ইনসুলিন হচ্ছে ডায়াবেটিস চিকিৎসার একটি অন্যতম উপায়, যা শর্করা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অপরিহার্য। যেহেতু ডায়াবেটিসের কোনো নিরাময় নেই, তাই রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণ করাই হলো এর চিকিৎসার একমাত্র উদ্দেশ্য। শর্করা নিয়ন্ত্রণে না থাকলে ডায়াবেটিক রোগী বিভিন্ন ধরনের জটিলতা যেমন-মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বা স্ট্রোক, হূদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, স্মায়ুরোগ, ডনি সমস্যা ও চোখের সমস্যায় ভুগে থাকেন। এসব জটিলতা থেকে মুক্ত থাকতে হলে শর্করা য়ন্ত্রণের কোনো বিকল্প নেই। শুধু চিকিৎসার মাধ্যমেই সফলভাবে শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
চিকিৎসার উদ্দেশ্য হলো রক্তে শর্করার পরিমাণ খাওয়ার আগে ৬ মিলিমোল বা লিটার, খাওয়ার পর ৮ মিলিমোল বা লিটার এবং ঐদঅ১ধ শতকরা ৭ ভাগের মধ্যে রাখা।
টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার জন্য যে দুটো বিষয় বেশি দায়ী, তার অন্যতমটি হলো প্যানক্রিয়াসের বিটা সেল থেকে যে ইনসুলিন তৈরি হয় তার সেল বা কোষের সংখ্যা কমে যাওয়া অথবা তার কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলা।
এর ফলে দেখা যায় সব ধরনের চিকিৎসা দেওয়ার পরও ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে প্যানক্রিয়াস ইনসুলিন তৈরি করার ক্ষমতা প্রায় হারিয়ে ফেলে। বর্তমানে ডায়াবেটিসের যে চিকিৎসা রয়েছে, তার মাধ্যমে শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু বিটা সেল যে ধ্বংস বা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে অথবা এর কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে, এর জন্য এখনো কোনো চিকিৎসা উদ্ভাবন হয়নি। ফলে যে কারণে সেল ধ্বংস হচ্ছে তার কোনো চিকিৎসাই করা যাচ্ছে না।
এসব ক্ষেত্রে যে চিকিৎসাই দেওয়া হোক না কেন, একসময় শুধু ইনসুলিন দিয়েই চিকিৎসা করতে হয়। অবস্থা যদি তখন এ রকম হয় যে রোগীর খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, কায়িক পরিশ্রম বাড়ানো, ট্যাবলেট ইত্যাদির মাধ্যমেও শর্করা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না এবং শেষ পর্যন্ত ইনসুলিন দিয়েই চিকিৎসা করতে হচ্ছে, তাহলে প্রথম থেকে ইনসুলিন দিয়ে চিকিৎসা করাটাই কি ভালো নয়? গবেষকদের মতে, যত তাড়াতাড়ি ইনসুলিন দিয়ে চিকিৎসা শুরু করা যাবে, তত বেশি প্যানক্রিয়াসকে সুস্থ ও নিরাপদ রাখা যাবে এবং বিটা সেলকে ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা করা যাবে। ইনসুলিন শুধু যে সঠিক মাত্রায় শর্করা নিয়ন্ত্রণ করে তা নয়, সেই সঙ্গে বিটা সেলকে কর্মক্ষম রেখে ধ্বংসের হাত থেকেও রক্ষা করে। তাই বলা যায়, ডায়াবেটিস চিকিৎসায় ইনসুলিন হচ্ছে সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা। এর মাধ্যমে রক্তের শর্করা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব, যা ট্যাবলেটের মাধ্যমে সম্ভব নয়। ডায়াবেটিক রোগীর চিকিৎসা যত তাড়াতাড়ি ইনসুলিন দিয়ে করা হবে, ততই তা রোগীর জন্য মঙ্গলজনক হবে। তাই বলা যায়, ডায়াবেটিক রোগীর জন্য ইনসুলিন শেষ চিকিৎসা নয়, বরং প্রথম চিকিৎসাই হওয়া উচিত।
আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন এর সর্বশেষ পরামর্শও হলো, সম্ভব হলে প্রথম থেকেই ইনসুলিন শুরু করা। বিভিন্ন ধরনের ইনসুলিন বাজারে রয়েছে। এর রাসায়নিক গঠন পরিবর্তনের মাধ্যমে কোনোটিকে স্বল্পমেয়াদি, কোনোটিকে মাঝারি আবার কোনোটিকে দীর্ঘমেয়াদি করে তৈরি করা হয়েছে, যার উদ্দেশ্য সারা দিনের শর্করা নিয়ন্ত্রণ করা। এসব ইনসুলিন চিকিৎসক রোগীর সঙ্গে কথা বলে তার জন্য উপযোগী নির্দিষ্ট মাত্রা দিনে দুবার অথবা তিনবার আবার অনেক ক্ষেত্রে দুই ধরনের ইনসুলিনই মিলিয়ে দিয়ে থাকেন।
স্বাভাবিকভাবে আমাদের শরীরে যেভাবে ইনসুলিন তৈরি হয়, আগে এ সম্পর্কে সঠিক কোনো ধারণা ছিল না। তাই প্রচলিত ইনসুলিন÷লো দিয়ে এ প্রতিস্থাপন সঠিকভাবে সম্ভব হচ্ছে না।
স্বাভাবিকভাবে আমাদের দেহে দুই ধরনের ইনসুলিন নিঃসরিত হয়। অভুক্ত অবস্থায় শরীরের নিজস্ব যে গ্লুকোজ তৈরি হয় শরীরের বিভিন্ন ÷রুত্বপূর্ণ অঙ্গকে রক্ষা করার জন্য, সেই গ্লুকোজকে নিয়ন্ত্রণের জন্য সারা দিন অভুক্ত থাকলেও এক ধরনের ইনসুলিন নিঃসরিত হয়। এই ইনসুলিনকে বলা হয় বেসাল ইনসুলিন।
সুস্থ দেহে শূন্য দশমিক পাঁচ ইউনিট থেকে এক দশমিক শূন্য ইউনিট প্রতি ঘণ্টা হিসাবে এটা নিঃসরিত হয়ে থাকে প্যানক্রিয়াস থেকে অভুক্ত অবস্থায় শর্করাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। আবার আমরা যখন খাবার খাই, তা যে খাবারই হোক না কেন বা যে পরিমাণই হোক না কেন, শরীরে সেই খাবার গ্লুকোজ হিসেবেই জমা হয়। খাওয়ার পর সে গ্লুকোজ রক্তে আসে, তাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য প্যানক্রিয়াস থেকে আরেকভাবে ইনসুলিন নিঃসরিত হয়। এই ইনসুলিন যে পরিমাণ গ্লুকোজ রক্তে আসে, ঠিক সেই হারে রক্তের গ্লুকোজের সমতা রক্ষার জন্য নিঃসরিত হয়ে থাকে।
এই ইনসুলিনকে বলা হয় বোলাস ইনসুলিন, যা খাবারের পরের গ্লুকোজকে নিয়ন্ত্রণ করে। একজন সুস্থ মানুষের দেহে এ দুই ধরনের ইনসুলিন সঠিক মাত্রায় তৈরি হলেও ডায়াবেটিক রোগীর ক্ষেত্রে এর ঘাটতি দেখা দেয়, যার ফলে তাদের শর্করা নিয়ন্ত্রণে থাকে না। এই নতুন ধারণাকে মাথায় রেখে ইনসুলিন সরবরাহের ক্ষেত্রে নতুন করে ইনসুলিন মলিকিউল তৈরি করা হচ্ছে। গবেষণার মাধ্যমে এই ধরনের ইনসুলিন পাওয়া যাচ্ছে। আশার কথা হলো, আমাদের দেশের বাজারেও এ ধরনের ইনসুলিন আসা শুরু হয়েছে। সারা দিনের অভুক্ত অবস্থায় যে ইনসুলিন প্রয়োজন (বেসাল ইনসুলিন), সেটা এখন বাংলাদেশের বাজারেও পাওয়া যাচ্ছে। ইতিমধ্যে দেশের চিকিৎসকেরা এর ব্যবহার শুরু করেছেন এবং উন্নত বিশ্বের মতো আমাদের রোগীরাও ভালো ফলাফল পাচ্ছেন। এ ইনসুলিন সারা দিনে একবার গ্রহণ করে ২৪ ঘণ্টায় আমাদের শরীরে অভুক্ত অবস্থায় যে পরিমাণ ইনসুলিনের প্রয়োজন, তার ঘাটতি পূরণ করা যায়। তবে এটা দিয়ে খাবারের পর যে শর্করা তৈরি হয়, সেটা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা কিছু কিছু ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। ফলে খাওয়ার পর রক্তের বাড়তি শর্করাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য যে ইনসুলিন (বোলাস ইনসুলিন) দরকার, তার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। সুখবর হচ্ছে, এ ধরনের ইনসুলিনও এখন আমাদের বাজারে আসা শুরু হয়েছে; যার মধ্যে আরও ভালোভাবে খাওয়ার পরের গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। যেটা আগের ইনসুলিন দিয়ে সম্ভব ছিল না; এটাই হলো বোলাস ইনসুলিনের কার্যকারিতা, যার ফলে সঠিকভাবে শর্করা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব এবং রক্তে শর্করার স্বল্পতা অর্থাৎ হাইপোগ্লাইসেমিয়া কমানো সম্ভব। এ ধরনের ইনসুলিন দিনে দুই থেকে তিনবার এবং খাবার গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে নেওয়া যাবে।
সে জন্য আমরা যদি একই সঙ্গে বেসাল ও বোলাস ইনসুলিন ব্যবহার করি, তাহলে অভুক্ত অবস্থায় এবং খাওয়ার পরে শরীরে ইনসুলিন সরবরাহ সুস্থ মানুষের মতো সঠিকভাবে করা সম্ভব। ফলে চিকিৎসার যে উদ্দেশ্য অর্থাৎ রক্তের শর্করাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং এর মাধ্যমে উদ্ভূত বিভিন্ন জটিলতা থেকে শরীরকে রক্ষা করা, তা-ও সহজ হবে।
অধ্যাপক: ডা· মো· ফারুক
উৎসঃ দৈনিক প্রথম আলো, ১৪ নভেম্বর ২০০৭
Leave a Reply