সম্প্রতি অ্যাপোলো হাসপাতাল ঢাকার কার্ডিওথোরাসিক সার্জারি বিভাগে একটি জটিল জন্মগত হৃদরোগে আক্রান্ত কয়েকটি নবজাতকের সফল অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়। এসব শিশুর বয়স দুই-চার মাস এবং ওজন তিন থেকে সাড়ে চার কেজি। রোগটি হচ্ছে ট্রান্সপোজিশন অব গ্রেট আর্টারিজ (টিজিএ), যার চিকিৎসা হলো মহাধমনির স্থানান্তর (আর্টারিয়াল সুইচ অপারেশন)।
স্বাভাবিকভাবে আমাদের শরীরের সব দূষিত রক্ত, হৃৎপিণ্ডের ডান দিক হয়ে ফুসফুসের ধমনির মাধ্যমে ফুসফুসে পরিবাহিত হয় এবং শোধিত হওয়ার মাধ্যমে এ রক্ত হৃৎপিণ্ডের বাঁ দিক হয়ে মহাধমনির মাধ্যমে সারা শরীরে সঞ্চালিত হয়। কিন্তু এ রোগে বিষয়টি হয় পুরোপুরি উল্টো। অর্থাৎ মহাধমনি বাঁ দিকের পরিবর্তে হৃৎপিণ্ডের ডান দিক থেকে ওঠে এবং ফুসফুসের ধমনি হৃৎপিণ্ডের বাঁ দিক থেকে ওঠে। ফলে হৃৎপিণ্ডের ডান দিক থেকে ওঠা মহাধমনির মাধ্যমে দূষিত রক্ত পুনরায় সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। আর হৃৎপিণ্ডের বাঁ দিক থেকে ওঠা ফুসফুসের ধমনির মাধ্যমে রক্ত ফুসফুসে গিয়ে পুনরায় বাঁ দিকে চক্রাকারে আবর্তিত হতে থাকে। যদি এ দুই ধরনের রক্তপ্রবাহের মিশ্রণের কোনো সুযোগ না থাকে, তাহলে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।
সাধারণত হৃৎপিণ্ডের দুই প্রকোষ্ঠের মধ্যে যে পর্দা থাকে, এর মধ্যে ছিদ্র থাকে, যা দিয়ে কিছুটা বিশুদ্ধ রক্ত মিশ্রিত হয়, আর এর মাধ্যমেই কোনোরকমে বেঁচে থাকা যায়। যদি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে এটি সংশোধন করা না হয়, তাহলে এ ধরনের ৯০ শতাংশ রোগী জন্মের এক বছরের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করে।
টিজিএ রোগীদের মহাধমনি হৃৎপিণ্ডের ডান দিক থেকে উৎপন্নের ফলে ডান দিকের প্রকোষ্ঠ দিনে দিনে পুরু বা মোটা হতে থাকে, আর বাঁ দিকের হৃৎপিণ্ডের শক্তিশালী প্রকোষ্ঠ হয়ে ওঠে দুর্বল থেকে দুর্বলতর। এর ফলে অস্ত্রোপচার করতে দেরি হলে এর সাফল্যের হার কমে যেতে পারে। এ রোগে আক্রান্ত শিশুরা সাধারণত নীলাভ বা কালচে বর্ণ ধারণ করে, বিশেষত জিহ্বা, নাকের ডগা, হাত ও পায়ের আঙ্গুল বেশি নীলচে হয়। অনেক সময় এরা খুবই শ্বাসকষ্টে ভোগে।
দুই মাস বয়সী যে শিশুটি অ্যাপোলো হাসপাতাল ঢাকায় এসেছিল, সে খুবই শ্বাসকষ্টে ভুগছিল। সারা শরীর নীল হয়ে গিয়েছিল তার। শরীরে অক্সিজেনের মাত্রাও ছিল খুবই কম। প্রথমেই তাকে নিবিড় পরিচর্যা বিভাগে (আইসিইউ) ভর্তি করা হয়। নিবিড়ভাবে ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তাকে পর্যবেক্ষণ করা হয়।
প্রাথমিকভাবে তাকে সুস্থ করে তোলার পরই তার অস্ত্রোপচার করা হয়। অস্ত্রোপচারের ১০ দিন পর সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে সে বাড়ি ফিরে যায়। অন্য দুটি শিশুও শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি হয়েছিল। প্রাথমিক ব্যবস্থা নেওয়ার পর তাদেরও সফল অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়।
অস্ত্রোপচারের পর এসব রোগীর জন্য বিশেষ যত্নের প্রয়োজন হয়।
দক্ষ ও অভিজ্ঞ নিবিড় পরিচর্যা বিভাগ এ অস্ত্রোপচারের সাফল্যের মূলমন্ত্র। দীর্ঘ সময় রোগীকে কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্রের প্রভাবে রাখতে হয়। শিশুর জন্য অ্যাপোলো হাসপাতালে তিন দিন পর্যন্ত কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্রের প্রয়োজন হয়েছিল।
পাঁচ-ছয় দিনের মধ্যে এ শিশুদের নিবিড় পরিচর্যা বিভাগ থেকে সাধারণ বিভাগে স্থানান্তর করা হয় এবং অস্ত্রোপচারের ১০-১২ দিনের মধ্যেই এ শিশুরা সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করে। অ্যাপোলো হাসপাতাল ঢাকার প্রধান কার্ডিয়াক সার্জন আতোয়ার সন্দ্বীপ বলেন, যথাসময়ে (দুই থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে) এ অস্ত্রোপচার করা হলে, অস্ত্রোপচারের পর রোগী তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যায় এবং সে ক্ষেত্রে হাসপাতালে থাকার সময়ও অনেক কমে আসে।
অস্ত্রোপচারটি বেশ চ্যালেঞ্জিং। পর পর তিনটি নবজাতকের জটিল জন্মগত হৃদরোগের সফল অস্ত্রোপচার হলো অ্যাপোলো হাসপাতাল ঢাকায়। এ অস্ত্রোপচারের সাফল্য নির্ভর করে অভিজ্ঞ কার্ডিয়াক সার্জন, অভিজ্ঞ অ্যানেসথেসিয়া বিশেষজ্ঞ এবং দক্ষ ও অভিজ্ঞ সেবিকাদের ওপর। জন্মের পরপরই রোগ নির্ণয় হলে এবং যথাসময়ে অস্ত্রোপচার হলে টিজিএ নামক এ জন্মগত হৃদরোগ ভালো হয়ে যায়।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ২২, ২০০৯
Leave a Reply