আমি বাবা হতে চলেছি। জানি না হবু মা অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর হবু বাবারও ফাদার হরমোন নিঃসৃত হয় কি না! কিন্তু প্রথমবার বাবা হতে যাওয়ার ঘটনা আমাকে মিশ্র অনুভূতি দিচ্ছে। একদিকে আনন্দ, আরেক দিকে দুশ্চিন্তা—একদিকে উত্তেজনা আরেক দিকে দ্বিধা। বাবা হওয়ার চেয়ে ‘ভালো বাবা’ হতে পারব কি না—এটা নিয়েই বেশি চিন্তিত।
ঝড়–বৃষ্টির মাস এপ্রিলে আমার জন্ম। বউকে নিয়ে সেই এপ্রিল মাসে এবার সমুদ্রে ঘুরতে গিয়েছিলাম। সমুদ্রের বিশালতার সামনে দাঁড়িয়ে আমি আর প্রমি (আমার স্ত্রী) সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা বাচ্চা নিয়ে নেব। এরপর এক বৃষ্টিস্নাত ভোরে ঘুম থেকে তুলে প্রমি আমাকে খবরটা দিল। জানাল, সে মা হতে যাচ্ছে। খুশিতে সঙ্গে সঙ্গে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘উত্তরাধিকার’ কবিতাটি পাঠ করি। আমার পাগলামি দেখে প্রমি হাসে। গর্ভকালীন সবার নজর মায়ের দিকেই থাকে। আর সেটাই হওয়া উচিত। তবে এই প্রথম আমি স্ত্রীকে নিয়ে ঈর্ষান্বিত, কেননা সন্তান ধারণের মতো জটিল ও গৌরবের কাজটি নারীর জন্যই রেখে দেওয়া। কিন্তু হবু বাবার তখন কেমন লাগে, তার খবর কজন রাখে?
শারীরিক পরিবর্তনের পাশাপাশি আমার স্ত্রীর হরমোনাল পরিবর্তনগুলো দ্রুত ঘটতে থাকে। তার মেজাজ–মর্জিতেও পরিবর্তন শুরু হয়। যদিও তাঁর এমন পরিবর্তনে আমি মোটেও ঘাবড়ে যাইনি। এ অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি আগে থেকেই রেখেছিলাম। তবে প্রমি নিজেই অনেক লক্ষ্মী। শুরু থেকেই সতর্ক। নিজের জন্য ঢিলাঢালা জামা বানিয়েছে। বাইরে ঘোরাফেরা মোটামুটি জলাঞ্জলি দিয়েছে।
ডাক্তার বলেছেন, হবু মা যেন সব সময় হাসিখুশি থাকে, বই পড়ে, ক্রিয়েটিভ কাজ করে। আমিও দেরি করে অফিস যাই, দ্রুত কাজ সেরে বাসায় চলে আসি। ছোটবেলা থেকে দুধ–ডিম খেতে পারে না প্রমি। অনাগত সন্তানের জন্য সে পানি দিয়ে ডিম গিলে খাওয়া শুরু করে। পপকর্ন ও চায়ের জায়গা দখল করে ফল আর দুধ।
তবে আমরা আমাদের জীবনকে একেবারে তালাবদ্ধ করে ফেলিনি। সব সময় লক্ষ রাখি প্রমি যাতে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস পায়। প্রাধান্য তালিকায়ও পরিবর্তন এসেছে। এই সময়ে আমার সব কটি ভ্রমণ পরিকল্পনা বাদ দিয়েছি, বন্ধুদের সঙ্গে আর বাইরে আড্ডা দিই না। কিন্তু ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে’ বোঝাতে বাসায় বন্ধুদের ডেকে প্রমিসহ আড্ডা দিই। আনন্দে কেটে যাচ্ছে সময়। তবে এসবের মধ্যে কখনো অসতর্ক হইনি। প্রমিকে বুঝিয়েছি, ‘প্রেগন্যান্সি একটি প্রাকৃতিক বিষয়, জীবনের একটি অংশ।’ অনেকেই স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা হলে বলেন সে অসুস্থ। আমি শুরু থেকেই সতর্ক ছিলাম প্রমিকে যাতে কেউ অসুস্থ না বলে। যে প্রক্রিয়ায় আপনি–আমি সবাই পৃথিবীতে এলাম, এটি তো চমৎকার ও পবিত্র একটি বিষয়, অসুস্থ কেন বলব!
আমরা সিলেটে থাকি। হাসপাতালে যাওয়ার পথে সামান্য একটা ঝাঁকিতেও সিএনজিচালকের সঙ্গে ঝগড়া করেছি। পরে ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তাগুলোতে সিএনজি থেকে নেমে হেঁটে যেতাম আমরা। প্রথম তিন মাস পার হওয়ার পরই দুশ্চিন্তা কিছুটা কমতে থাকে। আস্তে আস্তে কাছের মানুষ জানতে শুরু করল। তারা আমাদের পরামর্শ দিত, সাহস দিত।
বাইরে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ, তাই বিকেল হলেই আমরা ছাদে চলে যাই। কাপড় মেলার তার ধরে প্রমি দাঁড়িয়ে থাকে, আর আমি সারা দিনের সব গল্প করি। এবার তো গরমও অনেক পড়েছিল, সেই সঙ্গে লোডশেডিং। ওর গরম কমাতে চারতলার ছাদে বালতির পর বালতি পানি ঢেলেছি। একসঙ্গে গাছের পরিচর্যা করেছি।
দ্বিতীয় ধাপের পর বেবিবাম্প উঁকি দিতে শুরু করলে অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখতে শুরু করি, যার বেশির ভাগ সন্তানকেন্দ্রিক। আমাদের বিবাহবার্ষিকীর দিন, রাত ১০টা কি ১১টা হবে, প্রমি আমার হাতটা পেটের ওপর রাখতেই দ্রুত কিছু একটা আমার হাতে লাথি দেয়। তখন কী যে একটা অনুভূতি আমার হয়, কিছুতেই সেটা লিখে ওঠা সম্ভব নয়। প্রথমবার একটি প্রাণের সাড়া পেলাম। আমার সন্তান, আমাদের প্রথম সন্তানের প্রথম কিক। প্রমি আমি দুজনই জড়াজড়ি করে কাঁদতে থাকি।
গর্ভধারণ–সংক্রান্ত বিভিন্ন বই পড়তে শুরু করলাম। গর্ভবতী মায়েদের শরীরে পর্যাপ্ত পটাশিয়াম, আয়রন, সোডিয়াম ইত্যাদি পুষ্টিকণা থাকতে হয়। কচুশাক, মুখি, লতা, কলা খাওয়ানোর পাশাপাশি কয়েকটি আয়রনের ইনজেকশন দেওয়ার পর প্রমির আয়রন লেভেল ঠিক হয়। দিন যত যাচ্ছে, আমাদের অনাগত সন্তানের নড়াচড়া তত বাড়ছে।
আমি পরিবারের বড় ছেলে, প্রমিও তার পরিবারের বড় মেয়ে। সুতরাং আমার সন্তান আগমনের ঘটনায় দুই পরিবারেই আনন্দের বন্যা বইছে। আমার বাবা তো বাসাই বদলে ফেলেছেন।
সবকিছু ঠিক থাকলে আমাদের সন্তান কয়েক সপ্তাহ পরেই পৃথিবীতে আসবে। আমরা দুজনই এখন তার অপেক্ষায় দিন গুনছি।
লেখক: খলিলুর রহমান
উপপরিচালক, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
সোর্স : প্রথম আলো
Leave a Reply