ঘটনাটি এরকম। দক্ষিণ আফ্রিকায় বিশেষ ভয়ানক ধরনের যক্ষার বিস্তার যখন ঘটলো তখন বোঝা গেলো পৃথিবীর অন্যতম ভয়ংকর এই রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখার বিশ্বজুড়ে যে প্রোগ্রাম চলছিলো, তা ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেলো। এই প্রোগ্রামের মধ্যে ছিলো যক্ষারোগ সনাক্ত করা, রোগীরা এন্টিবায়োটিক ঠিকমত গ্রহণ করছে তা নিশ্চিত করা, এসব ওষুধে তাদের রেজিস্ট্যান্স হচ্ছে কিনা তা পরীক্ষা করা এবং রোগের বিস্তার হলে তা মনিটর করা। কিন্তু আন্তর্জাতিক যক্ষা বিশেষজ্ঞরা বললেন এই ব্যবস্থা বেশ কয়েকটি কারণে সমস্যায় পড়েছে: এন্টিবায়োটিকের অপব্যবহার; অন্যান্য অপচিকিৎসা, যেমন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে উচ্চ ঝুঁকি রোগীদেরকে আলাদা রাখতে ব্যর্থ হওয়া; এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ল্যাবরেটরীতে এবং ওষুধ সরবরাহে অর্থ খরচে সরকারের গাফিলতি। এসব কারণে ড্রাগ-রেজিস্ট্যান্ট যক্ষার জীবাণু বেড়ে চললো: যে ভয়ংকর ব্যাপারটি পৃথিবী এখন বুঝতে শিখছে-কত ভয়ানক এই বিপদ! এই রোগের পেছনে অণুজীব ‘মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকুলোসিম’ আবিষ্কৃত হয়েছিলো ১২৫ বছর আগে মার্চ মাসে। বর্তমানে এই জীবাণু প্রতিবছর ৮.৮ মিলিয়ন লোককে সংক্রমিক করছে; ঘটছে ১.৬ মিলিয়ন লোকের প্রাণহানি। রোগীর কফ কাশের সময় সূক্ষ্ণ বিন্দুকণার মাধ্যমে ছড়ায় এ জীবাণু।
অথচ যতক্ষণ পর্যন্ত এর জীবাণু এন্টিবায়োটিকের দাপটের কাছে হার মানে ততক্ষণ পর্যন্ত যক্ষা সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য। তবে এইডস রোগীর যদি যক্ষা হয় তখন তা হয়ে উঠে ভয়ংকর। আর যখন যক্ষার জীবাণু চরম ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট হয়ে উঠে, তখন মৃত্যুর হার উঠে তুঙ্গে। এরকম ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট যক্ষার জীবাণুর সংখ্যা ও প্রকোপ বেশি দক্ষিণ আফ্রিকায়। তেমন একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার কাওয়াজুলু নাটাল প্রদেশের একটি গ্রামে, XDR-TB নামে প্রচণ্ড ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টি.
বির প্রকোপে মারা গেলো ৫৩ জন রোগীর ৫২জনই। আবার এদের সবারই ছিলো এইচআইভি (এইডস) সংক্রমণ। ২০০৫ সালে এই প্রাদুর্ভাব সনাক্ত করা হলেও ২০০৬ সালে আগস্ট মাসে আন্তর্জাতিক এইডস সম্মেলনে প্রথম এর কথা জানলো পৃথিবীর লোক।
ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট এ ধরনের যক্ষার জীবাণুকে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা একটি ভয়ংকর জনস্বাস্থ্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আফ্রিকার মত দরিদ্র দেশে লক্ষ লক্ষ এইচআইভি সংক্রমিত লোকের মধ্যে যক্ষার বিধ্বংসী প্রভাব লক্ষ্য করে এ মন্তব্য সে সংস্থাটি করেছে।
আবার ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী এবং অন্যান্য রোগে যেসব লোকের দেহ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল এদের যক্ষা হলেও রোগটি হয়ে উঠে ভয়াবহ।
XDR-TB নামের যক্ষারোগ এর একটি ব্যাখ্যা প্রয়োজন। এ ধরনের যক্ষারোগ দুটো গুরুত্বপূর্ণ যক্ষারোধী ওষুধ (আইসোনিয়াজিড ও রিফামপিসিন) এবং সে সঙ্গে আরো দুটো ওষুধ ফ্লুরোকুইনোলোন গ্রুপের একটি ওষুধ এবং ক্যাপ্রিওমাইসিন, ক্যানামাইসিন ও এমিকেসিন এরকম ওষুধের রেজিস্ট্যান্ট হলে XDR-TB যক্ষা বলা হয়ে থাকে। রেজিস্ট্যান্ট টিবির এই ধরনটি সবচেয়ে ভয়ানক।
এরচেয়ে এক ধাপ নিচে হলো MDR-TB। এর নাম মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবি। ১৯৯০ সালের গোড়ার দিকে নিউইয়র্ক সিটিতে পর্যন্ত এর প্রাদুর্ভাব ঘটেছিলো।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দক্ষিণ আফ্রিকার যক্ষার প্রাদুর্ভাব স্মরণাতীতকালের সবচেয়ে ভয়াবহ যক্ষারোগ। অথচ এ সম্বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে এক বছর পর। দক্ষিণ আফ্রিকার মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের ডাঃ করিম ওয়ের বলেন এক বছর আগে পর্যন্ত এ বিষয়ে বেশি অবহিত না হওয়ার কারণ হলো এ নিয়ে ততদিন ধারাবাহিকভাবে তেমন সমীক্ষা হয়নি।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোর পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে প্রতিবছর দক্ষিণ আফ্রিকায় ৬০০০ MDR-TB নতুন ধরা পড়ছে বলে জানা গেলো। চিকিৎসায় সফলতা আসে নাই ১০% ক্ষেত্রে। প্রতিবছর XDR-TB হচ্ছে ৬০০ জন লোকের। দেখা যায়, XDR-TB ও এইচআইভি দুটোই আছে এমন লোকের মধ্যে মৃত্যুহার ৮৫%। সবচেয়ে বিপদের কথা হলো: দক্ষিণ আফ্রিকার নয়টি প্রদেশের ৪০টি হাসপাতালে ভয়ানক XDR-TB এর জীবাণুর অস্তিত্ব রয়েছে। সাবসাহারান আফ্রিকার বাকি অংশও রয়েছে ঝুঁকির মধ্যে কারণ সেসব দেশে বায়ুবাহিত সংক্রমণের নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে।
তবে এর প্রাদুর্ভাব কেবল আফ্রিকাতেই সীমাবদ্ধ তা নয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার একজন যক্ষা বিশেষজ্ঞ ডাঃ পল নান একটি সম্মেলনে বলেছেন, অন্তত ২৮টি দেশে এ ধরনের যক্ষা রয়েছে। মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট ধরনের যক্ষা বিষয়ে উপাত্ত সংগ্রহ করে বলা যায় যে, MDR-TB রোগের দুই তৃতীয়াংশ রয়েছে চীন, ভারত ও রাশিয়ায়।
এ রোগের বিস্তারের কারণ ও ধরন সর্বত্র একই: এন্টিবায়োটিকের অপব্যবহার। ডা: নান বলেন, যখন যক্ষার বিরুদ্ধে প্রথম সারির ওষুধগুলো সফল হলো না তখন ডাক্তাররা কম প্রচলিত দ্বিতীয় সারির ওষুধ ব্যবহার করেন, এগুলো কার্যকর হবে বলে অনুমান করেন তারা, কারণ জীবাণুগুলো এদের প্রতি রেজিস্ট্যান্ট হবার তেমন সুযোগ পায়নি। ডা: নান আরও বলেন, ভয় হচ্ছে অন্যান্য দেশেও নীরবে যক্ষা ছড়াচ্ছে।
আগে পরীক্ষকরা বলেছিলেন ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট যক্ষার জীবাণু ছাড়ায় অল্প। কিন্তু হার্ভার্ডের বিজ্ঞানীরা বলছেন এ ধারণটি সঠিক নয়। MDR-TB প্রচলিত যক্ষারোগের মতই খুব ছোঁয়াচে, ছড়ায়ও বেশি। এটিই উদ্বেগের কারণ। ডা: ওয়ের বলেন, উন্নয়নশীল বিশ্বে বেশিরভাগ জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বায়ুবাহিত সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারটি নেই বললেই চলে।
দক্ষিণ আফ্রিকার গবেষকরা ১৬৯৪ জন আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের পরীক্ষা করলেন যারা ৩৮৬ জন MDR-TB রোগীদের সংস্পর্শে এসেছিলেন। এদের মধ্যে মাত্র ১২টি মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট যক্ষা পাওয়া গেলো, কারো মধ্যেই MDR-TB পাওয়া গেলো না। এতে বোঝা গেলো জনগণের মধ্যে রোগের যথেষ্ট বিস্তার ঘটেনি। তবে পরে জানা গেলো ঘটনা অন্যরকম। এমনকি ওষুধে সংবেদনশীল এমন যক্ষা সংক্রমণও রোগ ঘটাবার আগে বছরের পর বছর নীরবে দেহে বাসা বেঁধে থাকতে পারে।
চিকিৎসা বিষয়ক জার্নাল ও বৈজ্ঞানিক অধিবেশনসমূহে দক্ষিণ আফ্রিকার ডাক্তাররা এবং অন্যরাও XDR-TB রোগীদের অন্তরীণ রাখার পক্ষে জোরেশোরে বলছেন। তবে বলপূর্বক অন্তরীণ রাখার বিষয়টি কার্যে পরিণত করা বেশ জটিল।
যেহেতু MDR-TB যক্ষা দুশ্চিকিস্য ধরা হয় সেজন্য সেসব রোগীদেরকে আমৃত্যু অন্তরীণ রাখার কথা বলা হচ্ছে। সংক্রমিত রোগীরা সহজেই রোগ ছড়াতে পারে অন্যদের। এছাড়া যারা এসব রোগীকে পরিচর্যা করেন তাদের জন্য এ রোগ পেশাগত ঝুঁকিও বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। দক্ষিণ আফ্রিকার টুগেলাফেরিতে এ রোগের প্রাদুর্ভাব যখন ঘটে তখন ৫৩ জনের মধ্যে যে রোগ হয়েছিলো এর মধ্যে ৬ জন ছিলো স্বাস্থ্যকর্মী।
ডাঃ ওয়ের এসব প্রশ্ন তুলেছেন। কি কি সুবিধা ব্যবহার করা যাবে? XDR-TB রোগীদের পরিচর্যার দায়িত্ব নেবেন স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে কারা? এসব স্বাস্থ্যকর্মীকে সুরক্ষার ব্যবস্থা কি হবে?
দক্ষিণ আফ্রিকার কোনও কোনও হাসপাতালে প্রযুক্তি প্রকৌশল এবং সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি চর্চা করা হচ্ছে, যেমন যক্ষার জীবাণু ধ্বংস করার জন্য অতিবেগুনী আলো ব্যবহার।
ডাঃ ওয়ের বলেন, ঘন ঘিঞ্জি ক্লিনিকে, এক্সরে বিভাগে, অপেক্ষমাণ লোকজনের লাইনে এবং অন্যত্র যক্ষা ও এইচআইভি রোগীদের মধ্যে অন্যাবশ্যক সংস্পর্শ প্রতিরোধ করার জন্য স্বাস্থ্য পরিচর্যা সুবিধাকে নতুন করে সাজাতে হবে। ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট যক্ষারোগ নির্ণয়ের জন্য দুটো নতুন দ্রুত পরীক্ষার কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হচ্ছে ৪০ হাজার রোগীর উপর মাঠ পর্যায়ে। এই পরীক্ষা করার পর চিকিৎসার ফলাফলে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে কিনা তাও দেখা হবে। জেনেভায় অবস্থিত ‘ইনোভেটিভ নিউ ডায়াগনোস্টিকস্’ জন্য ফাউন্ডেশনের পরিচালনা আরও ৬০ হাজার রোগীর পরীক্ষা সম্পন্ন করা হবে।
পরীক্ষামূলক আরও ২০টি ওষুধের কার্যকারিতা ও পরীক্ষা করা হচ্ছে। এখন দেখার অপেক্ষা, কি হয়!
লেখকঃ অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
২৫শে নভেম্বর ২০০৭, দৈনিক ইত্তেফাক
Leave a Reply