মাদকের অপব্যবহারের বড় শিকার হলো দেশের তরুণসমাজ। জ্ঞানের অভাবে, কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে অথবা বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে অনেকে মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ে, একসময় তারা হয়ে ওঠে মাদকাসক্ত।
২৬ জুন মাদকবিরোধী দিবস পালিত হয়েছে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও। মাদকাসক্তির মতো গুরুতর সমস্যার বিরুদ্ধে সবার একত্র হওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সেদিন।
কয়েক বছর ধরে মাদকাসক্তি এক গুরুতর হুমকির মুখোমুখি করেছে পৃথিবীকে, এর শেকড় সমাজের অনেক গভীরে ইতিমধ্যে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশেও মাদক সমস্যা প্রবল এবং মাদক পাচারকারীরা এ দেশেও শক্ত ভিত্তি স্থাপন করে চলেছে। মাদকনির্ভরতা ছড়িয়ে পড়েছে স্কুল ও কলেজগামী ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। নারী-পুরুষ উভয়ই এর শিকার। মাদকনির্ভর হয়ে পড়ছে শ্রমজীবী মানুষ, রিকশাচালক ও শ্রমিকশ্রেণীর লোকজনও। আবার উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তানেরাও।
বস্তুত মাদক চোরাচালান যারা করে এরা জঙ্গি সংগঠনকে অর্থসাহায্য দেয় এবং সমাজের নানা অপরাধমূলক কাজের জন্য অর্থ বিনিয়োগও করে। আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও মাদকনির্ভর লোক ও মাদক পাচারকারীদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। বিশ্বজুড়ে মাদকাসক্ত লোকজন বেশি ব্যবহার করে হেরোইন, গাঁজা ও নানা সিনথেটিক মাদক।
হেরোইন বেশির ভাগ মাদকনির্ভর লোকের পছন্দ, এর ধোঁয়া গ্রহণ করে আসক্ত হয়ে পড়ে এরা। এরপর হলো গাঁজা বা ক্যানাবিস। তরুণ ও শ্রমজীবী মানুষের বেশি পছন্দ গাঁজা। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে গাঁজা সেবনের অভ্যাস রয়েছে। সিগারেটের মধ্যে গাঁজা ভরে তা সেবন করে যুবক-যুবতীরা, মন ও শরীরে শিথিলতা আনার ইচ্ছায়।
এমফেটামাইন ও ইসটেসির মতো সিনথেটিক মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে তরুণ-তরুণীরা। এগুলো উদ্দীপক মাদক। এমফেটামাইন জাতীয় একটি মাদক হলো ‘ইয়াবা’। মাদক সমস্যা নিরসনে পৃথিবীর নানা দেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা গঠন করা হয়েছে। তবে নানা উৎস থেকে যে পরিসংখ্যান ও তথ্য পাওয়া যায়, এতে মনে হয় বেশির ভাগ দেশেই মাদকবিরোধী আইন প্রয়োগে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। গত কয়েক বছরে মাদকসংক্রান্ত অপরাধের জন্য কমসংখ্যক লোকই সাজা পেয়েছে।
এ বছর বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে (৭ এপ্রিল) মাদক ও অপরাধ-সম্পর্কিত জাতিসংঘ অফিস (ইউএনওডিসি) মাদকের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী অভিযান শুরু করেছিল। ইউএনওডিসির নির্বাহী পরিচালক অ্যান্টনিও মারিয়া কস্তা বলেন, ‘মাদক নিয়ন্ত্রণ কেবল নিরাপত্তা-সম্পর্কিত বিষয় নয়, স্বাস্থ্যেরও বিষয়। মাদকনির্ভরতা একটি ব্যাধি, একে প্রতিরোধ বা প্রয়োজনে এর চিকিৎসাও করতে হবে।’
ইউএনওডিসি অভিযানের ্লোগান-‘মাদক কি আপনার জীবন নিয়ন্ত্রণ করে?’-মূলত তরুণ-তরুণীদের উদ্দেশেই বলা হয়েছে। উদ্দেশ্য হলো, তাদের নিজের স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল দেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করা এবং নেশার ওষুধ গ্রহণ থেকে নিজেকে বিরত রাখার শক্তি অর্জনে অনুপ্রেরণা জোগানো। পৃথিবীজুড়ে ২০ কোটি লোক বছরে অন্তত একবার মাদক গ্রহণ করে। এর মধ্যে আড়াই কোটি লোককে মাদকনির্ভর বলা যায়। প্রতিবছর মাদক গ্রহণজনিত অসুখে মারা যায় দুই লাখ লোক।
আগেই বলেছি, তরুণেরাই মাদকের বেশি শিকার। সাধারণ জনগোষ্ঠীর তুলনায় তরুণদের মধ্যে মাদক ব্যবহার দ্বিগুণ বেশি, গাঁজা ব্যবহার তিন গুণ বেশি। জনাব কস্তা বলেন, স্বাস্থ্যকর ও পরিপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য কৌশল, তথ্য ও সুযোগ আরও বেশি সরবরাহ করা উচিত তরুণদের কাছে। দেশের স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর প্রকট বড় সমস্যা হিসেবে মাদকাসক্তিকে বিবেচনা করা উচিত সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবার।
বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশেও মাদক পাচারের শক্তিশালী গ্রুপ রয়েছে। আবার বাংলাদেশ এসব অবৈধ চোরাচালানের ট্রানজিট হিসেবেও অনেক দিন ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
মাদক পাচার চক্র বিভিন্ন সময় তাদের কর্মকৌশলও পরিবর্তন করে আসছে। রিপোর্ট পাওয়া যায় নাইজেরিয়ার মাদক ব্যবসায়ীরা ভারত থেকে মাদক পাচারের জন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নারীদের বাহক হিসেবে ব্যবহার করে। যেসব নারী বিভিন্ন অপরাধকাজে নিয়োজিত, এমনকি অনেক যৌনকর্মী এসব কাজে ট্রানজিট বা বাহক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত খবরে জানা যায়, মাদক বাহনে এ দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে পথশিশুরা, বাড়ছে শিশুমাদকাসক্তের সংখ্যাও। এমন এক পথশিশু যে প্রথমে সমবয়সীদের সঙ্গে ‘বোং’ নিত, সে ক্রমে হেরোইন সেবনে অভ্যস্ত, দেড় বছর ধরে সে হেরোইন সেবন করে আসছে। টোকাই এই শিশু মাদকসেবন করতে শিখেছে তার মালিকের কাছে। এ রকম অনেক ছেলে ও মেয়েশিশু মাদকাসক্ত হচ্ছে, অপরাধমূলক কাজ করে যে টাকা পায়, সে টাকা দিয়ে মাদক কেনে। এসব শিশু ব্যবহৃত হচ্ছে মাদক বহনেও। এরা মাদক পাচার করতে পারে এমন সন্দেহ অনেকে করতে পারে না বলে চোখ এড়িয়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের নজরও এরা অনেক সময় এড়িয়ে যায়। আর মাদক ব্যবসায়ীরা সহজেই বাহক হিসেবে ব্যবহার করে শিশু ও নারীদের। মাদকাসক্ত এসব শিশুর অনেকে নিরাময়কেন্দ্রে গেলেও চিকিৎসা নিয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার আগেই আবারও পুরোনো পরিবেশে ফিরে গিয়ে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। এদের পুনর্বাসনের ভালো ব্যবস্থা থাকলে এমন ঘটত না।
কম্বোডিয়ার মতো বাংলাদেশও যে এশিয়া থেকে পশ্চিমা দেশে মাদক পাচারের এক প্রধান ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, এ ব্যাপারে কিছুকাল আগে বিবিসিতে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন চট্টগ্রামে পড়তে আসা কম্বোডিয়ান টিএনজার ছাত্রী। তিনি নিজে মাদকাসক্ত হয়ে সমস্যাকে দেখেছেন গভীরভাবে। তিনি লক্ষ করেছেন, কম্বোডিয়ার তুলনায় বাংলাদেশে নেশার ওষুধ সম্পর্কে জনগণের জ্ঞান ও সচেতনতা দুটোই কম। কম্বোডিয়ার মানুষ মাদক অপব্যবহার সম্পর্কে বেশ অবহিত অথচ বাংলাদেশে এ ব্যাপারে সচেতনতা কর্মসূচি অনেক কম। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পরিবারে এ ব্যাপারেও সচেতনতা অনেক কম। লোকজন বোঝে যে সমস্যা ঘটছে, কিন্তু এ ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে আলাপ করে কম। মানুষ বিষণ্নতার কারণে বা কৌতূহলে নেশা করে এবং সেই ছাত্রীও কৌতূহলে মাদক নেওয়া শুরু করেন।
চট্টগ্রামের একটি মাদক নিরাময়কেন্দ্র ও চিকিৎসকের কথা তিনি উল্লেখ করেন। মাদকসেবীরা বেশির ভাগ তরুণ, এদের মধ্যে রয়েছে ছাত্রছাত্রী, চিকিৎসক, পুলিশ, রাজনীতিক, ব্যাংকার-অনেক পেশার লোক। একসময় তার দেখা হলো একজনের সঙ্গে, যিনি নিয়মিত ‘ইয়াবা’ গ্রহণ করেন। ‘মেথাএমফেটামাইন’ নামক এই উদ্দীপক মাদক বেশ প্রচলিত। স্থানীয় চেম্বার অব কমার্সের একজন সদস্য ৩৩ বছর বয়সী ওই ভদ্রলোক ইয়াবা গ্রহণ করে করে আসক্ত। কাজ এলোমেলো, জীবনটাই তাঁর বিপর্যস্ত।
বাংলাদেশের বড় বড় শহরে মাদক সহজলভ্য।
ঢাকার একজন মেয়ে জানায়, ছাত্র অবস্থা থেকেই সে হেরোইন নেওয়া শুরু করেছে। তার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবীর ছেলেবন্ধু মাদকাসক্ত এবং সে-ই তাকে নেশার ওষুধ ও সুই-সিরিঞ্জ সরবরাহ করেছিল। সে ছয় মাস নেশা করেছে, এখন বন্ধ করেছে। হেরোইনের সঙ্গে সে ঘুষের ওষুধও সেবন করেছে। এ জন্য একনাগাড়ে সে ঘুমাত দুই-তিন দিন। এখনো তার ঘুমের সমস্যা আছে। মানুষের সঙ্গে মিশে তার মনে হলো, সত্যি কথা মুখ ফুটে বলতে হবে, সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে, লজ্জায় মরে যাওয়ার চেয়ে এই ভালো, যত কঠিনই হোক ব্যাপারটা।
সে নেশা কাটিয়ে উঠল এবং বাঁচল। এখনো বেঁচে আছে। চ্যাপ্টা নাকের দুটো ফুটো দিয়ে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস ঠিকই চলছে। ব্যর্থতা তাকে পরাজিত করতে পারেনি, কেবল কঠিন শিক্ষা দিয়ে গেল, পরে যা কাজে লাগবে।··· ঘটনা এখানে শেষ।
তাই মাদকবিরোধী দিবসে কেবল সেমিনার ও সামাজিক অনুষ্ঠান করে দেশ থেকে, পৃথিবী থেকে মাদক সমস্যা দূর করা যাবে না। এ সময়ের দাবি হলো, শিশু ও তরুণদের মধ্যে নিয়মিত সচেতনতা অভিযান ও শিক্ষামূলক কর্মসূচির আয়োজন করা। বিক্ষিপ্তভাবে কোনো কোনো মাদকবিরোধী সংস্থা করছে, কিন্তু ব্যাপক আয়োজন নেই। বস্তুত মাদকবিরোধী আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করলে মাদকদ্রব্যের চাহিদা ও সরবরাহ দুটোই হ্রাস পাবে।
তাই আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বেসরকারি সংস্থা ও শিক্ষা বিভাগ একত্রে বিশেষ মাদকবিরোধী কর্মসূচির আয়োজন করবে, যাতে তরুণসমাজ মাদক চোরাকারবারিদের খপ্পরে না পড়ে।
শেষ কথাঃ ওষুধের অপব্যবহার ও মাদক-এ দুটো জিনিস মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল পপসম্রাট মাইকেল জ্যাকসনকে-কেবল প্রমাণের অপেক্ষা।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, পরীক্ষাগার সেবা
বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ০৮, ২০০৯
Leave a Reply