বিষন্নতা আমাদের জীবন বিষিয়ে তোলে। অকারণে সৃষ্টি হওয়া বিষন্নতা বা তুচ্ছ কারণে অতিরিক্ত বিষাদময়তার কারণে নিজেকে মনে হতে পারে অযোগ্য, অকেজো, সহায়হীন, আশাহীন, সম্পূর্ণ ফুরিয়ে যাওয়া সব হারানো এক মানুষ। নানা রকম নেতিবাচক চিন্তা, ভগ্নহৃদয় আর উদ্যমহীনতার সঙ্গে যোগ হয় ভগ্নস্বাস্থ্য; মৃতুচিন্তা পেয়ে বসে নিজেকে, কখনোবা আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে ওঠে তীব্র বিষাদগ্রস্ত ব্যক্তি। চিকিৎসকের সাহায্যে, ওষুধ সেবনে, পরিবার ও বন্ধুদের সহায়তায় আর সাইকোথেরাপির মাধ্যমে বিষন্নতা দূর করা যায়। দৈনন্দিন জীবনে কয়েকটি বিষয় মেনে চললে বিষণ্ন ব্যক্তি ফিরে পেতে পারে স্বাভাবিক জীবন।
যারা কমবেশি বিষন্ন ভোগে তাদের জন্য কয়েকটি টিপস
- যদি বিষন্নতার লক্ষণ নিজের মধ্যে দেখেন, তাহলে নির্ভরযোগ্য বন্ধু, স্বজনকে বিষয়টি জানান। যদি অন্য কেউ আপনার মধ্যে বিষন্নতার লক্ষণ খুঁজে পায়, তবে অযথা তার দিকে আক্রমণাত্মক মনোভাব দেখাবেন না-তার পর্যবেক্ষণকে গুরুত্বের সঙ্গে নিন এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
- বিষন্ন অবস্থায় এমন কোনো লক্ষ্য স্থির করবেন না, যেটার বাস্তবায়নে অতিরিক্ত দায়িত্ব নিতে হয়।
- নিজের কাজটিকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে ফেলুন, কোন অংশটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা নির্ণয় করুন এবং গুরুত্বের মাত্রা অনুযায়ী জরুরি কাজটি আগে করে ফেলুন।
- নিজের কাছে খুব বেশি কিছু আশা করবেন না। মনে রাখবেন আস্তে আস্তে আপনি সবই করতে পারবেন। নিজেকে সময় দিন। নিজের কাছে খুব বেশি আশা করলে আশাভঙ্গের বেদনায় আরও বেশি বিষাদগ্রস্ত হবেন।
- স্বজন, বন্ধু আর সহকর্মীদের সঙ্গে সময় কাটান।
- নতুন বন্ধু তৈরি করুন। একা একা সময় কাটাবেন না।
- যেসব কাজ করতে আপনার ভালো লাগে, যাতে আপনি আনন্দ পান সেগুলোই করুন। জোর করে নিরানন্দ কাজে নিজেকে নিয়োগ করবেন না।
- শরীরের সাধারণ যত্ন নিন, নিয়মিত গোসল করুন, নখ কাটুন, দাঁতের যত্ন নিন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক পরুন।
- প্রতিদিন হালকা ব্যায়াম করুন। ফুটবল, টেনিস বা ক্রিকেটের মতো খেলায় নিয়মিত অংশ নিতে পারেন।
- সামাজিক বা সাংস্কৃতিক যেকোনো কর্মকাণ্ডে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন।
- ভালো বোধ করার জন্য নিজেকে সময় দিন। তাড়াহুড়ো করবেন না।
- বিষন্ন অবস্থায় জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত-যেমন বিয়ে করা বা না করা, বিবাহবিচ্ছেদ ঘটানো, নতুন চাকরি নেওয়া বা চাকরি ছেড়ে দেওয়া, জমি বা বাড়ি বিক্রি করা ইত্যাদি। প্রয়োজনে এসব বিষয় সাময়িক স্থগিত করুন। চিকিৎসক এবং নির্ভর করতে পারেন, এমন স্বজন বা বন্ধুর সঙ্গে পরামর্শ করুন।
- তুড়ি মেরে নিজের বিষন্নতাকে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন না, সময় নিয়ে বিষন্নতা দূর করুন। ‘কেন আমি বিষন্ন’-এটা ভেবে নিজেকে দায়ী করবেন না। মনে রাখবেন বিষন্নতা দূর করা কঠিন বিষয় নয়, ধৈর্য ধরে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলুন।
- নিজের ভেতরকার নেতিবাচক চিন্তাগুলোকে প্রশ্রয় দেবেন না, এগুলো বিষন্নতার অংশ-এগুলো বিষন্নতার সঙ্গে সঙ্গে দূর হয়ে যাবে।
- ইতিবাচক চিন্তা নেতিবাচক চিন্তাকে দূর করে। তাই ইতিবাচক চিন্তা ও পরিকল্পনা করুন।
- মৃতুচিন্তা আর আত্মহত্যার প্রবণতা থাকলে চেষ্টা করুন সব সময় স্বজন ও বন্ধুদের সঙ্গে থাকতে। মৃতুর কারণ ঘটাতে পারে এমন বস্তু (ছুরি, বঁটি, ওষুধ, দড়ি, ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন ইত্যাদি) থেকে দূরে থাকুন।
- চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলুন। নিজে নিজে ওষুধের মাত্রা পরিবর্তন করবেন না, নতুন ওষুধ যোগ করবেন না, ওষুধ বন্ধ করে দেবেন না। হঠাৎ করে বিষন্নতারোধী ওষুধ বন্ধ করে দেওয়ার ফল মারাত্মক। চিকিৎসকের নির্দেশমতো ওষুধ বন্ধ করতে পারেন।
বিষন্ন রোগীর স্বজন-বন্ধুদের যা জানা প্রয়োজন
বিষন্নতা এক ধরনের মানসিক অসুস্থতা। এ সময় রোগীর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন স্বজন ও বন্ধুদের সহায়তা। বিষন্নতার রোগীকে দূরে ঠেলে না দিয়ে তাঁর সুস্থতার জন্য করার আছে অনেক কিছু। এ বিষয়ে যে বিষয়গুলো বেশি মনে রাখতে হবে তা হলো-
- আপনার কোনো নিকটজনের মধ্যে বিষন্নতার লক্ষণ দেখা গেলে এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলুন, বিষন্নতার কারণ জানার চেষ্টা করুন। তাঁকে কোনো রকম জোর না করে বুঝিয়ে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে চলুন।
- মানসিক চিকিৎসকের কাছে নিজের স্বজন-বন্ধুকে নিয়ে যেতে অযথা বিব্রত বা ইতস্তত করবেন না। মনে রাখবেন, শুরুতে চিকিৎসকের পরামর্শ নিলে রোগীর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
- চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে রোগী ওষুধ খাচ্ছে কি না এবং চিকিৎসকের নিষেধ মেনে অ্যালকোহল খাওয়া (যদি খেয়ে থাকেন) বন্ধ করেছেন কি না। চিকিৎসকের উপদেশ মেনে চলার বিষয়ে রোগীকে সর্বতোভাবে উৎসাহ দিতে হবে।
- বিষন্ন রোগীকে মানসিকভাবে ভরসা দিন, তাঁর সঙ্গে কথা বলুন, তাঁকে কথা বলতে দিন। তাঁর কোনো আচরণে বিরক্ত হবেন না। তাঁকে বোঝার চেষ্টা করুন, উৎসাহ দিন ও ভালোবাসুন। তাঁকে আশা দিন। তবে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তাঁর কাছ থেকে খুব বেশি কিছু আশা করবেন না।
- তাঁর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করুন। কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণের জন্য তাঁকে বকাবকি বা শারীরিক নির্যাতন করবেন না। তাঁকে অবজ্ঞা করবেন না।
- আত্মহত্যা বা মৃতুসংক্রান্ত তাঁর যেকোনো মন্তব্য গুরুত্বের সঙ্গে নিন। এ বিষয়ে যথাযথ প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা নিন। প্রয়োজনে চিকিৎসককে জানান। রোগী নিজের ক্ষতি করতে পারে, আত্মহত্যা করতে পারে এমন কোনো বিপজ্জনক বস্তু রোগীর ধারেকাছে রাখবেন না। এমনকি চিকিৎসকের দেওয়া বিষণ্নতারোধী ওষুধগুলোও একসঙ্গে বেশি পরিমাণে রোগীর হাতের কাছে রাখবেন না। এ ধরনের প্রবণতাসম্পন্ন রোগীকে একা থাকতে দেবেন না।
- রোগীকে সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে উৎসাহিত করুন। প্রয়োজনে সঙ্গে করে নিয়ে যান। খেলাধুলা, ব্যায়াম ইত্যাদিতে রোগীর অংশগ্রহণে সহায়তা করুন।
- অনেকের ভুল ধারণা আছে, যেকোনো মানসিক অসুস্থতার জন্য রোগীকে বিয়ে দিয়ে দিলে বা পড়ালেখা বা চাকরির জন্য বিদেশে পাঠিয়ে দিলে তিনি সুস্থ হয়ে যাবেন-এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ কখনোই করবেন না। পরিপূর্ণ সুস্থতার আগে জীবনের যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত (বিয়ে, চাকরি, ডিভোর্স ইত্যাদি) নেওয়া থেকে রোগীকে বিরত রাখুন।
- বিষন্নতার চিকিৎসার জন্য চিকিৎসক ও রোগী দুজনকেই সময় দিন, হুট করে বিষন্নতা ভালো হয়ে যাবে এমনটা আশা করবেন না। ধৈর্য ধরুন। অনেক সময় দেখা যায়, কেবল রোগীর স্বজনদের অস্থিরতা ও অধৈর্যের কারণে চিকিৎসা বিঘ্নিত হয়।
চিকিৎসক, রোগীর স্বজন, বন্ধুসহ সবার সদিচ্ছায় বিষন্নতায় আক্রান্ত রোগী ফিরে পেতে পারে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবন।
লেখকঃ ডা· আহমেদ হেলাল
উৎসঃ দৈনিক প্রথম আলো, ৩১ অক্টোবর ২০০৭
Leave a Reply