রিমঝিম বৃষ্টি। ঝমঝম বৃষ্টি। টিপটিপ বৃষ্টি। টাপুরটুপুর বৃষ্টি। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। মুষলধারে বৃষ্টি। বাংলা ভাষায় কতভাবেই না বৃষ্টির বর্ণনা আছে। বৃষ্টি পড়লে মন কেমন করে না এমন বাঙালি কি খুঁজে পাওয়া যাবে? ইট-কাঠের নগরে এখন অবশ্য আছে নাগরিক বৃষ্টি। পথঘাট ভাসিয়ে, কাদা করে তার আসা-যাওয়া। তার রূপ গ্রামবাংলার চিরচেনা বৃষ্টির চেয়ে ভিন্ন। তবু তার আবেদন কি বদলেছে?
‘একদমই না। বৃষ্টির ছাঁট গায়ে লাগলে শিহরণ হবে না, তা কি হয়? এটা তো বাঙালির জিনেই আছে। হাজার বছরেও বোধহয় এর বদল হবে না। এখন অবশ্য বৃষ্টির রূপ আর আগের মতো নেই। তবু বৃষ্টি নিয়ে বাঙালির অনুভূতি তো মরেনি। বৃষ্টির দিনে দেরিতে ঘুম ভাঙা; খিচুড়ি, ইলিশ খেতে চাওয়া; কোনো কিছুর পরোয়া না করে বৃষ্টিতে ভেজা—এর সবই তো বর্ষা নিয়ে আমাদের পাগলামিরই প্রকাশ। বর্ষা যেন একটু খেপাই করে ফেলে আমাদের।’ কথাগুলো সাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের।
সারা রাত বৃষ্টি হলে সকালে উঠে অফিস যাওয়া যাবে তো, বৃষ্টির ছাঁট লেগে ঠান্ডাটা বসে যাবে না তো, রাস্তার কাদায় কাপড়চোপড়ের বারোটা বেজে যাবে না তো?—এসব শঙ্কাও অবশ্য মনে কাজ করে। কিন্তু তা ছাপিয়েও বোধহয় বড় হয়ে ওঠে আমাদের বৃষ্টিবিলাস। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘এমন শিশু আমি দেখিনি যে বৃষ্টি দেখে ভয় পায়; বরং তার মনটা আঁকুপাঁকু করে ওঠে বাইরে গিয়ে একটু ভেজার জন্য, মাঠে গিয়ে একটু ফুটবল খেলার জন্য। এই সেদিন আমি নিজেও গা ভেজালাম বৃষ্টিতে এক সহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে। আর যাঁরা প্রেম করেন, তাঁদের জন্য বর্ষা যে কী দুর্দান্ত ঋতু! বর্ষার বিড়ম্বনা তো আছেই। কিন্তু সে আমাদের স্নায়ুতে যে কী অনুরণন তোলে, তা মুখে বলা মুশকিল।’
আষাঢ়-শ্রাবণ চলে যাবে আর একবারও শখ করে বৃষ্টিতে ভেজা হবে না, তা কী করে হয়। ফ্যাশন ডিজাইনার লিপি খন্দকার জানালেন তাঁদের একসময়কার বর্ষাবরণের রীতি: ‘চারুকলায় যখন পড়তাম, বৃষ্টির দিনগুলো ছিল তুমুল আনন্দের। নিচু বারান্দা পর্যন্ত উঠে যেত পানি। বৃষ্টিতে তো ভেজা হবেই। পানি-কাদায় কাউকে টেনে নামানো হবে। কারও কোনো দিকে খেয়াল নেই। জামাকাপড় নষ্ট হয় হোক, ঠান্ডা লাগবে, তাতে কী! এখনো বোধহয় ওখানে এ রকমই হয়।’
বৃষ্টিতে তো খুব ভিজলেন। কিন্তু একটু পর দেখা গেল কাপড়ের দফারফা। রং উঠে তা আর চেনা মুশকিল। ভেজা কাপড় গায়ে অস্বস্তিও লাগছে। জুতা জোড়াও ছিঁড়ল বলে। ব্যাগের ভেতর যে ছিল মুঠোফোন, তা কি আর সচল আছে? এ ভাবনায় তখনই তো মনটা খারাপ হয়ে যাবে। ভেজার আনন্দই মাটি। এমন যাতে না হয় সে জন্য লিপি খন্দকার দিয়েছেন কিছু টিপস: ‘বর্ষার দিনে সম্ভব হলে ব্যাগে অতিরিক্ত কাপড় রাখা ভালো। জর্জেট ও শিফন কাপড়ে তৈরি পোশাক পরলে ভিজেও নিশ্চিন্ত থাকা যাবে। কারণ একটু পরেই এ কাপড় একদম শুকিয়ে যাবে। অনেকে আবার সুতি কাপড় ছাড়া আর কিছু পরতে পছন্দ করেন না। তাঁরা খুব পাতলা সুতি ভয়েল কাপড় পরতে পারেন। ছাতা আর একটা প্লাস্টিকের ব্যাগও সঙ্গে রাখা যেতে পারে। মুঠোফোন, টাকা-পয়সা তাতে ভরে রাখা যেতে পারে।’
বৃষ্টি নেমেছে। ঘরে আর মন টিকছে না। ছাদে বা বাসার সামনের খোলা জায়গাটাতেই চলুক বৃষ্টিতে ভেজা। লিপি খন্দকার বলেন, ‘এ সময় গাঢ় রঙের একটা টি-শার্ট আর প্যান্ট পরাই ভালো। তবে জিনস পরবেন না। কারণ জিনস কাপড় বৃষ্টিতে ভিজে খুব ভারী হয়ে যায়।’
তবে ঠান্ডার সমস্যা থাকলে চট করে বৃষ্টিতে নেমে না পড়াই ভালো। একটু বুঝেশুনে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলুন। ঘরে ফিরেই ভেজা কাপড় বদলে ফেলুন। মাথা মুছে চুল শুকিয়ে নিন। শিশুদের বেলায়ও নিন বাড়তি সতর্কতা।
বৃষ্টির সঙ্গে খিচুড়ির যোগটা কী? কেন বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি ছাড়া অন্য কোনো কিছুতেই জিভের তৃপ্তি হয় না। এসব প্রশ্ন বরং থাক। বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি খাওয়া চাই-ই। খিচুড়ির আয়োজনটা কিন্তু খুব সহজ। রান্নাবিদ শাহানা পারভীন তার উপায় জানালেন: ‘সরু চাল আর ডাল তো ঘরেই আছে। তাই দিয়ে হতে পারে খিচুড়ি। ডিম আর সবজিও তো রেফ্রিজারেটরে পাওয়া যাবে। চটপট অমলেট বানিয়ে ফেলুন। পাঁচমিশালি সবজি দিয়ে করতে পারেন ঘণ্ট বা ভাজি। আর মাছ ভাজি থাকলে তো সোনায় সোহাগা। স্বাদ বাড়াতে যোগ করতে পারেন আচার বা চাটনি। এই মৌসুমে আচারও তো ঘরে থাকেই। আর বৃষ্টির দিনে বিকেলে নাশতায় করতে পারেন চানাচুর দিয়ে মুড়িমাখা। ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপটাও থাকা চাই। এসবের জন্য আলাদাভাবে বাজার করার প্রয়োজন তেমন নেই। ঘরে যা আছে তা-ই যথেষ্ট।’
রুহিনা তাসকিন
মডেল: ইশানা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ২২, ২০১০
Leave a Reply