চোখের সঙ্গে ডায়াবেটিস রোগের সম্পর্ক খুবই গভীর। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে অন্ধত্বের আশঙ্কা একই বয়সের ডায়াবেটিসমুক্ত লোকের তুলনায় ২৫ গুণ বেশি। ডায়াবেটিস হলে চোখের প্রত্যঙ্গ রেটিনায় যে পরিবর্তন হয়, তা রোগীর গড় আয়ুষ্কালের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। অর্থাৎ যিনি ডায়াবেটিস নিয়ে যত দীর্ঘ সময় বাঁচবেন, তাঁর রেটিনায় ডায়াবেটিসজনিত জটিলতার আশঙ্কা তত বেশি বাড়বে। রেটিনার এই জটিলতা বয়স্ক রোগীদের অন্ধত্বের অন্যতম প্রধান কারণ। তা ছাড়া ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখলে চোখের নানা রকম সমস্যা দেখা দিতে পারে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে যার পরিণতি অন্ধত্ব।
দৃষ্টির তারতম্যঃ অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের রোগীদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় দৃষ্টিশক্তির তারতম্য দেখা দেয়। রক্তে চিনির মাত্রা ওঠানামার সঙ্গে দৃষ্টিশক্তির তারতম্য দেখা যায়। রোগী হয়তো একসময় কোনো ক্যালেন্ডার বা ছবি স্পষ্ট দেখছেন আবার অন্য সময় ওই ছবি বা ক্যালেন্ডারটি স্পষ্ট দেখছেন না। অনেক সময় দেখা যায়, স্বল্প সময়ের ব্যবধানে চশমার পাওয়ার বদলিয়েও স্বস্তি পাচ্ছেন না। এসব ক্ষেত্রে দুই ধরনের রোগী দেখা যায়।
এক· নির্ণীত ডায়াবেটিসের রোগী হয়েও ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় জীবন যাপনকারী-চিকিৎসকের পরামর্শ থাকা সত্ত্বেও কিছুটা স্বেচ্ছায় বা কিছুটা অপারগতায় নিয়মিত প্রস্রাব পরীক্ষা, খাদ্যনিয়ন্ত্রণ, ওষুধ সেবন ইত্যাদি শৃঙ্খলার সঙ্গে পালন করছেন না।
দুই· অনির্ণীত ডায়াবেটিসের রোগী; ব্যক্তি জানতেনই না যে তিনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, চশমা নিতে এসে তাঁর ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে।
একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। চল্লিশোর্ধ্ব একজন নারী একদিন আমার কাছে এসে চোখ পরীক্ষা করান। উদ্দেশ্য চশমা নেওয়া। চোখের সমস্যা ছাড়া অন্য কোনো অসুবিধা আছে কি না জানতে চাই। তিনি জানান, তাঁর কোনো সমস্যা নেই। চশমা নেওয়ার সপ্তাহখানেক পরই তিনি এসে বললেন, ‘ডাক্তারসাহেব, চশমা আমার মোটেই ভালো লাগছে না, বরং চশমা ছাড়াই ভালো লাগে, ভালো দেখি।’ আবার চোখ পরীক্ষা করা হলো। রোগীর দূরের পাওয়ার যেখানে ছিল +১·৫০ ডিএস, সেখানে পুনরায় পরীক্ষায় দেখা গেল তাঁর কোনো পাওয়ারই লাগছে না। সন্দেহ হওয়ায় ডায়াবেটিস নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করাই। তাঁর ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আনার পর চশমায় প্রদত্ত পাওয়ারে তাঁর দৃষ্টিশক্তির অসুবিধা আর রইল না।
তাই দেখা যাচ্ছে, ঘন ঘন দৃষ্টিশক্তির তারতম্যের শিকার রোগীর ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস থাকা অস্বাভাবিক নয় এবং চশমার পাওয়ার পরিবর্তনের আগে রোগটির সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ দরকার। ছয় সপ্তাহ বা তার চেয়ে বেশি সময় ধরে ডায়াবেটিসের সন্তোষজনক নিয়ন্ত্রণ ছাড়া নতুন চশমার জন্য পরামর্শ দেওয়া ঠিক নয়।
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথিঃ ডায়াবেটিসজনিত রেটিনার অসুস্থতার নাম ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি। এখানে রেটিনা সম্পর্কে সামান্য বলা দরকার।
আমাদের চোখের তিনটি আবরণ রয়েছে। সবচেয়ে ভেতরের আবরণটির নাম রেটিনা। আমরা রেটিনার সাহায্যে দেখি। দৃশ্যমান বস্তু থেকে আলোকরশ্মি রেটিনায় পড়ে প্রতিচ্ছবি তৈরি করে। রেটিনা ধারণকৃত ওই প্রতিচ্ছবিটি অপটিক নার্ভের মাধ্যমে মস্তিষ্কে প্রেরণ করে এবং এর জন্যই দৃষ্টির অনুভূতি সৃষ্টি হয়। পরিষ্কার দৃষ্টির জন্য সুস্থ রেটিনা অপরিহার্য। তাই রেটিনা কোনো কারণে রোগাক্রান্ত হলে চোখের মূল কাজে বিঘ্ন ঘটে, যার অন্য নাম অন্ধত্ব। দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়ার বিষয়টি রেটিনার অসুস্থ অংশের অবস্থান ও মাত্রার ওপর নির্ভরশীল।
সারা বিশ্বে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বয়স্ক রোগী ডায়াবেটিসের জন্য অকাল অন্ধত্বের শিকার হন। যুক্তরাষ্ট্রের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতিবছর বয়স্ক নতুন অন্ধ রোগীদের মধ্যে ১৯·১ শতাংশ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথিতে আক্রান্ত। আমাদের দেশে এ সংখ্যা এখনো অজ্ঞাত। রেটিনোপ্যাথির তিনটি পর্যায় বা ধাপ রয়েছে। এ তিনটি ধাপ রেটিনায় সৃষ্ট জটিলতার তীব্রতার ওপর ভিত্তি করে নির্ণীত। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের সন্তোষজনক চিকিৎসা সম্ভব। কারণ এ দুটি ধাপে রেটিনা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। কিন্তু তৃতীয় ধাপটির চিকিৎসা বেশ কঠিন। এ ধাপটির শুরু এক ধরনের নতুন, দুর্বল অস্বাভাবিক রক্তনালিকার উদ্ভব দিয়ে। এসব রক্তনালিকা ক্ষণভঙ্গুর। ফলে রেটিনায় প্রতিনিয়ত রক্তক্ষরণের জন্য নতুন নতুন স্থান আক্রান্ত হয়। এসব আক্রান্ত স্থানে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়, তা সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য নয়। ডায়াবেটিসের দীর্ঘ সময় অবস্থানের জন্য শরীরের কোষকলার জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় ব্যাপক পরিবর্তনের জন্য রেটিনোপ্যাথি দেখা দেয়। তবে রেটিনোপ্যাথির এক ধাপ থেকে অন্য ধাপে রৃপান্তর ডায়াবেটিসের অনিয়ন্ত্রণ ও তীব্রতার ওপর নির্ভর করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখলে প্রথম ধাপ থেকে দ্বিতীয় ধাপে রূপান্তর অবশ্যই বিলম্বিত হবে। কিন্তু ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রিত না হলে প্রথম ধাপ থেকে দ্বিতীয় ধাপে কিংবা দ্বিতীয় ধাপ থেকে তৃতীয় ধাপে রেটিনোপ্যাথির রৃপান্তর স্বল্প সময়ের মধ্যেই ঘটতে পারে। ডায়াবেটিসের তীব্রতা প্রসঙ্গেও একই কথা প্রযোজ্য। রেটিনোপ্যাথির জটিলতা থেকে মুক্ত থাকার জন্য ডায়াবেটিসের সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ জরুরি। নির্দিষ্ট সময়ে শরীরের চেকআপ, রক্তে চিনির মাত্রা নির্ধারণ ও চোখ পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া উচিত। ইনসুলিন-নির্ভর নন এমন রোগীদের ডায়াবেটিস নির্ণীত হওয়ার পাঁচ বছর পর থেকে প্রতিবছরই চোখ পরীক্ষা করানো উচিত।
লেখকঃ ডা· মো· শফিকুল ইসলাম
উৎসঃ দৈনিক প্রথম আলো, ০৫ ডিসেম্বর ২০০৭
Leave a Reply