলার রোগ- সিএইচডি, উচ্চ রক্তচাপ।
০ সেরিব্রোভাস্কুলার রোগ।
০ মেটাবোলিজম রোগ-ডায়াবেটিজ মেলিটাস।
০ শিরার রোগ- এল্েজমিট রোগ, মৃগী।
০ বিপোষক রোগ- চোখের ছানি, আর্থারাইটিস, বার্ধ্যক্য।
০ ক্যান্সার।
ভিটামিন-এ
ভিটামিন-এ দু প্রকারের হয়। প্রথম, পশুদের থেকে প্রাপ্ত উৎপাদন, যেমন মাংস আর দুধে পাওয়া যায়। একে রেটিনল বলা হয়; এবং দ্বিতীয় ফল আর সব্জীতে পাওয়া যায়, যাকে- ক্যারেটিন’ বলা হয়। বিটা-ক্যারেটিনই এ্যান্টী- অক্সিডেন্টের রূপে কাজ করে।
শরীরের বিকাশ আর তন্ত্রগুলোকে সুস্থ রাখার জন্য ভিটামিন-‘এ’-র প্রয়োজন হয়। এর অভাব হয়ে পড়লে ত্বক আর চোখ অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে আর সুস্থ হাড় আর ভালো দাঁত তৈরী হতে সমস্যা দেখা দিতে পারে। যদি এর অভাবের চিকিৎসা সময় থাকতে না করানো হয়, তাহলে ব্যক্তি পুরোপুরি অন্ধ ও হয়ে পড়তে পারেন। ভারতে অন্ধত্বের কারণগুলোর মধ্যে সব থেকে সাধারণ কারণ হচ্ছে ভিটামিন- ‘এ’-র অভাব। বিটা- ক্যারোটিন বেশ কিছু ফল আর সব্জীতে পাওয়া যায়, যেমন- পালং শাক, ধনেপাতা, বাঁধাকপি, গাজর, আম, টমাটো ইত্যাদি। শরীরে এই ক্যারোটিন, ভিটামিন- ‘এ’তে পরিবর্তিত হয়ে পড়ে। বিটা- ক্যারোটিন রান্না করলে বা আল্ট্রা-ভায়োলেট কিরণের ফলে নষ্ট হয় না।
একজন বয়স্ক ব্যক্তির প্রতি দিন ৬০০ মিলি গ্রাম রেটিনল বা ২৪ মিলিগ্রাম বিটা-ক্যারোটিন-য়ের প্রয়োজন হয়। বাড়ন্ত বাচ্চা, গর্ভবতী মহিলা আর অসুস্থ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এই প্রয়োজনটা আরও বেশী হয়। ১ মিলিগ্রাম বিটা-ক্যারোটিন= ০.২৫ মিলিগ্রাম রেটিনল।
বিটা-ক্যারোটিন দু ভাবে কাজ করে। প্রথমে এর কিছু অংশ ভিটামিন-এ তে পরিবর্তিত হয় আর অবশিষ্ট বিটা-ক্যারটিন এ্যান্টী-অক্সিডেন্টের রূপে কাজ করে। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, বিটা-ক্যারোটিন আর ভিটামিন-এ-র মধ্যে যেন ভ্রমের সৃষ্টি না হয়ে পড়ে, কারন এই দুটো হচ্ছে আলাদা- আলাদা তত্ত্ব। আমাদের শরীর বিটা-ক্যারোটিনকে ভিটামিন-এ-তে পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়।
যদিও, দীর্ঘ সময় ধরে বেশী পরিমাণে ভিটামিন-এ সেবন করাটা ক্ষতিকারক লক্ষন সৃষ্টি করতে পারে, যেমন- মাথা যন্ত্রণা, গা গোলানো, বমি, আলস্য, শুষ্ক ত্বক, ঠোঁট ফাটা ইত্যাদি।
ভিটামিন-এ-র প্রয়োজন শরীরের বিকাশ আর তার তন্তুগুলোকে সুস্থ রাখার জন্য হয়। এর গুরুত্বপূর্ন ভূমিকাগুলোর মধ্যে একটা হচ্ছে আমাদের কোশিকাগুলোকে স্বরক্ষাত্মক কবচ বা ঝিল্লি প্রদান করা। এটা মিউকাস ঝিল্লি-কেও সুরক্ষিত রাখে। এটা ফ্যাটে গুলো যায়। মাছের লিভারের তেল হচ্ছে ভিটামিন-এ-র সব থেকে ভালো প্রাকৃতিক উৎস।
বিটা-ক্যারোটিন হচ্ছে গাছের মধ্যে পাওয়া এক প্রাকৃতিক পদার্থ আর সবার আগে এটাকে গাজরের মধ্যে খুজে পাওয়া গেছিল.. এজন্য পুরো পরিবারকে ক্যারোটেনয়েডস্ নাম প্রদান করা হয়েছিল। ক্রারোটেনয়েডস্ নাম প্রদান করা হয়েছিল। ক্রারোটেনয়েডস্ বেশ কিছু রঙ্গীন পদার্থ রয়েছে, যেগুলো প্রকৃতিতে দেখতে পাওয়া বেশ কিছু রং-য়ের ভাণ্ডার। বিটা-ক্যারোটিন গাঢ় লাল-কমলা রং-য়ের হয় এবং হলুদ আর কমলা গাঢ় সবুজ রংয়ের সব্জীতেও ক্যারোটিন থাকে, কিন্তু ক্লোরোফিলের কারণে হলুদ আর কমলা রং চাপা পড়ে যায়.. কিন্তু অনেকবার এটা বেশী চাপা পড়তে পারে না .. যেমন লাউতে।
বিটা-ক্যারোটিন হচ্ছে সব থেকে শক্তিশালী এ্যান্টী-অক্সিডেন্টসগুলোর অন্যতম, যেটা গাছকে সূর্যের আল্টা-ভায়োলেট কিরণে পুড়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে। এটা হচ্ছে প্রকৃতির সঠিক রক্ষক। তরমুজ, বেদানা, আডু, আম আর গাজর, আলু, পালং শাক, টমাটো, আজওয়াইন, জলকুম্ভী আর ফুলকপির মত ফল আর সব্জীতে বিটা-ক্যারোটিন থাকে।
ভিটামিন-সি (এস্কোর্বিক এ্যাসিড)
এ্যান্টি- অক্সিডেন্টের রূপে কাজ করা ছাড়াও ভিটামিন-সি-র আরও বেশ কিছু গুণ রয়েছে। এটা শরীরের বিকাশ আর শরীরের তন্তুগুলো, মাড়ি, দাত, রক্তের নাড়ি আর হাড়ে হয়ে পড়া ক্ষতিকে পুরণ করতেও সহায়তা করে। এটা শারীরিক ব্যবস্থায় শামিল থেকে ব্যাক্টেরিয়া আর ভাইরাল সংক্রমণয়ের সঙ্গে লড়তেও সহায়তা করে। ভিটামিন-সি-র অভাবের কারণে হেমারেজ ক্ষতস্থান শুকোতে সময় নেওয়া, স্কার্বি রোগ, মাড়ি থেকে রক্ত পড়া, হাড়ের ধীর গতিতে নির্মান ইত্যাদি লক্ষন দেখতে পাওয়া যায়। ভিটামিন-সি আমলাতে পাওয়া যায়। ভিটামিন-সি-র ভালো উৎস হচ্ছে রসযুক্ত ফল, যেমন- পাতি লেবু, মুসম্বী লেবু, কমলা লেবু, পেয়ারা আর সবুজ পাতাওয়ালা সব্জী, যেমন- পালং শাক ইত্যাদি। কাটা আর রান্না একে নষ্ট করে দেয়। একজন বয়স্ক ব্যক্তির জন্য প্রতিদিন এর প্রয়োজন হচ্ছে ৪০ মিলিগ্রাম। এটা শরীরে জমা হয়ে থাকে না অতিরিক্ত মাত্রা প্রস্রাবের সঙ্গে শরীর থেকে বাইরে বেরিয়ে যায়।
ভিটামিন-ই
ভিটামিন-ই-ও এ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে আর ঝিল্লীর ওপরে জমা হয়ঃ যার কারণে সেটাকে প্যারক্সাইডসয়ের ক্রিয়া থেকে রক্ষা করে। বাঁচায় আর অক্সিজেনের বিষাক্ত প্রভাবকেও আটকায়.. এই প্রকার এটা অক্সিজের মুক্ত কাণাগুলোকে মজবুত করে তুলে শরীরের রোগগুলোর সঙ্গে লড়ার শক্তি প্রদান করে আর হৃদয় রোগ থেকেও সুরক্ষা প্রদান করে।
ভিটামিন-ই গম, অঙ্কুরিত আনাজ, গোটা আনাজ, স্যালাড ইত্যাদিতে পাওয়া যায়। এছাড়া আরও কিছু তত্ত্বও আমাদের শরীরে এ্যান্টি-অক্সিডেন্টের কাজ করে, যেমন- সেলেনিয়াম, মেলিডেনম ইত্যাদি।
ডা. গোবিন্দ চন্দ্র দাস
সিনিয়র কনসালটেন্ট , শহীদ সোহরাওয়াদী হাসপাতাল, ঢাকা। করোনারী আর্টারী ডিজিস প্রিভেনশান এন্ড রিগ্রেশান সিএডিপিআর সেন্টার, ৫৭/১৫ পশ্চিম পান্থপথ, ঢাকা। ফোন : ০১৯২১৮৪৯৬৯৯।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, আগস্ট ০৮, ২০০৯
Leave a Reply