ডায়াবেটিস নিয়ে গণসচেতনতা এখন অনেক বেড়েছে। শুধু ডায়াবেটিস রোগী নয়, সাধারণ মানুষ ডায়াবেটিস-সংক্রান্ত তথ্য ও আলোচনার প্রতি অধিক আগ্রহী হচ্ছে। এই প্রবণতার সুফল যেমন আছে, তেমনি কুফলও আছে। তথ্য ও আলোচনার জন্য অনেক সময় মানুষ যথাযথ নয় এমন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হয়। ফলে ভুল ও বিভ্রান্তিকর ধারণাও লাভ করে অনেকে। আসুন, জেনে নিই এ সম্পর্কে।
ডায়াবেটিস কী?
আমাদের শরীরে শর্করা বা চিনিজাতীয় খাবারের প্রয়োজনীয় বিপাক না হলে রক্তে অব্যবহৃত শর্করা বা চিনির পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। এ অবস্থাকে বলা হয় ডায়াবেটিস। প্রধানত দুটি কারণে এ রকম অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। শরীরে অগ্ন্যাশয় (প্যানক্রিয়াস) গ্রন্থিতে ইনসুলিন হরমোন নিঃসরণকারী বিটা সেলের পরিমাণ ব্যাপক হারে হ্রাস পাওয়া এবং বিটা সেল থেকে নিঃসৃত ইনসুলিন যদি কোষের ওপর সঠিকভাবে কাজ করতে না পারে। এ ক্ষেত্রে অগ্ন্যাশয় গ্রন্থিতে বিটা সেলের পরিমাণ শূন্যের কোঠায় পৌঁছলে তখন ইনসুলিন বাইরে থেকে নেওয়া (ইনজেকশনের মাধ্যমে) ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। এ ধরনের ডায়াবেটিসকে টাইপ-১ বা ইনসুলিননির্ভর ডায়াবেটিস বলে। অপরদিকে শরীর যখন ইনসুলিন তৈরি করতে পারে, অর্থাৎ সামান্য পরিমাণ বিটা সেল উপস্থিত থাকে কিন্তু শর্করার বিপাকের জন্য তা পর্যাপ্ত নয়, এ ধরনের ডায়াবেটিসকে টাইপ-২ ডায়াবেটিস বলে। এ ধরনের ডায়াবেটিস কিছু নির্দিষ্ট নিয়মকানুন মেনে চললে অর্থাৎ প্রাত্যহিক জীবনে সুনিয়ন্ত্রণ এলে ডায়াবেটিসও নিয়ন্ত্রণ থাকে।
ডায়াবেটিস দিন দিন যে প্রধান কয়েকটি জটিলতা তৈরি করে তা হলো, রক্তনালি ও হৃৎপিণ্ডের নানা রোগ, চোখের রোগ ও কিডনির জটিলতা। আজ হৃৎপিণ্ডের রোগ নিয়ে বলা হলো।
রক্তনালির প্রাচীরের পুরুত্ব বেড়ে যাওয়া (অ্যাথেরোসক্লেরোসিস)
শরীরে শর্করা বিপাকে গণ্ডগোল দেখা দিলে বাকি দুটি প্রধান খাদ্য উপাদান প্রোটিন বা চর্বিজাতীয় খাদ্যের বিপাকেও সমান গণ্ডগোল দেখা দেয়। এ কারণে শরীরে চর্বিজাতীয় খাবারের অনিয়ন্ত্রিত সঞ্চয় হয়ে থাকে। শরীরে বিভিন্ন স্থানে বিশেষত রক্তনালির প্রাচীরের বিভিন্ন স্তরে এভাবে চর্বি জমা হওয়ার ফলে রক্তনালির প্রাচীর পুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়। এই অস্বাভাবিক ঘটনাকে অ্যাথেরোসক্লেরোসিস। রক্তনালির প্রাচীর মোটা ও শক্ত হয়ে যাওয়ার ফলে নালির মধ্য দিয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণ রক্ত চলাচল বা পরিবহন ব্যাহত হয়ে থাকে। ফলে হৃৎপিণ্ডের মধ্যে শরীরের প্রধান অঙ্গ পর্যন্ত রক্ত থেকে বঞ্চিত হয়। হৃৎপিণ্ডে পর্যাপ্ত রক্ত না যাওয়ার ফলে নানা ধরনের মারাত্মক রোগ, যেমন-অ্যানজাইনা পেকটোরিস, হার্টঅ্যাটাক বা এমআই হতে পারে। এই দুটি রোগ থেকে মানুষের মৃত্যুও হতে পারে। ডায়াবেটিস অ্যাথেরোসক্লেরোসিস হওয়ার প্রধান কারণ, তবে একমাত্র কারণ নয়। সুতরাং অ্যানজাইনা বা হার্টঅ্যাটাক এড়ানোর জন্য ডায়াবেটিস কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে রক্তে শর্করার পরিমাণ নির্ণয় ছাড়াও বর্তমান একটি আধুনিক পরীক্ষা, রক্তের এইচবিএ১সি-এর পরিমাণ দেখা যেতে পারে। এই পরীক্ষাটির মাধ্যমে রক্তের দীর্ঘমেয়াদি শর্করা পরিমাণ জানা যেতে পারে। প্রতি তিন মাস পর পর এই পরীক্ষা করা যেতে পারে। রক্তের এইচবিএ১সি-এর পরিমাণ ৭ ভাগের নিচে থাকলে বোঝা যাবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
মনে রাখতে হবে, ডায়াবেটিস উচ্চ রক্তচাপের সঙ্গে যুক্ত হলে হার্টঅ্যাটাকসহ হৃদযন্ত্রের অন্যান্য জটিলতা বহুগুণ বেড়ে যায়। একটি সমীক্ষা না দিলেই নয়। সম্প্রতি জানা গেছে, এইচবিএ১সি শতকরা প্রতি ১ শতাংশ কমলে এমআই হওয়ার আশঙ্কা ১৪ শতাংশ কমে যায়। সঙ্গে সঙ্গে রক্তনালির অন্যান্য রোগও ৪৩ শতাংশ কমে যায়। অন্যদিকে কমার পরিবর্তে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে এইচবিএ১সি বাড়লে জটিলতাও সে হারে বাড়তে থাকে।
কী করতে হবে
কাজেই ডায়াবেটিসের প্রাত্যহিক মাত্রা ও জটিলতা সম্পর্কে খুব সজাগ হতে হবে।
–রক্তে চিনির পরিমাণ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে। যেমন- অভুক্ত অবস্থায় ৬ মিলিমোলের নিচে এবং খাওয়ার পরে থাকতে হবে ৮ মিলিমোলের নিচে। অন্যদিকে এইচবিএ১সি থাকতে হবে ৭ শতাংশের নিচে।
–রক্তচাপ যেন অবশ্যই ১৩০/৮০ এর নিচে থাকে।
— কোলেস্টেরল এলডিএল ১০০ মিলিগ্রাম/ডিএলের নিচে এবং এইচডিএল ৪০ (পুরুষের ক্ষেত্রে) এবং ৫০ (মেয়েদের ক্ষেত্রে) মিলিগ্রাম/ডিএলের ওপর থাকতে হবে। টাইগ্লিসারাইড যেন অবশ্যই ১৫০ মিলিগ্রাম/ডিএলের নিচে থাকে। কাজেই নিজে নিজে নিয়মিত ডায়াবেটিসের মাত্রা নিরূপণ করে অস্বাভাবিক কিছু মনে হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। অন্যদিক হৃৎপিণ্ডের অবস্থা জানার জন্য বছরে অন্তত দুবার হৃদরোগ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হবে।
ফজলে রাব্বী খান
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ১৫, ২০০৯
Leave a Reply