বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ ডায়াবেটিসে ভুগছে। এর প্রকোপ দিন দিন বেড়েই চলেছে। এটি সারা জীবনের রোগ, এ রোগ কখনো একেবারে সেরে যায় না। কিন্তু চিকিৎসার মাধ্যমে এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। এ রোগ থেকে শরীরের প্রতিটি অঙ্গকে বাঁচানোর জন্য প্রয়োজন রক্তের সুগার সব সময় নিয়ন্ত্রণে রাখা। এ জন্য চিকিৎসক, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও গণমাধ্যম রোগীদের যথেষ্ট সাহায্য করতে পারে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, আধুনিক চিকিৎসার মাধ্যমে ডায়াবেটিস পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রেখে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা সম্ভব।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের উপায়
ডায়াবেটিক রোগীর সুগার নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন নয়। রোগী ঘরে বসেই নিজের ব্লাড সুগারকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন গ্লুকোমিটার দিয়ে ঘন ঘন রক্তের চিনি বা শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করে। এর জন্য প্রয়োজন চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো জানা। যেসব বিষয়ে রোগীদের জানতে হবে তা হলো খাওয়া-দাওয়া, ব্যায়াম, ওষুধ ও সর্বক্ষেত্রে শৃঙ্খলা বোধ।
খাওয়া-দাওয়া
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য খাদ্যের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎকের পরামর্শ অনুযায়ী সময়মতো ও পরিমাণমতো খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। আমাদের দেশের বেশির ভাগ ডায়াবেটিক রোগীর শরীরের ওজন অতিরিক্ত নয়। বেশির ভাগ রোগীই প্রোটিন ও ফ্যাট স্বাভাবিক চাহিদার চেয়ে কম খেয়ে থাকেন। শুধু শর্করাটা বেশি খাওয়া হয়।
শর্করা কমিয়ে খাবারে শাকসবজির পরিমাণ বাড়ানো দরকার, চিনি ও মিষ্টিজাতীয় জিনিস বাদ দিতে হবে। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে অহেতুক চিন্তিত হওয়ার দরকার নেই। খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা ডায়াবেটিস হওয়ার আগে যে রকম থাকে, পরেও একই থাকে।
খাওয়া-দাওয়ার নিয়ম মেনে চলার উদ্দেশ্য হলো ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা, স্বাস্থ্য ভালো রাখা ও শরীরের স্বাভাবিক ওজন বজায় রাখা। খাদ্য ব্যবস্থার গুরুত্ব বোঝানোর জন্য একে মেডিকেল নিউট্রিশন থেরাপি বলা হয়।
ব্যায়াম
আমরা জানি, ব্যায়াম সুস্বাস্থ্যের চাবিকাঠি। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের ক্ষেত্রে এর ভূমিকা পরীক্ষিত। ব্যায়াম মাংসপেশির জড়তা দূর করে, রক্ত চলাচলে সাহায্য করে। শরীরে ইনসুলিনের কার্যকারিতা ও নিঃসরণ বাড়ায়। ডায়াবেটিক রোগীর রক্তের ভালো কলেস্টেরল কম থাকে, যা করোনারি হার্ট ডিজিজ হওয়ার একটি বড় রিস্ক ফ্যাক্টর বা ঝুঁকি।
প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট করে ব্যায়াম করা প্রয়োজন। ডায়াবেটিক রোগীর ব্যায়ামের বিকল্প নেই। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু ব্যায়াম ও খাদ্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কন্ট্রোল করে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব।
শিক্ষা
ডায়াবেটিস হলে এ রোগ নিয়েই রোগীকে বাঁচতে হয়। তাই রোগ নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষা। রোগীকে সাহায্য করার জন্য রোগীর স্বজনদেরও এই রোগ সম্পর্কে জানতে হবে। শিক্ষিত, প্রণোদিত রোগী নিজেই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখার দক্ষতা অর্জন করেন, পরবর্তী জীবন ধারা সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেন এবং জরুরি অবস্থা সহজেই মোকাবিলা করতে পারেন। গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য বর্তমানে ডায়াবেটিসের শিক্ষাকে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে অন্যতম ব্যবস্থা বলে গণ্য করা হয়।
শৃঙ্খলা
শৃঙ্খলা ডায়াবেটিসের রোগীর জীবনকাঠি। শৃঙ্খলার ব্যাপারে শ্রদ্ধেয় প্রফেসর মো· ইব্রাহিম সব সময় গুরুত্ব দিতেন, রোগীকে জীবনের সব ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা মেনে চলার উপদেশ দিতেন। যারা শৃঙ্খলা মেনে চলে, তাদের পক্ষে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা খুব সহজ ব্যাপার।
ওষুধ
খাদ্যব্যবস্থা, ব্যায়াম, শিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা মেনে চলা প্রত্যেক ডায়াবেটিসের রোগীর জন্য অপরিহার্য। এতে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের রোগীর প্রথম দিকে অনেকেরই শর্করা নিয়ন্ত্রণে থাকে। মনে রাখতে হবে, ডায়াবেটিস একটি প্রগ্রেসিভ রোগ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সুগার নিয়ন্ত্রণের জন্য অনেক ডায়াবেটিসের রোগীর ওষুধ সেবনের প্রয়োজন হয়। টাইপ-১ রোগীদের বাঁচার জন্য ইনসুলিন অপরিহার্য।
সুগার নিয়ন্ত্রণের জন্য টাইপ-২ রোগীদেরও অনেক সময় ইনসুলিনের প্রয়োজন হয়। আবার এও দেখা গেছে, প্রথম দিকে টাইপ-২ রোগীদের যারা শর্করা বেশি থাকায় ইনসুলিন নিয়েছে, পরবর্তী সময়ে বিনা ওষুধেও তাদের রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে থাকছে।
রোগীর সামগ্রিক অবস্থার ওপর চিকিৎসক ঠিক করে দেন রোগীর কী প্রয়োজন। সাধারণত রোগীরা ট্যাবলেটকে ইনসুলিন গ্রহণের চেয়ে বেশি পছন্দ করে। এখন বাজারে ডায়াবেটিসের বিভিন্ন ট্যাবলেট পাওয়া যায়। এর মাধ্যমে বেশির ভাগ ডায়াবেটিসের রোগীর শর্করা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
ইনসুলিন
ডায়াবেটিসের রোগীর রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে কার্যকর ওষুধ হচ্ছে ইনসুলিন। ইনসুলিন ইনজেকশনের মাধ্যমে নিতে হয় বলে অনেক রোগীই ভয় পায়। ট্যাবলেটের চেয়ে এর দাম বেশি।
ইনসুলিনের প্রয়োগ শুরু হয় ১৯২১ সাল থেকে। এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় ইনসুলিনের ধরন প্রয়োগের ক্ষেত্রেও অনেক উন্নতি হয়েছে।
এখন আধুনিক ইনসুলিন দিয়ে খাবার সামনে নিয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকতে হয় না। দাওয়াত খাওয়ার জন্য ইনসুলিন সঙ্গে নিয়ে যেতে হয় না। এখন উন্নত মানের ইনসুলিন শোয়ার আগে একবার নিলেই হয়। সঙ্গে ট্যাবলেট নাশতার সঙ্গে খেতে হয়।
নতুন ইনসুলিন দিয়ে সহজেই রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় তেমন ব্যাঘাত ঘটে না। এই ইনসুলিনগুলো বাংলাদেশেও পাওয়া যায়। তবে দাম কিছুটা বেশি।
ইনসুলিন প্রয়োগে নতুনত্ব
ডায়াবেটিসের রোগীদের ইনসুলিন নেওয়ার ব্যাপারে বড় বাধা হলো বারবার ইনজেশন দেওয়া। যুগের চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে ইনসুলিন প্রয়োগেও এসেছে নতুনত্ব। এখন ইনসুলিন ইনহেলার ও ওরাল স্প্রে হিসেবে পাওয়া যায়।
এতে ডায়াবেটিসের রোগীদের দীর্ঘদিনের আশা পূরণ হয়েছে। এর প্রয়োগ-প্রণালী খুবই সহজ। শর্করা নিয়ন্ত্রণও ভালোভাবে হয়। তবে ধূমপায়ীরা এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। তাই এখনই ধূমপান ত্যাগ করুন। এই ইনসুলিনের দাম একটু বেশি। ভবিষ্যতে বাংলাদেশেও এগুলো পাওয়া যাবে।
কীভাবে বুঝবেন আপনার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আছে
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আছে কি না তা দেখার জন্য মাঝেমধ্যে রক্তের শর্করা পরীক্ষা করতে হবে। গ্লুকোমিটার দিয়ে বাড়িতে বসে সহজেই তা করা যায়। এসব ছোট মেশিন অল্প দামে বাংলাদেশেও পাওয়া যায়। অভুক্ত অবস্থায় রক্তের সুগারের পরিমাণ ছয় মিলি মোল/লিটার এবং খাওয়ার পরে আট মিলি মোল/লিটারের মধ্যে হলে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে মনে করতে হবে। রক্তে ঐদঅ১ধ মেপেও নিয়ন্ত্রণের ধারণা করা যায়। ঐদঅ১ধ শতকরা ৭ ভাগের নিচে হলে তিন মাস সুগার ভালো নিয়ন্ত্রণে আছে বলে ধরা যায়।
পর্যবেক্ষণ করা
নীরব ঘাতক ডায়াবেটিস সুনিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা সম্ভব। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস প্রতিনিয়তই রোগীর জন্য বয়ে আনে সমস্যা। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস রোগীকে অন্ধ করতে পারে, পঙ্গু করতে পারে। কিডনি ও হার্টের ক্ষতি করে অকালমৃত্যুর কোলে ঠেলে দিতে পারে।
এ জন্য মাঝেমধ্যে অবশ্যই ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা দরকার।
এ ছাড়া রক্তচাপ, রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। হার্ট, কিডনি ও চোখের কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না তা নিয়ে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করুন। মনে রাখবেন, প্রাথমিক অবস্থায় সমস্যা ধরা পড়লে সহজেই চিকিৎসা করা যায়। আধুনিক পদ্ধতিতে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখুন এবং সুস্থ, স্বাভাবিক, কর্মময় জীবন উপভোগ করুন।
লেখকঃ ডা· মো· ফরিদ উদ্দিন
উৎসঃ দৈনিক প্রথম আলো, ২১ নভেম্বর ২০০৭
Leave a Reply