ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, ঋত্বিক রোশন, টম ক্রুজ—তিনটি ভিন্ন জগতের এই তিন মানুষের মধ্যে মিল কোথায় বলতে পারেন? টিভির পর্দায় তাঁদের ছবি বা বিজ্ঞাপন সামনে এলেই সবার আগে যেটি চোখে পড়ে, তা হলো তাঁদের সুঠাম দেহ আর ‘সিক্স প্যাক’।
মিডিয়ার বদৌলতে সিক্স প্যাক দারুণ জনপ্রিয়। এখন সিক্স প্যাক তৈরির হুজুগ কেবল আর অভিনেতা কিংবা খেলোয়াড়দের মধ্যে আটকে নেই। ফিটনেস–সচেতন কমবেশি সবারই লক্ষ্য এখন সিক্স প্যাক। প্রিয় অভিনেতা কিংবা খেলোয়াড়ের সিক্স প্যাক দেখে তাঁর মতো হতে চাওয়া দোষের কিছু নয়। কিন্তু পর্দায় দেখানো মডেলদের মতো সিক্স প্যাক তৈরি স্বাস্থ্যকর তো নয়ই, হতে পারে স্বাস্থ্যঝুঁকির বড় কারণ।
সুস্থ–সবল দেহের জন্য শরীরচর্চার বিকল্প নেই। পুশ-আপ, সিট-আপ, সকাল-বিকেল দৌড়ানো কিংবা সাইক্লিং—সবই উপকারী। কোনোটিই শরীরের ওপর বাজে প্রভাব ফেলে না। বরং শরীরকে যেমন সুস্থ রাখে, তেমনই মনকে রাখে সতেজ ও উৎফুল্ল। কিন্তু সিক্স প্যাক পুরোপুরি ভিন্ন বিষয়। শুধু সকাল-বিকেল শরীরচর্চা দিয়ে সিক্স প্যাক তৈরি করা সম্ভব নয়। বরং প্রয়োজন কড়া ডায়েট, সঙ্গে নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন। তৈরি করতে হবে বাঁধাধরা একজীবন, যেখানে শরীরচর্চাই হবে মূল লক্ষ্য। কিছু ক্ষেত্রে সিক্স প্যাকের ৮০ শতাংশই ডায়েটের ওপর নির্ভর করে।
সিক্স প্যাক তৈরির জন্য প্রথমত প্রয়োজন শরীরের বেশীরভাগ চর্বি ঝরিয়ে ফেলা। এর ভেতর রয়েছে গুড ফ্যাটও। শুনে মনে হতে পারে, সেটা তো শরীরের জন্য ভালোই। কিন্তু অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়। সিক্স প্যাক তৈরির জন্য শরীরে চর্বির পরিমাণ কমিয়ে ১০ শতাংশের নিচে নিয়ে আসতে হয়। নারীদের ক্ষেত্রে সেটা আবার ১৫ শতাংশ। চর্বির পরিমাণ এর থেকে বেশি হলে সাধারণত পেটের মাসল ফুটে উঠে না।
শরীরে চর্বির পরিমাণ অস্বাভাবিকরকম কমে গেলে তার প্রভাব পড়ে শরীরের নিয়মিত কাজে। শুনে মনে হতে পারে, শরীরে চর্বিই তো সব সমস্যার মূল, কিন্তু বাস্তবতা তা নয়। শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, হরমোনের মাত্রা বজায় রাখা, এনজাইম তৈরি করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকে চর্বি। আমেরিকান কাউন্সিল অন এক্সারসাইজের (এসিই) একটি নির্দেশিকা অনুসারে, একজন সুস্থ–কর্মক্ষম পুরুষের শরীরে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ও নারীর শরীরে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ চর্বি থাকা প্রয়োজন। নইলে স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় কাজের ওপর প্রভাব পড়ে। কিন্তু সিক্স প্যাকের জন্য এটুকু চর্বিও অনেক চর্বি। তাই সেটুকুও ঝড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দেন ট্রেইনাররা।
সিনেমা বা টিভি পর্দার সিক্স প্যাক তো আরও এক ধাপ ওপরে। তারকাদের শরীরে দেখানো মাসলের বেশির ভাগই অর্জন করা হয় এক্সট্রিম ডায়েটের মাধ্যমে। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো তাঁর সিক্স প্যাক অর্জনের জন্য শরীরে চর্বির পরিমাণ নামিয়ে এনেছেন ৬ শতাংশে, যা সাধারণ কারও পক্ষে অর্জন করা ও ধরে রাখা, উভয়ই অসম্ভব।
একই কথা অভিনেতাদের ক্ষেত্রেও। পর্দায় দেখানো শার্টহীন দৃশ্যের প্রায় তিন-চার মাস আগে থেকে শুরু হয় কঠোর ডায়েট। সে ডায়েটে খাবার থেকে শুরু করে পানির পরিমাণ পর্যন্ত নির্দিষ্ট করে দেওয়া থাকে। যাতে শরীর তার সবটুকু চর্বি চুষে নেয় আর পর্দায় জাঁকালোভাবে ফুটে উঠে অভিনেতাদের সিক্স প্যাক। সুপারম্যান চরিত্রে হেনরি ক্যাভিল, উলভারিন চরিত্রে হিউ জ্যাকম্যান থেকে শুরু করে বলিউডের শাহরুখ খান, আমির খান—সবাই এই কঠোর নিয়মের মধ্যে দিয়েই গিয়েছেন।
আশির দশকে হলিউডজুড়ে সিক্স প্যাক ট্রেন্ড তৈরি করা অভিনেতা সিলভেস্টার স্ট্যালন ‘রকি থ্রি’ সিনেমার বিখ্যাত ‘ফাইট’ দৃশ্য ধারণের আগের তিন দিন পানি স্পর্শ করেননি। এক দিনে ২৫ কাপ কফি পান করেছেন শুধু পর্দায় নিজেকে পেশিবহুল দেখানোর জন্য।
সিক্স প্যাক শরীরের জন্য মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। এটি তৈরির প্রক্রিয়াও অস্বাস্থ্যকর। বাহ্যিক সৌন্দর্যের বাইরে এর বিশেষ কোনো উপকারিতা বা কার্যকারিতাও নেই। বরং সিক্স প্যাক অর্জন করা যতটা কঠিন, ধরে রাখা তার থেকেও বেশি কঠিন। শরীর ও মনের সুস্থতার জন্য শরীরচর্চার বিকল্প নেই। কিন্তু সেই শরীরচর্চার মানদণ্ড যেন হয় সুস্থ দেহ। সুঠাম দেহের পেছনে ছুটতে গিয়ে যেন শরীর আর মনের সুস্থতা হারিয়ে না যায়, সেদিকে লক্ষ রাখার দায়িত্ব কিন্তু আপনারই।স
সূত্র: মেনস জার্নাল ডটকম
মৃণাল সাহা
সোর্স : প্রথম আলো
Leave a Reply