গ্রীক ভাষায় অ্যাজমা শব্দের অর্থ হল হাঁপ ধরা অথবা হ্যাঁ করে শ্বাস টানা। গ্রীক চিকিৎসক হিপোক্রেটিস যে কোন ধরনের শ্বাসকষ্টকে হাঁপানি নাম দিয়েছিলেন। অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্ট এমন একটা রোগ যার নির্দিষ্ট কোন কারণ নেই। আবার যার অ্যাজমা আছে সে কখনও এ রোগ থেকে একেবারে ভালো হবে না কিন্তু নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে। অ্যাজমাকে বলা হয় এমন একটা রোগ যার নিয়ন্ত্রণই একমাত্র চিকিৎসা। অ্যাজমার প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। উন্নত দেশ বলুন আর উন্নয়নশীল দেশই বলুন সব স্থানেই অ্যাজমা বেড়েই চলেছে। ৩০০ মিলিয়ন মানুষ বর্তমানে সারাবিশ্বে এ রোগে ভুগছেন। ২০২৫ সালের মধ্যে আরও ১০০ মিলিয়ন মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কম বয়সের ছেলেদের মাঝে এ রোগ বেশি দেখা যায়। আর প্রাপ্ত বয়সের রোগীদের মাঝে মহিলারাই বেশি আক্রান্ত হয়। অ্যাজমা রোগ নিয়ন্ত্রণে না থাকলে স্কুল, কলেজ, কর্মক্ষেত্রে স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত হয়। প্রায়ই হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়, অনেক সময় মৃত্যুও হতে পারে।
অ্যাজমা বা হাঁপানি রোগীর শ্বাসনালী অতিরিক্ত সংবেদনশীল। এর ফলে কোন উত্তেজক যেমন ঘরে ধুলা, সিগারেটের ধোঁয়া, ঘরের ঝুল, ঠান্ডা লাগা, ফুলের রেণু বা পশুপাখির সংস্পর্শে আসা ইত্যাদিতে হঠাৎ করে শ্বাসনালী সংকুচিত করে প্রচণ্ড শ্বাসকষ্টের সৃষ্টি করতে পারে। রোগীর শ্বাসনালীর পথ স্বাভাবিক অবস্থার থেকে সরু হয়ে যায়, ফলে ফুসফুসে বাতাস প্রবেশের পথে বাধার সৃষ্টি হয়। ফলে বুকের মধ্যে শোঁ শোঁ শব্দ হয়, শ্বাস নিতে প্রচণ্ড কষ্ট হয়, কাঁশি হয়, বুকে ভার হয়ে চেপে আসে। এই আক্রমণ মৃদু আকারে দেখা দিলে সামান্য ওষুধ বা ওষুধ ছাড়াই ভালো হয়ে যেতে পারে, আবার এটা মারাত্মক আকার ধারণ করে রোগীর মৃত্যুর কারণ হতে পারে। সঠিক চিকিৎসা হলে এ ধরনের মৃত্যুর ৯০% রোধ করা সম্ভব। এছাড়া রোগীর শ্বাসনালীতে দীর্ঘমেয়াদী প্রদাহ হয়ে থাকে।
একই পরিবেশে একজনের অ্যাজমা অ্যাটাক হচ্ছে কিন্তু অন্য জনের হচ্ছে না। এর প্রধান কারণ ঐ আবহাওয়ায় এমন কিছু জিনিস আছে, যার অ্যাজমা অ্যাটাক হলো সে ঐ জিনিসের প্রতি সংবেদনশীল। ঐ সব জিনিসকে বলা হয় অ্যাজমা ট্রিগার বা অ্যালার্জেন। অ্যাজমা অ্যাটকে ট্রিগার বা অ্যালার্জেনগুলো মোটামুটি নিম্নরূপ-
১। ধুলোবালি,
২। ফুলের রেণু,
৩। পোকা মাকড়,
৪। ব্যায়াম বা কায়িক পরিশ্রম,
৫। কিছু ওষুধ (যেমন অ্যাসপিরিন, বিটাব্লকার),
৬। আবেগ (দুঃখের, ভয়ের কিংবা আনন্দের কারণে হতে পারে),
৭। ধূমপান,
৮। পোষা প্রাণী।
৯। ঠাণ্ডা এবং ভাইরাস,
১০। পশু-পাখীর লোম ইত্যাদি।
শ্বাসনালীতে রেসপেরিটরী সিনসাইটিয়াল ভাইরাস আক্রমণ করলে অ্যাজমা হতে পারে।
এছাড়া শারীরিক মিলন কার্যক্রম কারো ক্ষেত্রে অ্যাজমা অ্যাটাক করতে পারে।
এসব অ্যালার্জেন একেকজনের বেলায় একেক রকম হতে পারে। কারো একটা, দুটো কারো পাঁচ সাতটাও থাকতে পারে। সুতরাং অ্যাজমা অ্যাটাক থেকে বাঁচার জন্য অবশ্যই ধরণ অনুযায়ী এগুলো থেকে দূরে থাকতে হবে।
যেসব কারণে হাঁপানি সৃষ্টি হয়ে থাকে, তার উপর ভিত্তি করে অ্যাজমাকে দুভাগে ভাগ করা যায়।
১. এলার্জি বা বাহিরের কারণ জনিত অ্যাজমা : এর ফলে কোন উত্তেজক যেমন ঘরের ধুলা, ধুলাবালি, ফুলের গন্ধ, নানা ধরনের খাদ্যদ্রব্য, ছত্রাক, সিগেরেটের ধোঁয়া, ঘরের ঝুল ঝাড়া, ঠাণ্ডা লাগা, ফুলের রেণু বা পশুপাখির সংস্পর্শে আসা ইত্যাদিতে হঠাৎ করে শ্বাসনালী সংকুচিত করে প্রচণ্ড শ্বাসকণ্টের সৃষ্টি করতে পারে। জন্ম থেকেই এদের হাঁপানি হওয়ার প্রবণতা থাকে। অনেক সময় এসব রোগীর এলার্জির অন্যান্য উপসর্গও থাকতে পারে। যেমন এলার্জিক রাইনাইটিজ, একজিমা ইত্যাদি। জীবনের প্রথম দিকে এধরনের হাঁপানি হয়ে থাকে।
২. স্প্যাজমোটিক বা ভিতরগত কারণজনিত অ্যাজমা : এধরনের রোগীদের এলার্জির কোন ইতিহাস থাকে না। জীবনের শেষ দিকে অর্থাৎ অধিক বয়সে এরূপ হাঁপানি হয়ে থাকে।
লক্ষণ: শ্বাসকষ্ট, বুকে সাঁই সাঁই আওয়াজ, বুকে চাপবোধ হওয়া, কাশি উঠতে থাকে। কোনো কোনো সময় কাশি একমাত্র লক্ষণ হতে পারে। প্রায় সময়ই রাত্রে, ব্যায়াম বা কায়িক পরিশ্রমের সময় হয়। তবে যেকোন সময়ই অ্যাজমা অ্যাটাক হতে পারে।
চিকিৎসা: হাঁপানি তীব্র আক্রমণ হলে রোগীকে সোজা করে বসান, শান্ত করুন এবং আশ্বস্ত করুন। সলবিউটামল জাতীয় ওষুধ এর ইনহেলার ৫ বার ঝাঁকিয়ে নিন, ৫ চাপ ওষুধ নিন, প্রতি চাপ নেওয়ার পর ৫ সেকেন্ড দম ধরে রাখুন, ৫ মিনিট পরে আবার একইভাবে ইনহেলার ব্যবহার করুণ। কোন পরিবর্তন না হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। এলার্জিজনিত হাঁপানির ক্ষেত্রে যেসব জিনিসে রোগীর শ্বাসকষ্ট বৃদ্ধি পায় তা পরিহার করা উচিত। অ্যাজমা নিয়ন্ত্রণের জন্য দুধরনের ওষুধ ডাক্তাররা দিয়ে থাকেন।
১) রেসকিউ মেডিকেশনঃ যেমন- সালবিউটামল, পিরবিউটারল, মেটাপ্রোটারেনল ইত্যাদি।
২) কন্ট্রোলার মেডিকেশনঃ যেমন- মন্টোলিউকাস্ট, প্রেডনিসোলন, থিউফাইলিন, ইনহেল স্টেরয়েড ইত্যাদি।
মনে রাখতে হবে কন্ট্রোলার মেডিকেশনগুলো হঠাৎ অ্যাটাকে কখনই কাজ করে না। এজন্য অবশ্যই রেসকিউ মেডিকেশনগুলো যেমন- সালবিউটামল জাতীয় ইনহেলার ব্যবহার করতে দ্বিধা-দ্বন্ধে ভুগবেন না। অনেকে মনে করেন প্রথম অবস্থায় ইনহেলার ব্যবহার করলে সারাজীবন ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে হঠাৎ অ্যাটাকে ইনহেলার ব্যবহারের বিকল্প নেই।
এছাড়াও অ্যালার্জির ধরন অনুযায়ী ডাক্তার যদি ভ্যাকসিন দিতে চায়, অবশ্যই নিয়মিতভাবে নিতে হবে। অ্যাজমা ভালো হওয়ার জন্য কোনো ঔষুধ এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। কিন্তু কিছু পদক্ষেপের মাধ্যমে আপনি আপনার অ্যাজমার চরম অবস্থা এবং মাত্রা কমাতে পারেন। যেসব জিনিসে রোগীর শ্বাসকষ্ট বৃদ্ধি পায় তা পরিহার করা এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ঔষুধ সেবন করে হাঁপানির রোগীরা অনেকাংশেই সুস্থ্য থাকতে পারেন।
কখনো কখনো হার্ট ফেইলিউর হলে অ্যাজমার মতোই শ্বাসকষ্ট হতে থাকে যাকে কার্ডিয়াক অ্যাজমা বলা হয়। আবার কিডনির সমস্যা হলেও শ্বাসকষ্ট হতে থাকে যাকে রেনাল অ্যাজমা বলা হয়। রোগ নির্ণয়ে ফুসফুসের কার্জক্ষমতা পরীক্ষা করা, এক্সরে, ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাম, রক্তের পরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে। শ্বাসকষ্ট হলে সঠিক রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা রোগীর অনেক কল্যাণ বয়ে আনতে পারে।
লেখকঃ ডাঃ মোহাম্মদ শফিকুর রহমান পাটওয়ারী
২৫শে নভেম্বর ২০০৭, দৈনিক ইত্তেফাক
Leave a Reply