রক্তপরিবাহী নালীর ভেতর দিয়ে রক্ত যখন চলাচল করে, তখন পরিবহন নালীর গায়ে যে চাপ পড়ে, তাকেই রক্তচাপ বলা হয়। মৃত মানুষের রক্তে চাপ থাকে না, তাই বেঁচে থাকার জন্য রক্তচাপ থাকা অবশ্যই দরকার। কিন্তু এই রক্তচাপ যখন স্বাভাবিক মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তখন তা মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এখন কথা হলো, একজন মানুষের স্বাভাবিক রক্তচাপ কত হওয়া দরকার। রক্তচাপ মাপার ক্ষেত্রে বয়স, শারীরিক মিলন, ওষুধ-এগুলো গুরুত্বপুর্ণ। সাধারণ অর্থে বলা হয়, একজন স্বাভাবিক পুর্ণবয়স্ক মানুষের রক্তচাপ ১২০/৭০ মিলিমিটার অব মারকারি হওয়া উচিত। কিন্তু এর ভেতর একটা বিরাট ফাঁক রয়ে গেছে। রক্তচাপ দুটি অংক দিয়ে প্রকাশ করা হয়। প্রথমটি সিষ্টোলিক, অপরটি ডায়াষ্টলিক। হৃৎপিন্ড যখন সংকুচিত হয় ধমনীতে তখন যে চাপ হয় তাকে বলা হয় সিষ্টোলিক প্রেসার আর হৃদপিন্ড প্রসারণের সময় ধমনীতে তখন যে চাপ থাকে তাকে বলা হয় ডায়াষ্টলিক প্রেসার। একজন সুস্হ মানুষের সিষ্টোলিক প্রেসার ৮০ থেকে ১৬০ পর্যন্ত এবং ডায়াষ্টলিক প্রেসার ৬০ থেকে ৮০ পর্যন্ত হতে পারে। মানুষের রক্তচাপ কখনো স্হির থাকে না। ওঠানামা স্বাভাবিক। তবে একজন প্রাপ্তবয়স্ক লোককে উচ্চ রক্তচাপ আক্রান্ত বলা যাবে তখনই, যখন তার রক্তচাপ ১৬০/৮৫ মিলিমিটার অব মারকারি ছাড়িয়ে যায়। একবার ব্লাডপ্রেসার মেপে কখনো উচ্চ রক্তচাপ নির্ণয় করা উচিত নয়। কমপক্ষে পরপর তিনদিন প্রশান্ত মনে রক্তচাপ মাপার পর বলা যায় কে উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। দুশ্চিন্তা, সিগারেট, ব্যায়াম, অসহ্য গরম-এগুলো সাময়িকভাবে রক্তচাপ বৃদ্ধি করে। কোনো কোনো ডাক্তারের মতে, যাদের রক্তচাপ সবসময় ১৪০/৮০ মিলিমিটার অব মারকারির উপরে থাকে তাদের নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করা উচিত। রক্তচাপ হন্তারক ব্যাধি। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, হার্ট অ্যাটাক এবং দুটি কিডনিই এ রোগে অকেজো হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সময়মত নিয়মিত ওষুধ খেলে এ রোগের জটিলতা কমে যায়। বয়স যত বাড়তে থাকে, রক্তচাপ ততই বৃদ্ধি পেতে থাকে। এটা স্বাভাবিক। কারণ বয়স বাড়ার সঙ্গে ধমনীর প্রসারণ ক্ষমতা কমে যায়। উচ্চ রক্তচাপ হলে যে ক’টি পরীক্ষা অত্যন্ত দরকারি, সেগুলো হলো প্রস্রাব পরীক্ষা, ইসিজি, বুকের এক্সরে, রক্তে সুগার, ইউরিয়া ও কোলষ্টেরলের পরিমাণ মেপে নেয়া।
উক্ত রক্তচাপে আক্রান্ত হলে কী করবেন? অতিরিক্ত লবণ খাওয়া বাদ দিতে হবে। রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে হবে। নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। সিগারেট ছাড়তে হবে। দুশ্চিন্তা যত কম করা যায় ততই ভালো। ডায়াবেটিস কন্ট্রোলে রাখতে হবে। কোলষ্টেরল যত কম করা যায় ততই ভালো। ডায়াবেটিস কন্ট্রোলে রাখতে হবে। কোলষ্টেরল যাতে না বাড়ে, সেজন্য ডিম, বাটার, পনির, খাসির মাংস, গরুর মাংস বাদ দেয়া আবশ্যক। শরীরে মেদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রক্তচাপও বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাই ওজন কমানো অত্যন্ত দরকারি। শেষ যে জিনিসটি করতে হবে, সেটি হলো নিয়মিত ওষুধ খাওয়া। আপনি যতদিন পৃথিবীতে থাকবেন, হাইপারটেনশনও আপনার সঙ্গে থাকবে। সুযোগ পেলেই এটা আপনার সর্বনাশ করবে। তাই শত্রুকে তাড়াতে না পারলেও অন্তত দমিয়ে রাখুন। ব্লাডপ্রেসারের জন্য যে ক’টি ওষুধ সচরাচর ব্যবহূত হয়, সেগুলো হলো থায়াজাইড ডাই-ইউরেটিক, বিটা ব্লকার আলফা মিথাইল ডোপা নাইফিডিপিন, ক্যাপটোপ্রিল ইত্যাদি। কখনো কমপক্ষে ১০-১৫ দিন না দেখে নতুন ওষুধ বা ডোজ বাড়ানো উচিত নয়। আপনার কতটা ডোজ লাগবে তা নির্ণয় করবেন ডাক্তার। প্রেসার স্বাভাবিক হয়ে গেলেও ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কখনো ওষুধ বন্ধ করবেন না। যারা প্রপ্রানলল জাতীয় ওষুধ খান, তারা যদি হঠাৎ করে ওষুধ খাওয়া বন্ধ কর দেন তবে তা মারাত্মক হতে পারে। কখনো যদি রক্তচাপ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, তখন হাইড্রালাজিন, ডায়াজোক্সাইড, সোডিয়াম নাইট্রোপ্রোসাইড, ট্রাইমিথাফেন ইত্যাদি ওষুধ ব্যবহার করা হয়। এসব ওষুধ মুহুর্তে রক্তচাপ কমিয়ে আনতে পারে। উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত রোগীর যদি বমি বমি ভাব অথবা বমি হয়, বুকে ব্যথা হয় অথবা শ্বাসকষ্ট হয় তবে অবশ্যই তাকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। একবেলা ভাত না খেলে কিছুই হবে না; কিন্তু একবার ওষুধ না খেলে অনেক কিছু ঘটতে পারে।
হাইপারটেনশন মেয়েদের ক্ষেত্রে অন্তত তিনটি কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ। গর্ভধারণ, জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি এবং প্রি-একলাম্পশিয়ার জন্য। গর্ভবতী ও হাইপারটেনশন দুইভাবে হতে পারে। প্রথমত গর্ভবতী আগে থেকেই উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত এবং অপরটি গর্ভাবস্হায় প্রথম উচ্চ রক্তচাপ নির্ণয়। উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত মহিলা যদি গর্ভধারণ করতে চায় তবে ডাক্তারের সঙ্গে আগেই পরামর্শ করতে হবে। কারণ গর্ভাবস্হায় সব রক্তচাপের ওষুধ ব্যবহার করা যায় না। গর্ভাবস্হায় হাইপারটেনশনের সবচেয়ে নিরাপদ ওষুধ আলফা মিথাইল ডোপা। তবে অনেক ডাক্তার বলেন, দু-একটি বিটা ব্লকার, যেমন-এটিনলল গর্ভাবস্হায় ভ্রুণের কোনো ক্ষতি করে না। গর্ভসঞ্চারের আগে ওষুধ বদলাতে হতে পারে। জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার কারণ হতে পারে। তাই যাদের বয়স ৩৫-এর বেশি, যাদের বংশে হাইপারটেনশন আছে অথবা যারা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত, তাদের কখনো জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি খাওয়া উচিত নয়। প্রি-একলাম্পশিয়ার তিনটি প্রধান উপসর্গের একটি হাইপারটেনশন। অনেক মহিলার গর্ভাবস্হায় রক্তচাপ একটু বেশি থাকে। এর জন্য চিন্তার কোনো কারণ নেই। প্রসবের পর এদের রক্তচাপ আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। হাইড্রালাজিন দিয়েও গর্ভবতীর উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
লেখকঃ ডা. বরেন চক্রবর্তী
দৈনিক আমারদেশ পত্রিকায়, ১৮ নভেম্বর ২০০৭
Leave a Reply