ঘূর্ণিঝড় আইলা-দুর্গত এলাকায় আশ্রয়-খাবার-পানীয়র অভাবের খবর এখনো পত্রিকার পাতাজুড়ে। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, রোগবালাই ছড়িয়ে পড়তেই পারে। আমাদের সহমর্মিতা, সহযোগিতা আছে বলেই বাঁচার লড়াইয়ে জেতে উপকূলের মানুষ। যাঁরা বাড়িয়েছেন সাহায্যের হাত, সমন্বয় রাখুন কাজের-খেয়াল রাখুন জনস্বাস্থ্যের। স্বাস্থ্যকুশল-এর এই প্রতিবেদন ত্রাণ সহায়তাকারীদের জন্যও।
খাবার-দাবার
ঘূর্ণিঝড়জাতীয় দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে প্রথম যে অসুবিধা হয় তা হলো থাকা ও খাওয়া। মানুষ নিজের বাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নেয় নিরাপদ কোনো স্থানে, আত্মীয়ের বাড়ি কিংবা স্কুল-কলেজ বা সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে। এ সময় প্রাথমিক সমস্যা হয় খাবার-দাবারের। ত্রাণশিবিরের খাবার যদি শুকনো হয়, যেমন চিঁড়া, মুড়ি, গুড়, কলা-তাহলে ভালো। আর রান্না করা খাবার হলে খিচুড়ি গরম হওয়া ভালো। যতটা সম্ভব টাটকা খাবার খাওয়া ভালো।
শিশুর খাবার
এ সময় সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকে শিশুরা। খাওয়া-দাওয়া, পেশাব-পায়খানা, রোগবালাই সবকিছুতেই বিড়ম্বনা শিশুদের। ছোট শিশুদের বেলায়-যারা মায়ের দুধ খাচ্ছে, তাদের মায়ের দুধ চালিয়ে যেতে হবে। এ জন্য মায়ের খাবারে প্রাধান্য দিতে হবে। ছোট শিশুদের কোনোভাবেই বাসি খাবার দেওয়া যাবে না। অবশ্যই বিশুদ্ধ পানি খাওয়াতে হবে। এ সময় ডায়রিয়া বা পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয় শিশুরাই বেশি। প্রথমে দরকার নিরাপদ পানি, পানের জন্য এবং রান্নার জন্য। বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বা ফিটকিরি দিয়ে পানি বিশুদ্ধ করে নিতে হবে। টাইফয়েড, কলেরা, ডায়রিয়া, জন্ডিস, সর্দি-কাশি দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে নিকটস্থ চিকিৎসক দলের পরামর্শ নিতে হবে। টিউবওয়েল উঁচু জায়গায় স্থানান্তরের জরুরি ব্যবস্থা নিন। পানি ফিটকিরি বা ব্লিচিং পাউডার দিয়ে বিশুদ্ধ করে নেওয়া দরকার। পানের পানির সঙ্গে সঙ্গে রান্না ও গোসলের পানিও যথাসম্ভব পরিষ্কার হওয়া জরুরি।
অন্য আশ্রয়, অন্য ঠিকানা
একই জায়গায় গাদাগাদি করে মালামাল রাখা ও থাকা-খাওয়া থেকেই রোগবালাইয়ের সূত্রপাত ঘটে। গ্রাম এলাকায় গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি সম্ভব হলে বিক্রি করে দেওয়া অথবা নিরাপদ স্থানে সরিয়ে ফেলা ভালো। দেশলাই, মোমবাতি, সম্ভব হলে জ্বালানি খড়ি যথাসম্ভব হিসাব করে খরচ করুন। মজুদ রাখুন শুকনো খাবার। নিজের বুদ্ধিতে সিদ্ধান্ত নিন, অন্যের প্ররোচনায় ত্রাণের আশায় নিজ বাস্তু ছেড়ে শহরে ছুটবেন না; কাছাকাছি থাকুন, নিরাপদ আশ্রয়ে থাকুন।
রোগবালাই দূরে রাখুন
দুর্যোগ-পরবর্তী কয়েক দিন পর দেখা দিতে শুরু করে রোগবালাই। [ডায়রিয়া ও খাওয়ার স্যালাইনসংক্রান্ত বিস্তারিত বক্স পড়ুন।] এ সময় অনিরাপদ স্যানিটেশনের কারণে, বিশেষ করে শিশুদের পেটের পীড়া, কৃমির উপদ্রব বেড়ে যায়। যারা ত্রাণকাজে নিয়োজিত, সম্ভব হলে বাড়ির ছোট-বড় সবাইকে একযোগে একসঙ্গে কৃমির ওষুধ খাইয়ে দিন। রাতে শোয়ার সময় সবাই একসঙ্গে এলবেন্ডাজল ৪০০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট চুষে খেয়ে নিতে পারেন।
হাত-পায়ে ঘা কিংবা ফাঙ্গাসজাত চর্মরোগ দেখা দিতে পারে। যতটা সম্ভব নোংরা পানি এড়িয়ে চলুন। নোংরা পানিতে যদি নামতেই হয়, তখন পানি থেকে উঠে হাত-পা পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে শুকনো কাপড়ে মুছে নিন। ঢিলেঢালা পোশাক পরুন, ভেজা কাপড় কম পরুন। শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে খাবার-দাবার, ওষুধপথ্য দিন। যেকোনো রোগ হলে শুরুতেই চিকিৎসক দলের সাহায্য নিন।
বয়স্ক ক্রনিক রোগীদের প্রতি নজর রাখুন
অনেক পরিবারেই বয়স্ক পরিজন থাকেন, যাঁরা উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগের মতো ক্রনিক রোগে ভোগেন, নিয়মিত ওষুধ খেয়ে থাকেন। যাতায়াত ও যোগাযোগের অসুবিধার জন্য এঁদের ওষুধ ফুরিয়ে যেতে পারে। হয়তো টাকা থাকলেও সময়মতো ওষুধ পাওয়া যাবে না। তাই ত্রাণ সহায়তাকারী মেডিকেল টিমের সঙ্গে এ জাতীয় ক্রনিক রোগের ওষুধ থাকাটাও জরুরি।
প্রাথমিক পরিচর্যার জন্য ওষুধপথ্য
হাতের কাছে ওআরএস, প্যারাসিটামল, টেট্রাসাইক্লিন, মেট্রোনিডাজল, চর্মরোগের জন্য ছোট বোতলে বেনজাইল বেনজোয়েট, কৃমির ওষুধ পাইপেরাজিন সাইট্রেট, এলবেনডাজল এবং যথেষ্ট পরিমাণে ওয়াটার পিউরিফায়িং ট্যাবলেট সঙ্গে রাখুন। এ ছাড়া ছোটখাটো আঘাতজনিত কাঁটাছেড়ার জন্য গজ-ব্যান্ডেজ, সেলাই করার প্রাথমিক সার্জিক্যাল সরঞ্জামও ফার্স্ট এইড বক্সে থাকা জরুরি।
দুর্যোগ-পরবর্তী পরিচর্যা
পুনর্বাসনের সময় দেখা দেয় মূল বিপত্তি। চারদিকে স্যাঁতসেঁতে অবস্থা, কাদাপানিতে একাকার, যত্রতত্র পয়োনিষ্কাশন রোগবালাইয়ের সূতিকাগার। তাই স্থানীয় লোকজন মিলে দল গঠন করুন, স্বেচ্ছাসেবী দল, যারা বিশুদ্ধ পানি, নিরাপদ স্থানে পয়োনিষ্কাশন এবং রোগবালাই হলে দ্রুত চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত থাকবে সব সময়। এ সময়ই সুযোগ পাওয়া যায় প্রমাণের-মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য। আসুন, সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মোকাবিলা করি দুর্যোগ-পরবর্তী স্বাস্থ্য সমস্যার। বারবার বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস জীবন কাড়ে, দুর্যোগে দুর্ভোগ বাড়ে··· তবু বাঁচি লড়াই করে, মিলেমিশে।
দুর্যোগ-পরবর্তী ডায়রিয়া প্রতিরোধ
— বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির জন্য যদি সম্ভব হয়, পানি ফুটিয়ে ঠান্ডা করে পান করুন।
— যদি টিউবওয়েল পানিতে ডুবে যায়, তবে টিউবওয়েলের ওঠানো পানি থিতিয়ে নিন, সম্ভব হলে ফিটকিরি দিয়ে।
— যদি বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি পাওয়া না যায়, তবে নদী বা পুকুরের পানি ফিল্টার করে (পাতলা পরিষ্কার গামছা ব্যবহার করতে পারেন), প্রতি কলসে একটি পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বা এক চা-চামচ ব্লিচিং পাউডার দিয়ে পানি বিশুদ্ধ করে নিন।
— পানের সময় ক্লোরিনের গন্ধ লাগলেও বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দিয়ে পানি বিশুদ্ধ করে নিন।
— প্রতি লিটারে একটি পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ব্যবহার করুন।
— যেখানে পয়োনিষ্কাশনের শুকনো জায়গা নেই, সেখানে চলমান প্রবাহের পানিতে (বদ্ধ পানিতে নয়) জরুরি পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে পারেন, তবে ওই স্থানের পানি পানের জন্য ব্যবহার করা যাবে না।
— পুকুর ও অন্যান্য জলাশয়ের নোংরা পানিতে গোসল না করাই ভালো, এতে চর্মরোগ হতে পারে।
— যথাসম্ভব শুকনো খাবার ব্যবহার করুন ত্রাণ হিসেবে।
— কারও ডায়রিয়া দেখা দিলে আলাদা স্থানে তাকে পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা করে দিন, খাওয়ার স্যালাইন বারবার খাওয়ান।
— ডায়রিয়ায় মারাত্মক পানিশূন্যতা হলে দেরি না করে কাছের হাসপাতালে প্রেরণ করুন।
— বয়োজ্যেষ্ঠ ও শিশুদের প্রতি আলাদা নজর দিন।
— বিশুদ্ধ পানের পানি ও নিরাপদ স্থানে পয়োনিষ্কাশনই এ মুহূর্তের জরুরি স্বাস্থ্য-সতর্কতা।
প্রতিকারে প্রতিরোধে খাওয়ার স্যালাইন
প্যাকেটের ওআরএস পানিতে মিশিয়ে ডায়রিয়া রোগীর জন্য খাবার স্যালাইন বানাতে হয়। পানিস্বল্পতা পূরণে ও প্রতিরোধে বাড়িতে খাওয়ার স্যালাইন ব্যবহার করা যায়।
স্যালাইন বানাতে কী করবেন
— আধা লিটার/আধা সের (দুই পূর্ণ গ্লাস) নিরাপদ পানিতে একটি প্যাকেটের সবটুকু ওআরএস মেশাতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, পানির পরিমাণ যেন খুব একটা কম বা বেশি না হয়। কম পানি মেশানো হলে স্যালাইন বিপজ্জনক হবে এবং তা খেলে ডায়রিয়া বেড়ে যাবে, আবার বেশি পানি মেশালে স্যালাইন কম কাজ করবে।
— স্যালাইন ভালো করে নাড়তে হবে, যাতে ওআরএস সম্পূর্ণভাবে পানিতে মিশে যায়। চামচ দিয়ে অথবা কাপে করে শিশুকে স্যালাইন খাওয়াতে হবে।
— ওআরএস প্যাকেট না পাওয়া গেলে বাড়িতেও খাওয়ার স্যালাইন তৈরি করা যায়। একমুঠো গুড় বা চিনি এবং তিন আঙ্গুলের এক চিমটি লবণ আধা লিটার/আধা সের (দুই পূর্ণ গ্লাস) পানিতে গুলে খাওয়ার স্যালাইন তৈরি করা যায়।
— ওআরএস প্যাকেট দিয়ে তৈরি স্যালাইন ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত ভালো থাকে। যদি ১২ ঘণ্টা পর স্যালাইন অবশিষ্ট থাকে, তবে তা ফেলে দিয়ে পুনরায় নতুন ওআরএস দিয়ে স্যালাইন তৈরি করতে হবে।
— দুধ, স্যুপ, ফলের রস অথবা অন্য কোনো পানীয়র সঙ্গে ওআরএস মেশাবেন না।
— ওআরএস বা স্যালাইন কখনো গরম করবেন না।
কীভাবে খাওয়াবেন খাওয়ার স্যালাইন
প্রতিবার পাতলা পায়খানা হওয়ার পর শিশুকে খাওয়ার স্যালাইন খাওয়াতে হবে নিচের নিয়মেঃ
— শিশুর বয়স দুই বছরের কম হলে সিকি গ্লাস থেকে আধা গ্লাস (৫০-১০০ মিলিলিটার)।
— ২-১০ বছর বয়সের ছেলেমেয়েদের আধা গ্লাস থেকে পুরো এক গ্লাস।
— ১০ বছরের বেশি বয়সের ছেলেমেয়েরা যত চায় তত।
— তবে সব বয়সের শিশুই যত বেশি স্যালাইন খাবে, তত ভালো।
— খাবার স্যালাইন কাপে করে অথবা চা-চামচ দিয়ে খাওয়াতে হবে। কোনোক্রমেই তা বোতল দিয়ে খাওয়ানো যাবে না। শিশু বমি করলে পাঁচ থেকে ১০ মিনিট স্যালাইন খাওয়ানো বন্ধ রাখতে হবে, তারপর তাকে আবার অল্প অল্প করে ধীরে ধীরে স্যালাইন খাওয়াতে হবে।
— ডায়রিয়া বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত খাওয়ার স্যালাইন এবং অন্যান্য তরল খাদ্য খাওয়ানো চালিয়ে যেতে হবে। ডায়রিয়া বন্ধ হতে তিন থেকে পাঁচ দিন সময় লাগতে পারে।
ইকবালকবীর
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ০৩, ২০০৯
Leave a Reply