মনে আছে ছোটবেলায় মা মাছের মুড়ো দিতেন পাতে, বলতেন খা বাবা, পরীক্ষায় ভাল করবি। ঘি ভাত, ডিমের মামলেট দিয়ে ভাত খেতাম। এরপর বিকেলে পাশের মাঠে ফুটবল খেলা। আর সন্ধ্যা হবার আগে ঘরে ফেরা। হায়রে সে সব দিন! কোথায় গেলো?
এখনকার মা বাবারা ছেলে-মেয়েদের ওমেগা৩ মেদঅম্ল খাওয়াবার জন্য তৈরি করে। এতে মগজ ভাল হবে। রুটি, দুধ, প্যাস্টা, ভিটামিন বড়ি সব কিছুর মধ্যে ওমেগা৩ ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে পাশ্চাত্যে। তবে পুষ্টি নামক হিমশৈলের অগ্রভাগে রয়েছে ওমেগা-৩, অনেক অনেক পুষ্টি উপকরণ রয়েছে, যা বুদ্ধিকে শাণিত করে, কেবল শৈশবে নয়, জীবন ভর করে এ কাজ। লসএনজেলস, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউবোসার্জিারি ও ফিজিওলজিক্যাল সায়েন্সের অধ্যাপক মৎস্য প্রেমিক ফার্মান্ডো গোমেজ পিনিলা মনে করেন, একজন ব্যক্তির খাদ্যে যথাযথ পরিবর্তন ঘটালে বুদ্ধিবৃত্তি উন্নত হয়, মগজ ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পায়, বার্ধক্যের প্রভাব থেকেও রক্ষা পায়। ডা: গোমেজ পিনিলা মগজের উপর খাদ্যের প্রভাব নিয়ে বছরের পর বছর গবেষণা করেছেন এবং ইদানীং এ ব্যাপারে একটি পর্যালোচনা প্রকাশ করেছেন নেচার রিডিউস নিউরোসায়েন্স এ যাতে মগজের উপর খাদ্যের প্রভাব নিয়ে ১৬০টি গবেষণার বিশ্লেষণ রয়েছে।
তার ধারণা কিছু কিছু খাদ্য, ওষুদের মত, এদের প্রভাব এতই প্রগাঢ় যে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য এদের অবদান অনস্বীকার্য।
২০০৭ সালে প্রখ্যাত ব্রিটিশ জর্নাল ল্যানসেটে একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছিল- ফলিক এসিড সাপ্লিমেন্ট যা মাঝে মাঝে গর্ভবতী নারীরা গ্রহণ করেন, এই ভিটামিন গ্রহণ করলে ৫০-৭০ বছর বয়সী লোকের বার্ধক্যজনিত বুদ্ধিবৃত্তির অধোগতি রোধ হয়।
তিন বছর ব্যাপী পরিচালিত একটি গবেষণায় নেদারল্যান্ডের ওয়াজিনেনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জেন দার্গা এবং সহকর্মীরা দেখেছেন যারা এসব সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করেছেন, এরা স্মৃতিশক্তি, তথ্য প্রক্রিয়াজাত করণের দ্রুতি এবং দ্রুত কথনের ব্যাপারে অনেক উন্নত ক্ষমতা প্রদর্শন করেন। এছাড়া এমন প্রমাণ রয়েছে যে ভিটামিন ফলেট ঘাটতি হলে বিষন্নতা হতে পারে এজন্য পরামর্শ রয়েছে প্রচুর পালংশাক খান, কমলার রস যাতে রয়েছে ফলিক এসিড।
ডা: গোমেজ পিনিলার আরও পরামর্শ হল, বেশি বেশি এন্টিএক্সিডেন্ট গ্রহণ করুন। ধারণাটি অবশ্য নতুন নয়। বার্ধক্যের প্রভাব থেকে সুরক্ষার জন্য এন্টিএক্সিডেন্ট।
যেমন ভিটামিন ‘ই’ যা রয়েছে উদ্ভিজ তৈল, বাদাম এবং সবুজ পত্রবহুল সবজিতে এটি গ্রহণ করলে স্মৃতিশক্তি উন্নত থাকে বলে ধারণা।
ডা: গোমেজ পিনিল্লা এন্টিঅক্সিডেন্ট নিয়ে বলেছেন অন্য কাহিনী। তার পর্যবেক্ষণ হল- মগজ সহজেই জারণজনিত ক্ষতির শিকার হয়। মগজ প্রচুর এনার্জি গ্রহণ করে এবং যে যে বিক্রিয়ায় এই এনার্জি উৎসারিত হয়, এরজন্য জারণ রাসায়নিক বেরিয়ে যায়।
বিভিন্ন ধরনের জাম ফল সমৃদ্ধ খাদ্যের গুরুত্ব তাই রয়েছে। এই ফলের রয়েছে শক্তিশালী এন্টিএক্সিডেন্ট প্রভাব। এর অনেক উপকরণের মূল্যায়নই হয়নি। অন্যতম উপকরণ পরিফেনোল ‘কারকুমিন’ এর রয়েছে সুরক্ষা ক্ষমতা। হলুদে রয়েছে এই ‘কারকুমিন’। এই উপমহাদেশে হলুদ প্রচুর ব্যবহৃত হয় রন্ধনে এজন্যই কি আলঝাইমার রোগ এ থাকলে তত দেখা যায় না।
এন্টিঅক্সিডেন্ট মগজের সুরক্ষা কিভাবে করে তা স্পষ্ট জানা যায়নি। ডা: গোমেজ পিনিল্লার মতে সম্ভবত: এটি সিনাপটিক মেমব্রেমকে রক্ষা করে। স্নায়ু কোষদের মধ্যে সংযোগস্থল হল সিনাপস্ বা স্নায়ুসন্ধি, শোবার ক্ষমতা ও স্মৃতিশক্তির জন্য কেন্দ্রে রয়েছে এই স্নায়ুসন্ধি, তবে এটি মগজের সবচেয়ে নাজুক অংশও বটে। মগজের কাজকর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত অনেক পুষ্টি উপকরণ স্নায়ুসন্ধিতে স্নায়ু সংকেতের সম্প্রচারের সঙ্গে জড়িত।
একটি ওমেগাও মেদঅম্ল হলো ডকোসাহেক্সাইনয়িক এসিড, স্নায়ুসন্ধিতে সংকেত সম্প্রসারে সহায়তা করে, স্নায়ুসন্ধিতে দেয় নমনীয়তা যা স্মৃতিশক্তির জন্য প্রয়োজনীয়। স্নায়ুকোষ ঝিল্লীর ৩০% চর্বি হলো ডিবইচত্র অনু।
ওমেগা৩ মেদঅম্লের হিতকরী প্রভাবের মধ্যে আছে শেখার ক্ষমতা ও স্মৃতিশক্তির উন্নতি, বিষণ্নতা ও অন্যান্য মানসিক রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা।
ওমেগা৩ রয়েছে তৈলাক্ত মাছ যেমন স্যালমন মাছে, আখরোটে। যেসব দেশে মানুষ প্রচুর মাছ খান এদের মধ্যে ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন কম। এজন্যই কি এত দুঃখের মধ্যেও মাছে ভাতে বাঙালির পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সুখী মানুষ। এছাড়া জাপানের দ্বীপ ওকিনাওয়াতে মানুষের মধ্যে মানসিক বৈকল্য নেই বললেই চলে। এই দ্বীপের মানুষ প্রচুর মাছ খান এমনকি মাছ খেকো জাপানের লোকের চেয়েও বেশি।
অথচ অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, যে সব খাবারের ট্রান্স ফ্যাট ও স্যাচুরেটেড ফ্যাট বেশি যেমন ফাস্টফুড, ভাজা খাবার, মাখন, কেক, পেস্ট্রি এসব বেশি খেলে বুদ্ধিবৃত্তির উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে।
সুস্থ মগজের জন্য চাই ভাল, স্বাস্থ্যকর খাবার। তবে একটি সতর্কবাণী রয়েছে- অতিভোজন নৈবচ। এর ফলে মগজে পড়ে জারনজনিত চাপ আর এন্টিএক্সিডেন্ট যেসব হিতকরী কাজ করবে এও তখন মিলিয়ে যাবে অতিভোজনে।
রাতের খাবারে ব্রেন ফুড কি থাকতে পারে এ নিয়ে পরামর্শ যদি থাকে?
শুরু : পালংশাক, বীট, গাজর, শসা ও লেটুস এর স্যালাড, জলপাই তেল আদা রসুন।
এরপর : হলুদ কাঁচামরিচ জিরা ফোড়ন দিয়ে মাছের ঝোল, তৈলাক্ত মাছ যেমন ইলিশ হলে ভাল। সঙ্গে আলু ভর্তা, ফুলকপি সেদ্ধ, এক কাপ ভাত বা দুটো রুটি।
একটু মিষ্টান্ন : জাম, আঙ্গুর, বাদাম দিয়ে মেশানো চকোলেট দুধ। এরপর গ্রীন টি/ এক গ্লাস দুধ/ কমলার রস। এরপর নিন্দ্রা কিছুক্ষণ পর।
অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক,
ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস,
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, জুন ২০, ২০০৯
Leave a Reply