হেপাটাইটিস সি একটি মারাত্মক লিভার অসুখ। বিশ্বজুড়ে প্রায় ২০ কোটি লোক হেপাটাইটিস সি রোগে আক্রান্ত। বিশ্বের অনেক দেশেই মোট জনসংখ্যার শতকরা ০.৫-৩ ভাগ লোক এই রোগে আক্রান্ত। একিউট হেপাটাইটিস সি আক্রান্ত রোগীদের ৮৫ ভাগ পর্যন্ত রোগীর দেহে এ জীবাণু থেকে যায়। পরিণামে রোগী ক্রনিক হেপাটাইটিস সি রোগে ভোগেন। লিভার সিরোসিস, লিভার ফেলিউর, রক্ত বমি, পেটে পানি জমা এবং লিভার ক্যান্সার রোগগুলো এ রোগের দীর্ঘ মেয়াদী ফলশ্রুতি। পরিমাণে হেপাটাইটিস বি এর থেকে অনেক কম হলেও ক্রমিক হেপাটাইটিস সি-এ আনুমানিক ১০-১৫ লক্ষ বাংলাদেশী আক্রান্ত। ব্যক্তিগত প্রাকটিসের অভিজ্ঞতার আলোকে মনে হচ্ছে আমাদের সমাজে এ রোগগুলোর অস্তিত্ব একেবারে নগণ্য নয়। হেপাটাইটিস বি সম্বন্ধে জনগণ ও চিকিৎসকদের মধ্যে বেশ সচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হেপাটাইটিস সি সম্বন্ধে জনগণ তো দূরের কথা অনেক চিকিৎসকেরও তেমন কোনো ধারণা নেই। যার ফলে এই রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসাও ঠিকমত হচ্ছে না।
হেপাটাইটিস সি এর চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য হলো রক্ত থেকে এই জীবাণু নষ্ট করা এবং একই সাথে লিভারের ক্ষতকে সারিয়ে তোলা, লিভারের ফাইব্রাস টিস্যু জমা প্রতিহত করা এবং সর্বোপরি লিভার সিরোসিস ও তার মারাত্মক প্রতিক্রিয়াগুলোকে প্রতিহত করা বা মন্থর করে দীর্ঘ জীবন লাভ করা। বেশ কয়েকটি ঔষধ ক্রমিক হেপাটাইটিস সি এর চিকিৎসায় নিয়মিত ও ব্যাপক ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে পেগ ইন্টারফেরন ও রাইবাভাইরিন উল্লেখযোগ্য। অন্যান্য কিছু নতুন ঔষধ এখনও গবেষণা পর্যায়ে আছে যেগুলোর প্রয়োগ ও কার্যক্ষমতা সীমাবদ্ধ।
হেপাটাইটিস সি রোগের চিকিৎসার পদযাত্রা শুরু হয় নব্বই দশকের প্রথম দিকে। স্টান্ডার্ড ইন্টারফেরন ইনজেকশন দিয়ে শুরু হয় চিকিৎসা। এসময়ে শতকরা ৫-১৫ ভাগ রোগী চিকিৎসায় দীর্ঘমেয়াদী ভাইরাস মুক্ত হত। লিভার মেডিসিনে উচ্চতর ডিগ্রী করার সময় এর প্রমাণ পেয়েছি, অস্ট্রেলিয়ার ৪৫৫ জন ক্রমিক হেপাটাইটিস সি রোগের ইন্টারফেরন চিকিৎসার ফল বিশ্লেষণ করে। পরবর্তীতে রাইবাভাইরিন ক্যাপসুল সংমিশ্রণে চিকিৎসা পদ্ধতিতে ভাইরাস মুক্তির সম্ভবনা শতকরা ৪০-৫০ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের নিরলস চেষ্টায় নতুন ধরনের ইন্টারফেরন হেপাটাইটিস সি রোগের চিকিৎসা পদ্ধতিতে যুক্ত হলেও পেগ ইন্টারফেরন চিকিৎসা ব্যাপকভাবে চালু হয়েছে। নতুন পদ্ধতিতে পেগ ইন্টারফেরন ও রাইবাভাইরিন মিশ্রিত চিকিৎসা আক্রান্ত রোগীদের ভাল হওয়ার সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এই চিকিৎসার ফলে ৮০ ভাগ ও তদুর্ধ্ব রোগী দীর্ঘ মেয়াদী ভাবে ভাইরাস মুক্ত হতে পারেন। তবে ইন্টাফেরন চিকিৎসা কার্যকর হওয়া নির্ভর করে চিকিৎসা পদ্ধতি, সি ভাইরাসের জেনোটাইপ, রক্তে সি ভাইরাসের মাত্রা, আক্রান্ত লিভারের ফাইর্রাস টিস্যু জমার স্তর, মদ্যপানে ও অন্যান্য ভাইরাসের উপস্থিতি, লিভারে চর্বি ও আয়রন জমাসহ বিভিন্ন কারণের উপর। যেমন- হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের জেনোটাইপ-১ দ্বারা আক্রান্ত ও লিভার সিরোসিস রোগীদের দীর্ঘ মেয়াদী ভাইরাস মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা বহুলাংশে কম। তবে উপরোক্ত কারণগুলো উপস্থিত না থাকলেও চিকিৎসা চলাকালীন ১২ ও ২৪ সপ্তাহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই সময়ের মধ্যে রক্তের হেপাটাইটিস সি ভাইরাস একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ লেভেল নেমে আসার উপর নির্ভর করে দীর্ঘ মেয়াদী কোনো রোগীর ভাল হওয়ার সম্ভবনা। এতদসত্ত্বেও হেপাটাইটিস সি চিকিৎসা আগের তুলনায় এখন অনেক ফলপ্রসূ। চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়া সত্ত্বেও আধুনিক চিকিৎসাটি হেপাটাইটিস বি রোগের চিকিৎসার চেয়ে অনেক কার্যকর।
আধুনিক এসব চিকিৎসা প্রয়োগে যারা ভাইরাস মুক্ত হয় তাদের ক্ষেত্রে উল্লিখিত উদ্দেশ্যগুলো কার্যকর হয় বলে স্টোর লিভার ইউনিটে লিভার মেডিসিনে পিএইচডি করার সময় আমি ৪৫৫ জন হেপাটাইটিস সি রোগীর উপর ইন্টারফেরন চিকিৎসার বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণা করে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, ইন্টারফেরন চিকিৎসা ফলপ্রসূ হলে হেপাটাইটিস সি রোগীদের লিভার ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক কমে যায়। অনুরূপ ফল দেখেছেন অন্য গবেষকরাও।
হেপাটাইটিস সি এর চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল বিশেষ করে পেগ ইন্টারফেরন ও রাইবাভাইরিন মিশ্রিত চিকিৎসার মেয়াদটি উত্তীর্ণ করতে হয়। সিরোসিসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য এই চিকিৎসা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। যেহেতু চিকিৎসাটি সব রোগীকে ভাল করেনা এবং অত্যন্ত ব্যয়বহুল সেজন্য চিকিৎসা শুরু করার আগে রোগীকে রোগ সংক্রান্ত বিষয়ের ব্যাপক বিশ্লেষণ করতে হবে। উন্নত দেশগুলোতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শুধুমাত্র লিভার বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে এগুলো ব্যবহৃত হয়। যেটা আমাদের দেশের জন্য প্রযোজ্য হওয়া উচিৎ। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন যে, এলোপাতাড়ি ঔষধ ব্যবহার রোগীর আর্থিক ও শারীরিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। সৌভাগ্যের ব্যাপার এই যে, হেপাটাইটিস সি রোগ চিকিৎসার প্রচলিত সব ঔষধ বর্তমানে বাংলাদেশে পাওয়া যাচ্ছে।
অধ্যাপক ডা. মাহবুব এইচ খান
লিভার বিশেষজ্ঞ, ট্রমা সেন্টার, শ্যামলী, ঢাকা,
মোবাইলঃ ০১৭১১৮৫৪৮৩৮, ০১৯১১৩৫৬২৯৮।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, আগস্ট ০১, ২০০৯
জানতে চাই
বেশ্যাদের সাথে শুধু মাত্র আলিঙ্গন করলে কি এই রোগ বা অন্য *যৌ*ন* রোগ হতে পারে?
Bangla Health
না।