চোখের মধ্যে কোনো ময়লা লাগার মতো অস্বস্তি, বেশি মাত্রায় পানি পড়া, চোখ লাল অথচ ব্যথা নেই, এসব উপসর্গ নিয়ে বর্ষার (বন্যার) সময় অথবা অব্যবহিত পরে অনেক রোগী চক্ষু হাসপাতাল অথবা চোখের চিকিৎসকের কাছে যায়। এটা খুব একটা অপরিচিত নয়। বরং এ রোগের অভিজ্ঞতা হয়নি এমন লোকই খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এমনি এমনি ভালো হয়ে যায়। কখনো চোখে পুঁজ (ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণজনিত) হতে পারে বা খুব সামান্য ক্ষেত্রেই বড় ধরনের জটিলতা হয়ে থাকে।
এটি কনজাংটিভার প্রদাহ
কনজাংটিভা হচ্ছে চোখের বাইরের সাদা অংশসমূহ, যা সহজে দেখা যায়। অর্থাৎ এটি চোখের বাইরের দিকের আবরণ (মাঝখানে কর্নিয়া বাদে), যা চোখের পাতার নিচেও বিদ্যমান। জীবাণু সংক্রমিত হলে দেহের স্বাভাবিক প্রতিরোধ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই চোখের অর্থাৎ কনজাংটিভার রক্ত চলাচল বেড়ে যায়, রক্তনালিগুলো প্রসারিত হয় এবং চোখের পানি উৎপাদনকারী গ্রন্থিগুলোর কাজ বেড়ে যায়। এসবের মিলিত ফলাফলেই লক্ষণগুলো দেখা দেয়।
কেন এই চোখওঠা
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব চোখওঠা রোগ ভাইরাসজনিত। সবচেয়ে বেশি মাত্রায় চোখওঠা রোগের কারণ ‘এডেনো ভাইরাস’। ভাইরাসটির আবার অনেক উপ-প্রজাতি রয়েছে, যাদের ১, ২, ৩··· এভাবে নামকরণ করা হয়। এমন কয়েকটি উপপ্রজাতি, যারা সচরাচর রোগটির কারণ, এগুলো হচ্ছে-উপপ্রজাতি ৩ ও ৭। তবে ভাইরাসটির অন্যান্য উপপ্রজাতি, যেমন-৮, ১১ কিংবা ১৭-র আক্রমণ আরও তীব্র। তবে তা কমই সংক্রমণ ঘটে। বর্ষাকালে বা স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া, যখন বাতাসে জলীয় বাষ্প বেশি ও গরম এবং বাতাসের প্রবাহও খুব খামখেয়ালি, এ রকম সময়ে চোখওঠা রোগের ব্যাপক আক্রমণ ঘটে। একটু তীব্র ধরনের চোখওঠা সাধারণত দরিদ্র, অপুষ্টির শিকার ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার অল্পবয়সীদের মধ্যে বেশি হয়। বন্যার সময়, বিশেষ করে আশ্রয়কেন্দ্রে, যেখানে অল্প জায়গায় অনেক মানুষ একসঙ্গে থাকে, মল ত্যাগের ভালো ব্যবস্থা নেই, মল ত্যাগের পর হাত ভালোভাবে পরিষ্কার করার সুযোগ কম, ব্যবহৃত রুমাল, গামছা, তোয়ালে ইত্যাদি শুকানোর ভালো ব্যবস্থা নেই-এ রকম পরিস্থিতিতে পাতলা পায়খানার মতো চোখওঠা রোগেরও ব্যাপক বিস্তার ঘটতে পারে। মাঝেমধ্যে অন্যান্য ভাইরাস সংক্রমণের সময়ও, যেমন-মিজেলস (হাম), রুবেলা অথবা ইনফ্লুয়েঞ্জায় চোখওঠা উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
কীভাবে ছড়ায়
ভাইরাসগুলো বেশির ভাগই খুব ছোঁয়াচে। বাতাসের মাধ্যমে, রোগীর ব্যবহার্য জিনিসপত্র ও সরাসরি স্পর্শের মাধ্যমে ছড়ায়। তবে এ ভাইরাসগুলো যেহেতু পায়খানার সঙ্গে শরীর থেকে নির্গত হয়, তাই ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার বেশির ভাগ শিশু অপরিচ্ছন্ন হাতের মাধ্যমে পরিবারের এবং ঘনিষ্ঠ অন্যান্য ব্যক্তিদের মধ্যেও এসব ভাইরাস ছড়াতে পারে। এমনকি চোখের চিকিৎসকের অসাবধানতায় একজন সংক্রমিত রোগীর চোখে ব্যবহৃত কোনো যন্ত্রপাতি (বিশেষ করে চোখের ভেতরের চাপ মাপার ‘টনোমিটার’, যেটি চোখের ওপর বসাতে হয়) জীবাণুমুক্ত না করে অন্য রোগীর চোখে ব্যবহার করার কারণেও এ রোগ ছড়াতে পারে।
লক্ষণ
চোখে ময়লা লাগার মতো খচখচে অনুভূতি, চোখ দিয়ে পানি পড়া (মাত্রা কম-বেশি হতে পারে), চোখের ভেতর লাল হয়ে যাওয়া। চোখে সাধারণত কোনো ব্যথা থাকে না। বাচ্চারা এসব ভাইরাসের কারণে ডায়রিয়ায়ও আক্রান্ত হতে পারে বলে এসব ভাইরাসজনিত চোখ ওঠার সঙ্গে পাতলা পায়খানার উপসর্গ থাকতে পারে। এডেনো ভাইরাস সংক্রমণে কখনো কানের পেছনের লসিকাগ্রন্থি ফুলতে পারে এবং চোখের পাতাসংলগ্ন কনজাংটিভা থেকে পাতলা ধূসর পর্দার মতোও দেখা দিতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভাইরাসটির উপপ্রজাতিসমূহের সংক্রমণে কনজাংটিভার সঙ্গে কর্নিয়াও আক্রান্ত হয় এবং তা মহামারি আকারেও ছড়াতে পারে, যে ক্ষেত্রে চোখের স্থায়ী ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
প্রতিকার ও প্রতিরোধ
রোগটির ভাইরাস ছড়ানোর উপায়গুলো পর্যালোচনা করলেই প্রকৃতপক্ষে সেসবের প্রতিকার ও প্রতিরোধের উপায় খুঁজে বের করা যায়। যেহেতু এটি একটি ভাইরাস সংক্রমণ তাই নিরাময়ের জন্য কোনো জুতসই ওষুধ নেই। কোনো ব্যাকটেরিয়ার সহসংক্রমণ থাকলে তরল অ্যান্টিবায়োটিক ড্রপ বা মলম (অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে) ব্যবহার করা উচিত। অর্থাৎ রোগটির সংক্রমণ হলে নিরাময়ের সহজ কোনো উপায় নেই। তবে রোগ হলে আরও জটিলতা যাতে না হয় বা ভাইরাসটি যাতে অন্যদের মধ্যে ছড়াতে না পারে সে জন্য সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। প্রতিরোধের জন্য প্রথমত জরুরি হচ্ছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। মল ত্যাগ করতে হবে অবশ্যই স্যানিটারি পায়খানায়। স্যানিটারি পায়খানা না থাকলে প্রথমেই উচিত তার ব্যবস্থা করা। মল ত্যাগের পর হাত ভালোভাবে সাবান দিয়ে ফেনা তুলে পরিষ্কার করতে হবে। ছাই ও এঁটেল মাটিতে ঘষলেও কিছুটা উপকার হয়। এরপর রুমাল, গামছা, তোয়ালে, লুঙ্গি, বিছানার চাদর ইত্যাদি প্রতিদিন সরাসরি রোদে শুকাতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তির কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে (কমপক্ষে তিন মিটার দূরে, বায়ুপ্রবাহের বিপরীত দিকে) থাকতে হবে। আক্রান্তের সেবা-শুশ্রূষা করার সময় সতর্ক থাকা উচিত। চোখে চশমা, মুখ মাস্ক পরলে প্রতিরোধ করা যায় সহজে। অপ্রয়োজনে যে কারোরই পরিষ্কার নয় এমন হাত চোখে দেওয়া উচিত নয়।
হাত দিয়ে চোখের শুশ্রূষা করার জন্য সব সময়ই সতর্ক থাকা প্রয়োজন, যাতে হাতে থাকা ময়লা, জীবাণু চোখে না যায় বা নখের আঁচড়ে চোখের নরম আবরণগুলোয় ঘা না হয়ে যায়। আক্রান্ত ব্যক্তিকে আলাদা ঘরে রাখা সম্ভব হলে সুস্থদের মধ্যে ভাইরাস ছড়ানো প্রতিরোধ করা যায়। আক্রান্ত ব্যক্তি চোখে রোদচশমা ব্যবহার করলে আরাম বোধ করে, এমনকি ভাইরাস ছড়ানোর ক্ষেত্রেও কিছুটা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। আক্রান্তের ব্যবহারের পোশাক গরমপানিতে পরিষ্কার করে সরাসরি রোদে শুকাতে পারলে জীবাণু ধ্বংস করা সম্ভব। চক্ষুবিশেষজ্ঞ, বিশেষ করে যাঁদের এ ধরনের চিকিৎসার অভিজ্ঞতা কম, তাঁদের অবশ্যই একজন রোগী থেকে সুস্থদের মধ্যে রোগটি ছড়ানোর বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
এ রোগ থাকলে দৃষ্টিশক্তির পরীক্ষাও করা উচিত নয়। বন্যা বা অন্য কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় যখন অনেক মানুষকে একসঙ্গে অল্প জায়গায় বসবাস করতে হয়, এসব ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা এসব ছোঁয়াচে রোগ সম্পর্কে একটু সতর্ক থাকলে দুর্ভোগ কমানো সম্ভব।
মো· আশরাফুল আলম
মেডিকেল মাইক্রোবায়োলজিস্ট
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ০৮, ২০০৯
Leave a Reply