ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম দীর্ঘদিন ধরে কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিষয়টি পড়াচ্ছেন। তিনি আপনার মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন। আপনার সঠিক পরিচয় না দিতে চাইলে অন্য কোনো নাম ব্যবহার করুন। —বি.স.
সমস্যা: আমার বয়স ২০ বছর। আমি আগে কখনো কারও সঙ্গে প্রেম করিনি; কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর আমার বিভাগের একজন ম্যাডামকে খুব ভালো লাগে। মনে হয়যেন, তাঁকে ছাড়া বাঁচব না; কিন্তু এ কথা তাঁকে আমি বলতেও পারছি না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
পরামর্শ: তুমি খুব সততার সঙ্গে নিজের মনের অবস্থাটি জানিয়েছ। সে জন্য অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এর আগে কারও সঙ্গে প্রেম করোনি তা লিখেছ। তবে আমার ধারণা, আগে কোনো মেয়ের সঙ্গে তোমার সুস্থ এবং নির্ভেজাল বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনি। বোঝা যাচ্ছে, ম্যাডামকে একজন শিক্ষক ও মানুষ হিসেবে না দেখে তুমি তাঁকে শুধু একজন নারী হিসেবে দেখছ। তবে তোমার এই ভালো লাগাটা যদি শুধু মোহ হয়ে থাকে, তাহলে কোনো অসুবিধা নেই। কারণ আমাদের দেশের অনেক ছেলেরাই মেয়েদের সঙ্গে সুস্থ ও সহজভাবে মেলামেশার সুযোগ পায় না বলেই হঠাৎ করে তার চেয়ে বয়সে বড় কোনো নারীর সংস্পর্শে এলেও এ ধরনের অনুভূতির ভেতর দিয়ে যায়। কাজেই তুমি মনে করতে পারো, শুধু তুমি একা নও, অনেকেই কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এই পরিস্থিতিতে পড়ে যায়। তবে তুমি তাঁকে ছাড়া বাঁচবে না, এ কথাটি কতটুকু ঠিক, সেটি ভেবে দেখো। কারণ ‘ভালো লাগা’ আর ‘ভালোবাসা’ দুটো কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। ভালো লাগার অনুভূতি হঠাৎ করে কোনো পরিচিত বা খুব স্বল্প পরিচিত মানুষের প্রতিই হতে পারে। কিন্তু আমরা যদি সেটি নিয়ে বাড়াবাড়ি না করি এবং এটিকে একটি সুন্দর ও পবিত্র অনুভূতি হিসেবে লালন করি, তাহলে তো কারও কোনো ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। এই অনুভূতিগুলো আবার পুরোপুরি প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর কমেও যায়। তবে এ ধরনের অনুভূতির ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় আমরা যদি জীবনের বাস্তবতাগুলো চিন্তাধারায় নিয়ে আসতে পারি, তাহলে খুব ভালো হয়। কাউকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসতে হলে কিন্তু মানুষটির সঙ্গে খুব ভালোভাবে পরিচিত হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। যখন আমরা বুঝতে পারব যে দুজনেরই দুজনের প্রতি অনেক বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবোধ কাজ করছে, পরস্পরের পছন্দ-অপছন্দগুলোর অনেক মিল রয়েছে, পারস্পরিক বোঝাপড়ার জায়গাটিও খুব সুন্দর, একমাত্র তখনই আমরা একটি দীর্ঘস্থায়ী ভালোবাসার বন্ধনের কথা ভাবতে পারি। তুমি যেহেতু ম্যাডামকে ভালো করে জানো না বা চেনো না, শুধু তার বাইরের চেহারা বা আচরণগুলোই দেখছ, তোমার এই অনুভূতিটিকে এখন ‘ভালো লাগা’ বা ‘মোহ’ বলা যেতে পারে। সারাক্ষণ ম্যাডামের কথা ভাবলে তো পড়ালেখা করা মোটেও সম্ভব নয়। চিন্তাটি দূরে সরিয়ে রাখার জন্য তুমি অন্য কোনো ভালো লাগার কিছু বিষয় দিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করো। বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাও, ভালো বই পড়ো, সম্ভব হলে খেলাধুলা করো।
সমস্যা: আমার বয়স ১৮। আমার নিজের সম্পর্কেধারণা খুব ভালো নয়। আমার আশপাশের সবাই এমনকি আমার মা-বাবাও আমাকে খুব ঘৃণা করে। আমার গায়ের রং কালো। আমি চলনে-বলনে স্মার্ট নই। পড়াশোনায় ভালো ছিলাম, এখন খারাপ হয়ে গেছি। খুব শুকনো স্বাস্থ্য আমার, খিটখিটে মেজাজ। কোনো অনুষ্ঠানে আর সবার মতো উৎফুল্ল থাকতে পারি না। কারণ এ দুর্বল স্বাস্থ্য নিয়ে আর সবার মতো নাচতে-গাইতে পারি না। তাই চুপচাপ বসে থাকি, ইচ্ছে করেই কিছু খাই না। কারণ খেলে তো বেশি দিন বেঁচে থাকব। কিন্তু আমি তো মরে যেতে চাইছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
পরামর্শ: তোমার দুঃখটা অনেক গভীর। তাই সারাক্ষণ মনে হচ্ছে, কেউ তোমাকে ভালোবাসে না। তবে মা-বাবা তোমাকে ঘৃণা করেন, সেটা মনে করাটা বোধ হয় খুব যুক্তিযুক্ত নয়। তাই না? তাঁরা হয়তো সব সময় তোমার সঙ্গে ভালো আচরণ করছেন না। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে তাঁদের সন্তানদের নেতিবাচক দিকগুলোই বেশি করে তুলে ধরেন তাঁরা। নিজেদের সন্তানদের তাঁরা সব সময় অন্যদের সঙ্গে তুলনা করেন এই মনে করে যে এতে করে সন্তানেরা ভালো উদাহরণগুলো দেখে নিজেদের সেভাবে তৈরি করার চেষ্টা করবে। অথচ এতে কিন্তু হিতে বিপরীত হয়। নেতিবাচক বিষয়গুলো বেশি উল্লেখ করার ফলে সন্তান হীনম্মন্যতায় ভুগতে থাকে। এই ভুলগুলো করে অনেক মা-বাবাই তাঁদের সন্তানদের লালন-পালন করছেন। তাঁরা জানেন না যে তাঁদের সন্তানদের যদি ছোট ছোট অর্জনের জন্য অনেক প্রশংসা করা হয়, তাহলেই বরং এই ছেলেমেয়েরা আরও উৎসাহিত হয়ে নিজেদের বিভিন্ন দিকে বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়। আমরা অভিভাবকেরা এ ধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করার কারণেই সন্তানেরা ইতিবাচক আত্মপ্রত্যক্ষণ, আত্মবিশ্বাস নিয়ে জীবনের চাহিদাগুলোর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না। তবে এগুলো অবশ্যই মা-বাবার ইচ্ছাকৃত নয়। তাই তোমার কাছে আমার অনুরোধ, ওদের ভুলের মাশুল তুমি এভাবে দিয়ো না। বর্তমানে তোমার যে ব্যক্তিত্ব তা কিন্তু বংশানুক্রম ও পরিবেশ দ্বারা নির্ধারিত। এখন থেকে তুমি অত্যন্ত সচেতনভাবে নিজের ইতিবাচক দিকগুলোর স্বীকৃতি দাও, আর যে দিকগুলো কিছুটা দুর্বল, সেগুলোর আরও বিকাশ ঘটাও। নিজের ইতিবাচক দিকগুলো মাথায় রেখে নিজেকে গ্রহণ করে নিতে পারলে অন্যদের অবহেলা আমাদের এতটা কষ্ট দিতে পারে না। কারও সঙ্গে নিজেকে একটুও তুলনা না করে, তুমি তোমার মতো এবং এই সত্তাটিকে তুমি ভালোবাসো ও শ্রদ্ধা করো—এই ভাবনাটি প্রতিদিন সকালে ও রাতে ঘুমানোর আগে ভাববে।
নিজেকে তুমি খুব বেশি অবহেলা করছ এবং অত্যাচার করছ। এটা কি ঠিক, বলো তো? একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ হিসেবে নিজের যত্ন নেওয়া কিন্তু এখন তোমার কর্তব্য। এভাবে চলতে থাকলে বা নিজের অযত্ন করলে তো মেজাজ আরও খিটখিটে হয়ে যাবে। এর ফলে আশপাশের মানুষগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটলে তোমার দুঃখ আরও বেড়ে যাবে। অন্যদের মতো নাচতে-গাইতে না পারলেও তুমি যে নিজেকে অনেক দিক থেকেই সমৃদ্ধ করে তুলতে পারো এই বিশ্বাসটি ধরে রাখো।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, মে ২৩, ২০১০
Leave a Reply