ব্যথানাশক ওষুধ প্যারাসিটামলের সঙ্গে আমরা সবাই মোটামুটিভাবে পরিচিত। ওষুধটির জ্বর কমানোর গুণ থাকায় জ্বরের জন্য এটির ব্যবহার হয়ে থাকে। বেদনানাশক জ্বর উপশমক হিসেবে প্যারাসিটামল (নাপা, এইস, প্যারাপাইরল বা পাইরালজিন প্রভৃতি নামেও পাওয়া যায়) যথেষ্ট কার্যকর ও অনেকটা নিরাপদ বলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও ওষুধটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ব্যথা ও ব্যথার ওষুধ প্যারাসিটামল সম্পর্কে আমাদের জানার পরিধি আরও কিছুটা বাড়ালে সবার উপকার হবে।
ব্যথার শ্রেণীভাগ ও কারণ
আমাদের শরীরে পরিস্কুট রোগলক্ষণের মধ্যে ব্যথাই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি উল্লেখ করা হয়। অনেক রোগনির্ণয়ে ব্যথার ধরন বা তীব্রতা সহায়ক হয়।
উৎসস্থল বিচারে ব্যথাকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়-
১· ত্বক, পেশি, অস্থিসন্ধি ইত্যাদি জায়গা থেকে উৎপন্ন ব্যথা, দৈহিক বা সোমাটিক ব্যথা, যা সোমাটিক স্মায়ুর সাহায্যে মস্তিষ্কে পৌঁছায়।
২· দেহের ভেতরের বিভিন্ন অঙ্গ থেকে উদ্ভূত হয়ে অটোনমিক বা স্বয়ংক্রিয় স্মায়ুপথে বাহিত হয়ে মস্তিষ্কে পৌঁছায়।
সাধারণত আঘাত, ক্ষত, চাপ, প্রদাহ বা রোগজনিত পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত কোষকলা থেকে রাসায়নিক পদার্থ বের হয়ে উদ্দীপনা সৃষ্টি করে, যা স্মায়ুপথ বেয়ে মস্তিষ্কে অবস্থিত থ্যালামাসে পৌঁছায় এবং বেদনা অনুভূতির জন্ম দিয়ে থাকে।
আমাদের প্রত্যেকেরই ব্যথা অনুভব করার একটি স্বাভাবিক ক্ষমতা রয়েছে। চাপ বা অনুরূপ কারণে যে অবস্থায় সুস্পষ্ট ব্যথার অনুভূতি উপলব্ধি করা যায়, সে অবস্থাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে পেইন থ্রেসহোল্ড বলা হয়। যখন এই পেইন থ্রেসহোল্ড বাড়ানো হয়, অধিক চাপ বা ব্যথা সৃষ্টির কারণ তীব্রতর না হলে ব্যথা অনুভূত হয় না। অন্যদিকে পেইন থ্রেসহোল্ড কমানো হলে অল্পতেই ব্যথা উপলব্ধি হয়। নারী-পুরুষ, দেহের তাপমাত্রা, গা ঘেমে যাওয়া, ভয়, উদ্বিগ্নতা, অনুভূতি ইত্যাদি পেইন থ্রেসহোল্ডের পরিবর্তন ঘটিয়ে থাকে। ব্যক্তিবিশেষে ভিন্নতর পেইন থ্রেসহোল্ড আবার একই ব্যক্তির বিভিন্ন সময়ে হতে পারে। এ কারণেই গবেষণার ফলাফল ও রোগীর গ্রহণ করা বেদনানাশকের মূল্যায়নে কখনো বা পার্থক্য দেখা যায়।
বেদনানাশক ওষুধের ক্রিয়াপদ্ধতি পুরোপুরি নিরূপণ করা সম্ভব না হলেও অধিকাংশ তথ্য থেকে এটা স্বীকৃত যে, স্মায়ুবাহিত বেদনাপ্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি বেদনা উপশমের একটি অন্যতম প্রক্রিয়া। রোগীর বেদনা উপলব্ধি এবং গুরুমস্তিষ্কে বেদনার প্রতিক্রিয়ার ওপর প্রভাব বিস্তারের মধ্যে বেদনানাশক ওষুধের কার্যকারিতা নিহিত।
ব্যথার ওষুধ ও প্যারাসিটামল
ব্যবহারিক বিচারে বেদনানশক ওষুধ সাধারণভাবে দুই ভাগে বিভক্ত। নারকোটিক বেদনানাশক ওষুধ, যেমন-মরফিন, প্যাথিড্রিন ইত্যাদি। এগুলো মাদকজাতীয় ও আসক্তি তৈরি করে। এ-জাতীয় ওষুধ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া গ্রহণ সম্পূর্ণভাবে নিষেধ। আরেকটি ভাগ হচ্ছে, অ-মাদক বেদনানাশক, যেমন-প্যারাসিটামল, অ্যাসপিরিন ইত্যাদি। এদের মধ্যে প্রদাহবিরোধী, যেমন-আইবুপ্রোফেন ইত্যাদিও ব্যথানাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
দৈহিক বা সোমাটিক ব্যথায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে অ-মাদক বেদনানাশক, বিশেষ করে প্যারাসিটামলই ব্যবহৃত হয়। মাথাব্যথা, গলাব্যথা, পেশির ব্যথা, দাঁতের ব্যথা, ঋতুকষ্ট ইত্যাদিতে প্যারাসিটামল খুবই কার্যকর। জ্বর উপশমেও প্যারাসিটামল একটি ফলপ্রসূ ওষুধ। বিশ্বের অন্যান্য দেশে কিছু ওষুধ চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই বিক্রি হয় এবং যে-কেউ নির্দিষ্ট ওষুধগুলো কিনতে পারে। এসব ওষুধ ওভার কাউন্টার বা ওটিসি হিসেবে পরিচিত। আমাদের দেশের ফার্মেসিগুলো থেকে অ্যান্টিবায়োটিকসহ যে-কেউ যেকোনো ওষুধ কিনতে পারে, অর্থাৎ ওষুধ নীতিমালা মেনে চলা হয় না।
প্যারাসিটামল, যা ব্রিটিশ ফার্মাকোপিয়া অনুসারে পরিচিত, আর আমেরিকায় নাম এসিটোমাইনোফেন। ব্যথানাশক ওষুধ একটিই, শুধু ব্রিটিশ আর আমেরিকায় নামের ভিন্নতা। আমাদের দেশে প্যারাসিটামল নামেই বেশি প্রচলিত। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ৫০০ মিলিগ্রামের ট্যাবলেট একটি, কখনো প্রয়োজনে দুটি। ২৪ ঘণ্টায় তিন-চারবার খাওয়াই নির্দিষ্ট ডোজ। কিন্তু ২৪ ঘণ্টায় চার গ্রাম বা ৪০০০ মিলিগ্রামের বেশি খাওয়া যাবে না। শিশুদের ক্ষেত্রে বয়স ওজন অনুযায়ী প্যারাসিটামল সিরাপ দিতে হবে। চার গ্রাম হচ্ছে সর্বোচ্চ মাত্রা।
প্যারাসিটামলের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সাধারণত গুরুতর নয়। দু-একটা ক্ষেত্রে রক্তের প্রয়োজনীয় উপাদানগুলোর অভাব সৃষ্টি বা চামড়ায় ফুস্কুড়ি দেখা গেছে।
উল্লিখিত পরিমাণের চেয়ে বেশি প্যারাসিটামল গ্রহণ করা উচিত নয়। বেশি গ্রহণ করলে কিডনি ও লিভারের ক্ষতির ঝুঁকি থাকে। অনেকেই ২৪ ঘণ্টায় ১০-১২টি ৫০০ মিলিগ্রামের প্যারাসিটামল খেয়ে থাকে। এটি মোটেও ঠিক নয়। মোট চার গ্রাম হচ্ছে ৫০০ মিলিগ্রামের আটটি ট্যাবলেট, এটি হচ্ছে সর্বোচ্চ নির্ধারিত মাত্রা। লিভারের সমস্যা থাকলে আরও কম মাত্রা গ্রহণ করতে হবে।
এফডিএঃ জুলাই ২০০৯
আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগস (এফডিএ) কর্তৃপক্ষ ১ জুলাই এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, আমেরিকায় অতিরিক্ত এসিটোমাইনোফেন বা প্যারাসিটামল ব্যবহারের জন্য লিভার অকার্যকর হয়ে অনেকে মৃত্যুবরণ করছে।
এফডিএ এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ কমিটির মিটিং করেছে। প্যারাসিটামলের সঙ্গে কোডিন বা এ-জাতীয় মিশ্রণের ব্যাপারে সতর্কতার কথা বলেছে। আমাদের দেশেও বর্তমানে প্যারাসিটামল ও কোডিনের মিশ্রণে তৈরি ট্যাবলেট উৎপাদিত ও বাজারজাত হচ্ছে। এ জন্য শুধু প্যারাসিটামল গ্রহণ অনেক নিরাপদ। এফডিএ প্রস্তাব করেছে, প্যারাসিটামলের সঙ্গে কোডিন বা এ-জাতীয় কোনো মিশ্রণ থাকলে ওষুধের গায়ে বক্স আকারে উল্লেখ থাকতে হবে।
সচেতনতা জরুরি
ব্যথানাশক ও জ্বর উপশমকারী প্যারাসিটামল একটি নিরাপদ ও কার্যকর ওষুধ। প্যারাসিটামলের সঙ্গে অন্য কোনো ওষুধের সংমিশ্রণ থাকলে শরীরের ক্ষতি হতে পারে। ব্যথা হলেই ওষুধ খেতে হবে-এটা সব সময় ঠিক নয়। ব্যথার সহনক্ষমতা পর্যন্ত অপেক্ষা করা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। প্যারাসিটামল একটি করে তিন-চারবার খেলে কাজ হয় না। দুটি করে খেতে হবে, এটা সঠিক নয়। ব্যথা বা জ্বরের জন্য তিন দিন পর্যন্ত প্যারাসিটামল খেতে পারেন। এতে উপকার না পেলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ব্যথা থাকবে, নিরাময়ের জন্য প্যারাসিটামল খেতে হবে, কিন্তু সতর্কতাও জরুরি। প্যারাসিটামলের মতো নিরাপদ বেদনানাশক খুব বেশি নেই বলে ওষুধটি আমাদের দেশে বহুল ব্যবহৃত। বেদনানাশক অন্যান্য ওষুধ চিকিৎসকের পরামর্শে গ্রহণ করা উচিত। আমাদের স্বাস্থ্যের দায়িত্ব অনেকটা আমাদের ওপর। এ জন্য স্বনির্বাচিত ওষুধ গ্রহণে সতর্কতা অবলম্বন করুন।
রেজাউল ফরিদ খান
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ০৫, ২০০৯
Leave a Reply