শিক্ষিত জনগোষ্ঠী মাত্রই জানেন ডায়াবেটিস একটি হরমোন (ইনসুলিন) এর অভাবজনিত রোগ, এই রোগে দেহের যেসব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলি আক্রান্ত হয় চোখ তার মধ্যে অন্যতম। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এপিডেমিওলজিক স্টাডিতে দেখা গেছে শতকরা ৫০-৫৫ ভাগ ডায়াবেটিক রোগী শুধুমাত্র ডায়াবেটিসের জন্য রেটিনা আক্রান্ত হয়ে দৃষ্টি স্বল্পতায় ভুগছেন। এটা অবশ্য নির্ভর করে রোগী কতদিন ধরে ডায়াবেটিস এ আক্রান্ত। যত দীর্ঘ দিন ধরে ডায়াবেটিস (বহুমূত্র) রোগে আক্রান্ত হয় ততই চোখ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
চোখের গুরুত্বপূর্ণ অংশ রেটিনা। এটা একটা সংবেদনশীল পর্দা যা চক্ষু গোলকের ভেতরের দিকে থাকে, যার উপর আমরা যা দেখি তার ছবি প্রতিফলিত হয়। অতঃপর তা বিভিন্ন নিউরো কেমিকেল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মুহূর্তে মস্তিষ্কে পৌঁছে এবং আমরা, আমাদের চারপাশের ছবি দেখি। অনেকে ভাবেন ছানি অথবা অস্বচ্ছ লেন্স এর জন্যই শুধু আমাদের দৃষ্টিশক্তি ব্যাহত হয়। এ ধারণা ঠিক না। স্বচ্ছ লেন্স আলোকে রেটিনার উপর প্রতিফলিত করতে সাহায্য করে মাত্র।
রেটিনা মূল সংবেদনশীল স্নায়ু পর্দা যা প্রতিফলিত ছবিটিকে প্রক্রিয়াজাত করে দৃশ্যমান করে। তাই যখন রেটিনা আক্রান্ত হয়, তখন স্বচ্ছ লেন্স থাকার পর অস্বচ্ছ লেন্স (ছানি) সরিয়ে স্বচ্ছ কৃত্রিম লেন্স (আইওএল) প্রতিস্থাপনের পরও ব্যক্তি দেখতে পারেনা।
ডায়াবেটিসে রেটিনা যেভাবে আক্রান্ত হয়
ডায়াবেটিসে রেটিনায় সুক্ষ রক্তনালীগুলো বন্ধ হয়ে আসে। এতে একরকম রক্তশূন্যতা অথবা অক্সিজেন স্বল্পতা দেখা দেয়। এর ফলে কেন্দ্রীয় রেটিনাতে পানি ও তৈল জাতীয় পদার্থ জমে ফুলে যায় অথবা রেটিনার বিভিন্ন স্থানে নতুন রক্তনালীর সৃষ্টি হয়, রেটিনায় অক্সিজেন সরবরাহ বাড়ানোর জন্য। এসব রক্তনালী স্বাভাবিক রক্তনালীর মত পরিপক্ক হয় না। এসব নতুন অপরিপক্ক রক্তনালী খুব সহজেই ভঙ্গুর হয়। এতে করে চোখের ভেতর রক্তক্ষরণ হয় ফলে দৃষ্টিশক্তি একেবারেই চলে যায়।
ডায়াবেটিস জনিত অন্ধত্ব প্রতিরোধের উপায়
এসব সমস্যা প্রতিরোধে অথবা প্রতিকারের জন্য বিজ্ঞানীগণ দীর্ঘকাল গবেষণা করে এসেছেন এবং কিছু কিছু কার্যকরী চিকিৎসা পদ্ধতিও উদ্ভব হয়েছে। যাতে করে কর্মক্ষম দৃষ্টিকে দীর্ঘদিন ধরে রাখা যায়, যদিও ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি একেবারে ভাল হয়ে যায় না।
এইসব চিকিৎসার ফলে
০ যেটুকু দৃষ্টি চলে গিয়েছে তার কিছুটা ফেরত আসতে পারে।
০ প্রতিনিয়ত রেটিনা আক্রান্ত হওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ অথবা ধীর হবে।
০ দৃষ্টি হারানোর গতি মন্থর হবে যাতে কর্মক্ষম দৃষ্টি অনেকদিন পর্যন্ত ধরে রাখা যায়।
০ পরবর্তী জটিলতা দেখা দিবে না।
০ স্থায়ী অন্ধত্ব প্রতিরোধ হবে।
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথিকে বলা হয় চোখ অন্ধকারী রোগ। কিন্তু সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ কর্মক্ষম দৃষ্টিকে অনেক দীর্ঘায়িত করতে পারে এবং পরবর্তী জটিলতা থেকে মুক্ত করতে পারে। আর অবহেলা, অসচেতনতা ডায়াবেটিক রোটিনোপ্যাথিকে আরো জটিল করে এমন অবস্থায় নিয়ে যায় যা আর চিকিৎসাযোগ্য থাকে না। ফলে স্থায়ী অন্ধত্ব বরণ করতে হয়। তাই ডায়াবেটিস রোগীর সচেতনতা এবং সাবধানতার কোনো বিকল্প নেই।
ডা. জেসমিন আহমদ
লেখিকা: চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও সহকারী অধ্যাপক, চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, জুলাই ১৮, ২০০৯
Leave a Reply