ছয় বছর বা তার কাছাকাছি বয়সের সন্তানের পিতা মাতা তাদের শিশুদের অসুখ প্রসঙ্গে নিচের কথাগুলো প্রায়ই বলে থাকেন।
আমার ছেলের ঘন ঘন সর্দি হয়। সারতে সময় লাগে কয়েক সপ্তাহ। এর বন্ধুদেরও সর্দি হয়। তবে ওরা খুব তাড়াতাড়ি সেরে ওঠে। আমার ছেলে সুস্থ হয় খুব ধীরে ধীরে। আর সর্দি সেরে যাওয়ার পরপরই ওর কানে ইনফেকশন হয়, কাশি থাকে এবং বুকে শন শন শব্দ হয় কয়েক সপ্তাহ ধরে। ওর বয়স যখন ১২ মাস, তখন থেকেই ওর এসব অসুবিধা শুরু হয়েছে। এ ছাড়া তিন বছর বয়স পর্যন্ত সে খারাপ ধরনের একজিমায় আক্রান্ত ছিল।
এ ধরনের শিশু শ্বাসতন্ত্রের অসুখ নিয়ে প্রায়ই ডাক্তারের কাছে আসে। তাদের অনেকেরই এসব উপসর্গের মূল কারণ হয়ে থাকে এলার্জি এবং অ্যাজমা।
শিশুদের অ্যাজমা ও এলার্জি শনাক্ত করতে হলে ডাক্তার এবং শিশুর অভিভাবকদের পাস্পরিক সহযোগিতা প্রয়োজন। পারিবারিক চিকিৎসা হয়তো শিশুকে এলার্জি-ইমিউনোলজি বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠাতে পারেন। বিশেষজ্ঞের কাছে রোগের অনুপুঙ্খ ইতিহাস বলার পাশাপাশি পরিবারের অন্য কারো এলার্জি বা অ্যাজমা থাকলে সে কথাও জানাতে হবে।
পাঁচ বছরের নিচের শিশুর অ্যাজমায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে কি না তা ধারণা করার নির্দিষ্ট গাইডলাইন আছে। এ ধারণা করা যায় কিছু বড় লক্ষণ এবং কিছু ছোট লক্ষণকে একত্রে মিলিয়েঃ
কম বয়সে বুকে সাঁই সাঁই শব্দ (এক বছরে অন্তত তিনবার এমনটি ঘটেছে, প্রতিবার কমপক্ষে ১ ঘণ্টা করে এটি থেকেছে এবং শিশুর নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটেছে)। এর সাথে থাকতে হবে দু’টি বড় লক্ষণের মধ্যে কমপক্ষে একটির উপস্থিতি অথবা তিনটি ছোট লক্ষণের মধ্যে কমপক্ষে দু’টির উপস্থিতি।
বড় লক্ষণ বা প্রধান লক্ষণ-
* বাবা মায়ের অ্যাজমা
* এটোপিক ডারমাটাইটিস (একজিমা)
* ছোট লক্ষণ বা অপ্রধান লক্ষণ
* এলার্জিক রাইনাইটিস (হে ফিভার)।
* রক্তের মধ্যে এলার্জি কোষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া।
* সর্দি বা ভাইরাস সংক্রমণ ছাড়াই বুকের সাঁ সাঁ শব্দ।
পারিবারিক রোগের ইতিহাস ছাড়াও জন্মের পর থেকে এ পর্যন্ত শিশুর সব অসুখের তথ্য সবিস্তারে জেনে নিতে হবে। বিশেষ করে খোঁজ নিতে হবে গলাফোলা, ব্রঙ্কাইটিস বা নিউমোনিয়া হয়েছিল কি না। পিতা মাতা কোনো কিছুকে শিশুর অসুখের কারণ বলে মনে করেন কি না। শিশুকে ইতোমধ্যে কোন কোন ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে তার পূর্ব তালিকা সংগ্রহ করতে পারলে খুব ভালো হয়। এটাও জানতে হবে যে ওষুধ ব্যবহার করে উপকার পাওয়া গিয়েছিল কি না। কিংবা কোনো ওষুধ থেকে শিশুর কোনো গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছিল কি না।
অসুস্থতার ইতিহাস জানার পর ডাক্তার রোগীকে শারীরিক পরীক্ষা করবেন। তিনি দেখবেন শরীরে এলার্জি ও অ্যাজমার নিন্মোক্ত চিহ্নগুলো আছে কি না
* ত্বকঃ শুষ্ক, লালচে, চুলকানি বা চুলকানির দাগ।
* ফুসফুসঃ সাঁই সাঁই শব্দ, কাশি, নিঃশ্বাসের শব্দে কোনো অস্বাভাবিকতা, শ্বাসবায়ু প্রবাহের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য।
* বুকঃ ঠেলে ওঠা বুক, বা কাঁধের ফোলা মাংসপেশি যা নিঃশ্বাসের কষ্টের কারণে হয়ে থাকে।
* চোখ, কান, নাক, গলাঃ লাল চোখ, চোখ থেকে পানি ঝরা, নাকের পাটা ফুলে থাকা, নাক থেকে নিঃসৃত সর্দির বর্ণ ও পরিমাণ, টনসিলের আকার ও রঙ, ঘাড়ে কোনো নাসিকাগ্রন্থি ফোলা কি না।
* এসব ছাড়াও থাকতে পারে হাঁচি, নাকটানা, চোখ ও নাক বারবার ডলাডলি করা, চোখের নিচে কালো দাগ পড়া।
শারীরিক পরীক্ষার শেষে যদি চিকিৎসক শিশুটির এলার্জি আছে বলে সন্দেহ করেন, তাহলে তিনি তার পরিবেশের বিশদ তথ্য নিতে চেষ্টা করবেন। যেমন
* দিনের অধিকাংশ সময় শিশুটি কোথায় থাকে? (বাড়িতে, ডে কেয়ারে, প্রাক স্কুল শিক্ষালয়ে, কোনো আত্মীয়দের বাড়িতে, ইত্যাদি)।
* ওই জায়গায় কোনো গৃহপালিত পশু-পাখি আছে কি না।
* তার পাশে কেউ ধূমপান করে কি না।
* অন্য কোনো জিনিস, যা এলার্জি বাড়িয়ে দিতে পারে, সেগুলোর সংস্পর্শ আছে কি না।
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, অ্যাজমা আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে শতকরা ৮৫ জনই এলার্জি স্কিন টেস্টে পজিটিভ হয়েছে। এলার্জি স্কিন টেস্ট এখন সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পরীক্ষা হিসেবে বিবেচিত। এ ক্ষেত্রে শিশুর ত্বকে সন্দেহভাজন অ্যালার্জেনগুলোকে প্রিক-এর মাধ্যমে দিয়ে দেয়া হয়। যদি শিশু ওই এলার্জেন দ্বারা প্রভাবিত থাকে, তাহলে ১০-২০ মিনিটের মধ্যে ত্বকে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
ছয় থেকে আট বছরের শিশুদের ফুসফুসের কর্মক্ষমতা পরিমাপ করার জন্য স্পাইরোমেট্রি একটি নির্ভরযোগ্য পরীক্ষা। প্রথামিক অবস্থায় রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হলে এলার্জি ও অ্যাজমা নিয়ন্ত্রণ করা অনেক সহজ হয়।
লেখকঃ ডা. গোবিন্দ চন্দ্র দাস
দৈনিক নয়াদিগন্ত, ৩০শে ডিসেম্বর ২০০৭
Leave a Reply