ঘটনা
২৯ দিন বয়সের নবজাতক শিশু আহনাফকে (ছদ্মনাম) আনা হয়েছে জন্ডিসের কারণে। তার ওজন ৩ কেজি ২০০ গ্রাম, মাথার বেড় ৩৮ সেমি। মা-বাবা জানান, বিয়ের সাত বছর পরে তাঁদের এই প্রথম সন্তান এল। শিক্ষিত অভিভাবক।
শিশুকে শুধু বুকের দুধ খাওয়ান। এখন জন্ডিস বেড়ে যাওয়ার কারণে মা-বাবা অনেকটা জেদ করে শিশুকে বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে এসেছেন।
নবজাতকের জন্ডিস কী
নবজাতক শিশু, যারা স্বাভাবিক গর্ভকাল ও ওজনসমেত সুস্থভাবে জন্ম নেয়, তাদের ২৫ থেকে ৫০ শতাংশের উচ্চরক্ত বিলিরুবিনের মাত্রা (সাত মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার) বা দৃশ্যমান জন্ডিস দেখা যায়। আর অকালপ্রজ (প্রি-টার্ম) নবজাতকের ক্ষেত্রে এ হার আরও বেশি। কিন্তু দেখা যায়, এসব জন্ডিসের বেশির ভাগ ফিজিওলজিক্যাল বা নির্দোষ জন্ডিস।
নির্দোষ জন্ডিস নবজাতকের বেলায় ২৪ থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ধরা পড়ে এবং ১০-১২ দিন বয়সে এসে শিশু যদি সুস্থ স্বাভাবিক থাকে, ভালোভাবে মাতৃদুগ্ধ পান করে, তবে আপনা আপনি সেরে যায়।
মনে রাখা চাই, নবজাতকের জন্ডিস যদি প্রথম ২৪ ঘণ্টা বয়সে আবিভূêত হয় কিংবা তা যদি পূর্ণগর্ভকাল পাওয়া নবজাতকের ক্ষেত্রে সাত দিনের বেশি আর অকালজাত নবজাতকের ১৪ দিনের বেশি স্থায়ী থাকে, তবে অবশ্যই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হবে।
জন্মগত থাইরয়েড হরমোনবঞ্চিত শিশুর জন্ডিস হতে পারে
২৯ দিন বয়সে এসেও জন্ডিসে বিবর্ণ আহনাফের মুখমণ্ডল, বুক, পেট, হাত-পা হলুদাভ। নবজাতকের দীর্ঘস্থায়ী জন্ডিসের সঠিক কারণ শারীরিক পরীক্ষা ও কিছু ল্যাবরেটরি টেস্টের মাধ্যমে নির্ণয় করতে হয়। অন্য কোনো লক্ষণ প্রকট না থাকলেও শুধু প্রলম্বিত জন্ডিস এ চিহ্ন নিয়ে নবজাতক শিশুর হরমোন-সংকটজনিত সমস্যা কনজেনিটাল হাইপোথাইরয়েডিজম বা থাইরয়েড হরমোনের জন্মসময় থেকে অভাবজনিত সংকট প্রকাশ পেতে পারে। আহনাফের বেলায়ও তা-ই ঘটেছে। টি-৪-এর মাত্রা বেশ কম আর টিএইচএসের মাত্রা বেশ উঁচুতে।
থাইরয়েড গ্রন্থির জন্মত্রুটিজনিত সমস্যা। তার তাৎক্ষণিক চিকিৎসা শুরু হলো থাইরয়েড হরমোন ওষুধ সেবনের মাধ্যমে। বেশি বিলম্বে চিকিৎসাবঞ্চিত না হওয়ার কারণে আমরা আহনাফের সুস্থ-স্বাভাবিক দৈহিক-মানসিক বুদ্ধি বিকাশ ও সুন্দর হাসি দেখতে পাচ্ছি। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আরও কত আহনাফ যথাসময়ে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসাসেবা না পেয়ে শারীরিক ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মানবশিশুতে পরিণত হচ্ছে, কে বলতে পারে।
কনজেনিটাল হাইপোথাইরয়েডে ভোগা নবজাতকের লক্ষণ
থাইরয়েড গলগ্রন্থি থেকে নিঃসৃত থাইরয়েড হরমোন মানবমস্তিষ্কের বিকাশে অবশ্যপ্রয়োজনীয় উপাদান। এর অভাবে শিশুর দৈহিক বাড়ন ও বুদ্ধির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। শিশু হয় খর্বাকার ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। থাইরয়েড গ্লান্ডের জন্মগত সমস্যা নিয়ে জন্মানো নবজাতক কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্ম নেয়। ওজন ও উচ্চতা স্বাভাবিক থাকলেও মাথার বেড় কিছুটা বাড়তি থাকে।
বুকের দুধপানে সমস্যা, খসখসে ত্বক, দেহের নিস্তেজ নরম ভাব, মাথার পেছনের চাঁদি খোলা থাকা। দিনে একবার বা এরও কম পায়খানা, বৃহৎ আকৃতির জিহ্বা, কম নড়াচড়া, ফোলা, পানি জমা, মুখমণ্ডল ও নাভিতে হার্নিয়া-এসব লক্ষণ নবজাতকের কনজেনিটাল হাইপোথাইরয়েডিজম অসুখের বৈশিষ্ট্য বলে গণ্য করা হয়। দ্রুত রোগ নির্ণয় ও তাৎক্ষণিক হরমোন ওষুধ সেবনের মাধ্যমে নির্ভর করে শিশুর মঙ্গল। আহনাফকে চিকিৎসা করানোর উদ্দেশে নিয়ে আসার দিন সূর্য ওঠা সফল হয়েছে আমাদের সবার জন্য।
প্রণব কুমার চৌধুরী
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ১১, ২০০৯
Leave a Reply