ধারণা করা হয়, বর্তমানে পৃথিবীতে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ২৫ কোটি, ২০০৩ সালেও যা ছিল ১৯·৪ কোটি। আর এভাবে চলতে থাকলে ২০২৫ সাল নাগাদ পৃথিবীতে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৩৮ কোটি। বাংলাদেশে তা দাঁড়াবে বর্তমানের লোকসংখ্যার প্রায় অর্ধেক অর্থাৎ সাড়ে সাত কোটি। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের হিসাবমতে, প্রতি ১০ সেকেন্ডে একজন মৃত্যুবরণ করে ডায়াবেটিস এবং তার দ্বারা সৃষ্ট জটিলতার কারণে। প্রতি ১০ সেকেন্ডে দুজন নতুন করে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। কাজেই যে কারও পক্ষেই সম্ভব এর ভয়াবহতা আঁচ করা।
জাতিসংঘ ঘোষণা ভয়াবহতা দূর করতে দরকার সর্বক্ষেত্রে সমন্বিত উদ্যোগ। সময়োপযোগী এবং যথার্থই জাতিসংঘ ঘোষণা-ডায়াবেটিস একটি দীর্ঘমেয়াদি, অবক্ষয়ী ও ব্যয়বহুল রোগ, যা অনেক মারাত্মক জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে এবং এ রোগ এখন পরিবার, রাষ্ট্র ও সারা বিশ্বের জন্য চরম হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০০৬ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এ ঘোষণার পক্ষে ৬১/২২৫তম প্রস্তাব গৃহীত হয়। সে অনুযায়ী ২০০৭ সাল থেকে প্রতিবছর ১৪ নভেম্বর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসকে একটি জাতিসংঘ দিবস হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসকে স্বীকৃতি দিয়ে এবং বিশ্বব্যাপী এ রোগের ক্ষতিকর প্রভাবকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে জাতিসংঘ ডায়াবেটিসের বিরুদ্ধে সংগ্রামে একাত্মতা প্রকাশ করেছে।’
এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ১৯৯১ সাল থেকে এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন ১৭টি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করে এ দিবসটিকে পালন করেছে।
বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসে এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়ঃ ‘শিশু-কিশোরদের ডায়াবেটিস’-এমনকি ২০০৮ সালেও একই বিষয়ে এ দিবসটিকে পালন করা হবে। কারণ, বর্তমান হিসাব অনুযায়ী শৈশব ও কৈশোরের সবচেয়ে সাধারণ অথচ দীর্ঘমেয়াদি রোগ হচ্ছে ডায়াবেটিস।
এটি শিশুদের যেকোনো বয়স-এমনকি নবজাতক অবস্থায়ও ধরা পড়তে পারে। সমীক্ষা অনুযায়ী, সারা পৃথিবীতে এ বয়সে ডায়াবেটিসে (টাইপ-১ ডায়াবেটিস) আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার লাখ। আর এসব শিশুর সিকি ভাগই অবস্থান আমাদের এ অঞ্চলে অর্থাৎ সাউথ-ইস্ট এশিয়ায়। আগে একসময় ধারণা করা হতো, ডায়াবেটিস মূলত প্রাপ্তবয়স্কদের রোগ, তবে শিশুদের কদাচিৎ হয় বৈকি।
এ ধারণার এখন পরিবর্তন হয়েছে। শিশুদের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার হার এখন আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আরেক হিসাব অনুযায়ী, ১৫ বছরের নিচের শিশু ও কিশোরদের মধ্যে সারা বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় ২০০ শিশু-কিশোর নতুন করে ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
জন্মগত কিংবা পরিবেশগত কিছু কারণ ছাড়া শিশু-কিশোরদের ওজনাধিক্য ও মেদবাহুল্যই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার মূল কারণ। বিশ্বজুড়ে শিশুরা এখন খেলাধুলা, সাঁতার কিংবা সাইকেল চালানোর চেয়ে ঘরে বসে টিভি দেখা এবং কম্পিউটারে ভিডিও গেমস খেলে সময় বেশি পার করছে। কাজেই একদিকে এ ধরনের অভ্যাসে শারীরিক পরিশ্রম কমে যাওয়া, অন্যদিকে অতিমাত্রায় উচ্চ ক্যালরিযুক্ত জাংক এবং ফাস্টফুডে অভ্যস্ত হওয়ার দরুন শিশু-কিশোরদের মধ্যে এ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে।
শিশুদের ডায়াবেটিসঃ শিশুদের ডায়াবেটিস বয়স্কদের চেয়ে কিছুটা হলেও বেশি স্পর্শকাতর। কত ক্ষেত্রে শিশুরা বুঝতেই চায় না তার সমস্যা সম্পর্কে। তারপর নিয়মিত ওষুধ সেবন, ইনসুলিন নেওয়া, রক্তের সুগার মনিটর, খাদ্য গ্রহণে ভারসাম্যতার কড়াকড়ি তো আছেই। আর এসবই একটি শিশুর সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশকে ব্যাহত করতে পারে। কাজেই এ বিষয়ে পুরো পরিবারকে সংশ্লিষ্ট হতে হবে।
বুঝতে হবে, শিশু-কিশোরদের ডায়াবেটিস হওয়ার অর্থই সারা জীবনের জন্য এ পরিস্থিতি মেনে নেওয়া। এ জন্য রক্তের সুগার সুষ্ঠুভাবে সুনিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি শিশু-কিশোরের মানসিক ও দৈহিক বৃদ্ধি এবং বিকাশ যেন স্বাভাবিক থাকে, সে বিষয়েও খেয়াল রাখতে হবে। দরকার হলে বাড়ির বাইরের পরিবেশেও যেমনঃ স্কুলে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত শিশু-কিশোরের যত্নের ব্যবস্থা করতে হবে। দরকার হলে ডায়াবেটিসের মূল চিকিৎসকের পাশাপাশি একজন মনোচিকিৎসক এবং পুষ্টিবিদের সমন্বয়ে একটি টিম তৈরি করে ডায়াবেটিক শিশু ও তার পরিবারকে শারীরিক-মানসিক সব ধরনের সহযোগিতা দিতে হবে।
নির্ভরতা প্রতিরোধঃ যেহেতু ডায়াবেটিস হওয়ার অর্থই হলো এ রোগকে সারা জীবন বহন করা, কাজেই সবচেয়ে উত্তম হলো ডায়াবেটিস যেন শরীরে বাসা না বাঁধতে পারে। তা শিশু-কিশোর হোক, আর বয়স্কই হোক। এটাই প্রাথমিক প্রতিরোধ। প্রয়োজন অতিরিক্ত আহার বর্জন এবং পরিমিত পুষ্টিমানের আহার গ্রহণের পাশাপাশি কায়িক পরিশ্রম।
অর্থাৎ বয়স, ওজন ও উচ্চতা অনুযায়ী ঠিক যতটুকু খাবার দরকার, একজন পুষ্টিবিদের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত বিরতিতে ঠিক ততটুকু খাবারই খাওয়া প্রয়োজন এবং সেই খাবার অনুযায়ী রক্তে যতটুকু গ্লুকোজ জমা হলো, তারও সমন্বয়সাধন জরুরি। কাজেই পরিমিত কায়িক শ্রম না হলে নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। শিশু-কিশোরদের বেলায় নিয়মিত খেলাধুলাই যথেষ্ট।
শিশুরা জ্নগতভাবেই ছোটাছুটি ও খেলাধুলা পছন্দ করে। কিন্তু অতি উচ্চ ক্যালরিমানের অতিরিক্ত খাবারের (জাংক ও ফাস্টফুড) জন্য অতিরিক্ত মোটা হওয়ায় এ প্রবণতা কমতে পারে। এ ক্ষেত্রে খেলার ছলে কিংবা আনন্দের মাঝে এ প্রবণতা বাড়াতে হবে। আর ডায়াবেটিসে আক্রান্ত শিশু-কিশোরদের জন্য তো এগুলো বাধ্যতামূলক।
শিশু-কিশোরদের যথেষ্ট সময় দিয়ে ডায়াবেটিস রোগ সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে, যাতে তারা নিজেরাই খাবার ও নিয়মিত ব্যায়ামের গুরুত্ব বুঝতে পারে। শিশুদের বোঝাতে হবে, ডায়াবেটিস অর্থাৎ রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণে না থাকলে এর ফলস্বরূপ কী কী জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাদের বোঝাতে হবে, তারা আর দশটা স্বাভাবিক শিশুর মতোই, উপরন্তু তাদের মাঝে বাড়তি একটা মেডিকেল কনডিশন আছে, যার যত্ন ওকেই নিতে হবে।
আর সব কিছুর পেছনে আছে সামগ্রিক সচেতনতা। একমাত্র সচেতনতাই পারে বিশ্বজনীন স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ভয়াবহ হুমকিস্বরূপ এ অসংক্রামক ব্যাধির হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে। কাজেই আসুন সবাই মিলে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করি। বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসের গুলোগানও তাই।
লেখকঃ ডা· ফজলে রাব্বী খান
উৎসঃ দৈনিক প্রথম আলো, ১৪ নভেম্বর ২০০৭
Leave a Reply