অনুন্নত বিশ্বের কিছু দেশ, বিশেষ করে ভারত এবং বাংলাদেশে ‘অল্টারনেটিভ মেডিসিন’-এর নামে প্রাচীন আমলের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। যদিও প্রকৃত অর্থে ‘অল্টারনেটিভ মেডিসিন’ বলতে যা বোঝানো হয় তার কোনোকিছুরই প্রতিফলন থাকে না তথাকথিত এই বিকল্প চিকিৎসায়। ‘অল্টারনেটিভ মেডিসিন’-এর নামে উদ্দেশ্যমূলক এই বিস্তার আয়ুর্বেদ শাস্ত্র বা হার্বাল মেডিসিনের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মূল চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে উন্নত বিশ্বে প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের বিষয়টি এখন বিলুপ্তপ্রায়। এখন কোটি কোটি বিলিয়ন ডলার খরচ করে এগিয়ে যাচ্ছে যে চিকিৎসা ব্যবস্থা তা মোটেও হার্বাল নয়। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার বেশকিছু সীমাবদ্ধতা এখনও রয়ে গেছে। এই সীমাবদ্ধতার কথা অকপটে স্বীকার করছে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান। কিন্তু সাধারণ দরিদ্র মানুষ সস্তায় প্রাপ্ত হার্বালের দিকে ঝুঁকছেন। তবে এ কথা সত্যি যে, সস্তার তিন অবস্থা। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে, হার্বালের কি কোনো উপকারই নেই? এর উত্তর হচ্ছে- আছে। কিন্তু হার্বালের উপকারিতা নিয়ে যতটা লম্বা লম্বা কথা বলা হয়, কাজ হয় তার চেয়ে অনেক কম। মানসিক নির্ভরতার কারণে অনেকে এ চিকিৎসা নিয়ে স্বস্তি পেয়ে থাকেন। এ ছাড়া কিছু কিছু রোগ আছে এমনিতেই সেরে যায়। সেক্ষেত্রে রোগী হার্বাল চিকিৎসা নিলে রোগী ভাবতেই পারেন হার্বাল ওষুধে রোগ নিরাময় হয়েছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি সামান্য কাজ দেয়।
যেমন- বমিভাব হলে আদা খেলে কমে যায়। কিন্তু বমিভাবের পিছনে যদি শরীরের কোনো অঙ্গের অসুস্থতা দায়ী থাকে তখন ১ মণ আদা খেলেও কাজ হবে না। এরকম অনেক সামান্য কিছু সফলতার ইতিহাস আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের আছে। একে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে যে কল্পকাহিনী তৈরি করা হয়, তাতে হার্বালের মারাত্মক সব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা চাপা পড়ে যায়। তৈরি হয় ভুল ধারণা। কুসংসারে বিশ্বাসী মানুষ চলে বিপথে। বিপদ নেমে আসে আকষ্মাত। হার্বাল মেডিসিন নিয়ে বেশকিছু ভুল ধারণা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো এ নিবন্ধে।
প্রচলিত বিশ্বাস : হার্বাল প্রাকৃতিক তাই এটা অবশ্যই নিরাপদ এবং কার্যকরি।
প্রকৃত সত্য : প্রাকৃতিক শব্দের সঙ্গে নিরাপদ শব্দটি সবসময় খাপ খায় না। ‘হেমলক বা বিষাক্ত ব্যাঙের ছাতার’র কথা চিন্তা করুন। প্রকৃতিক প্রদত্ত ডাবের পানিও কিডনি অকেজো হয়ে গেলে খাওয়া নিষেধ। ‘ইপেড্রা বা সোমলতা’ রক্তচাপ বাড়াতে পারে। বেশি গ্রহণে স্ট্রোক, খিঁচুনিসহ মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। কয়েক সপ্তাহ ‘জৈষ্ঠ্যমধু’ গ্রহণ করলে রক্তে পটাশিয়াম কমে যেতে পারে, শরীর দুর্বল লাগবে, হার্ট অচল হলে পরপারের আমন্ত্রণপত্র পেয়ে যেতে পারেন। হার্বালের সঙ্গে বিষাক্ত পারদ, আর্সেনিক, সীসা বা কীটনাশকের মিশ্রণ থাকতে পারে, কখনওবা হার্বালের সঙ্গে স্টেরয়েড কিংবা ঘুমের ওষুধ মেশানো হয়; যার দীর্ঘ এবং অপ্রাসঙ্গিক ব্যবহার আপনার জীবনকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারে। মনে করা হয়, হার্বালে নাকি বিভিন্ন গাছগাছড়ার ফলমূল এক সঙ্গে মিশানো হয় বলে এটা কার্যকরী। প্রকৃতি প্রদত্ত বলে কৃত্রিমভাবে তৈরি ওষুধের চেয়ে শরীরে ভালোভাবে শোষিত হয়- এ ধারণা কিন্তু বিজ্ঞানসম্মত নয়। হার্বাল বলে যা গ্রহণ করছেন তা পাকস্থলীর এসিড-এনজাইম হজম করে ফেলতে পারে। শোষণের ক্ষেত্রে শরীর বুঝতে পারে না কোনটা প্রকৃতিক কোনটা সিনথেটিক। বিজ্ঞানীরা কোনও প্রাকৃতিক উপাদানের রাসায়নিক গঠন জানার পর ঐ উপাদানের বৈশিষ্ট্য ঠিক রেখে হুবহু জিনিস তৈরি করেন। যেমন ‘স্যালিসিন’ সাধারণ মাথাব্যথার মোক্ষম ওষুধ। এর সিনথেটিক রূপটি হচ্ছে স্যালিসাইলিক এসিড ও ডিসপ্রিন, যা কার্যকারীতায় তফাৎবিহীন।
প্রচলিত বিশ্বাস : বছর বছর ধরে বাপদাদারা প্রাকৃতিক ওষুধ ব্যবহার করে আসছেন, অতএব এটা উপকারী এবং নিরাপদ।
প্রকৃত সত্য : কবিরাজরা প্রাকৃতিক ওষুধগুলোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ওয়াকিবহাল কিনা তা নিয়ে যথেষ্ঠ সন্দেহ আছে। ‘কান্ট্রিরোজ’-এর রাসায়নিক পদার্থ বা কোল্টসফট-এর কারণে যে ক্যান্সার হয় তা দ্রুত নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। এছাড়া ‘আলফা-আলফা বা পেনিওয়াট’ যে কোনও কাজে আসে না তা আধুনিক বিজ্ঞানে প্রমাণিত।
প্রচলিত বিশ্বাস : হার্বাল তো প্রাকৃতিক, এ বিষয়ে তাই ডাক্তারকে না জানালেও চলবে।
প্রকৃত সত্য : প্রকৃতিজাত বলে হার্বাল গ্রহণকারীরা বেশি পরিমাণে হার্বাল গ্রহণে দ্বিধাবোধ করেন না। তারা বিষয়টি অন্য চিকিৎকদের কাছে গোপন রাখেন। ফলে হার্বালের কারণে যে সকল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয় তা অনির্ণতই রয়ে যায়। হার্বালের কারণে অনেক অসুখেরই তীব্রতা বাড়তে পারে। রসুন, আদা রক্তের স্বাভাবিক জমাট বাধা প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে পারে। এর সঙ্গে ডিসপ্রিন, ওয়ারফারিন ওষুধে কার্যকারিত যোগ হলে শরীরে শুরু হবে রক্তক্ষরণ। ডায়াবেটিস রোগীরা ওষুধের সঙ্গে যৌবন বা শক্তি বর্ধনের জন্য জিনসেং গ্রহণ করলে রক্তে চিনির পরিমাণ খুব বেশি কমে যেতে পারে। ‘একাইনেসিয়া’ নামক হার্ব গিটে বাতের ব্যথা বাড়ায়। ‘শয়তানের মূল্য’ গ্যাস্ট্রিক আলসারের জন্য ক্ষতিকর। এই তথ্যগুলো অনেকেরই জানা নেই।
প্রচলিত বিশ্বাস : বোতলের গায়ে লেখা আছে- মহৌষধ, ১০০% গ্যারান্টি, বিফলে মূল্য ফেরত, কাজ না করে উপায় আছে।
প্রকৃত সত্য : লেভেলে অনেককিছুই লেখা থাকে। একই ওষুধ নিয়ে এক কোম্পানি বলছে ‘স্মরণশক্তি বাড়বে’, আরেক কোম্পানি বলছে ‘লিভার সতেজ রাখে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। তাহলে কোনটি ঠিক? সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, কোন ওষুধ কীভাবে কাজ করবে বা শরীরের কোথায় কোথায় কাজ করবে এ বিষয়ে প্রাকৃতিক ওষুধ বিশারদদের কেউই কিছু বলতে পারে না। বিফলে মূল্য ফেরত! ১০০ টাকায় ওষুধ খেয়ে কিডনি নষ্ট হলে হয়ত ১০০ টাকা ফেরত পাবেন, কিন্তু কিডনিটি নয়। আরেকটি বিষয়- গ্যারান্টি দিয়ে কোনও রোগের চিকিৎমসা সম্ভব নয়। যদি কেউ দেয় তাহলে তিনি হয় দেবতা, নয়- ইবলিশ।
প্রচলিত বিশ্বাস : প্রকৃতিজাত, অতএব বেশি জানার কি দারকার?
প্রকৃত সত্য : আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে ওষুধ সামগ্রীকে ব্যাপক ট্রায়ালে পরীক্ষা নিরীক্ষার পর বাজারে ছাড়া হয়। ওষুদের মাত্রা, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, সাবধানতা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য রাখা হয়। ওষুধ সম্পর্কে এই গবেষণা চলে অনবরত। সমস্যা দেখা দিলে বা তার প্রমাণ মিললে ওষুধটি বাজার থেকে তুলে নেয়া হয় কিংবা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। আর এ বিষয়টি হার্বাল শাস্ত্রে সম্পূর্ণ অবহেলিত। হার্বাল শাস্ত্রে ওষুধ নিয়ে কোনো গবেষণা নেই, ওষুদের দোষগুণ বিচারের কোনও ব্যবস্থা নেই। তাদের কথায় এসব ওষুদের কোনও দোষই নেই। আর দুঃর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, হার্বাল বলেই তাদের ওষুদের কার্যকারিতা নিয়ে অবিশ্বাসের প্রশ্ন আসে। সুতরাং হার্বাল ব্যবহারেও সাবধান হতে হবে। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থাকে উপেক্ষা করে অন্ধপথে হাঁটবেন না। এতে ক্ষতি হবে নিজেরই। দীর্ঘমেয়াদী অসুখে এর ব্যবহার এড়িয়ে চলুন। গর্ভবতী মহিলা, গর্ভবতী হবেন বা বুকের দুধ খাওয়ান এমন মহিলাকে হার্বাল সেবনে বিরত রাখুন। হার্বাল ফুডপয়জনিং করতে পারে। হার্বালে সমস্যা তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা বন্ধ করে দিন। দ্রুত ডাক্তার দেখান।
ডা. আসাদুর রহমান
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, জুলাই ০৪, ২০০৯
তুষার আহাসান
খুব সুন্দর একটি লেখা, যুক্তিপুর্ণ। ধন্যবাদ।