ধূমপান বা তামাক সেবন এমন একটা বদ-অভ্যাস, যা থেকে মুক্ত হতে ধূমপায়ীর ইচ্ছাশক্তিই যথেষ্ট। শরীরের এমন কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেই যা তামাক বা ধূমপানের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকে। এক পরিসংখানে দেখা গেছে, ধূমপায়ীদের শতকরা ৫০ ভাগ ধূমপানজনিত জটিলতায় মারা যায়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, অধূমপায়ীর তুলনায় ধূমপায়ীর মৃত্যুর ঝুঁকি শতকরা ৭০ ভাগ বেশি এবং ধূমপানজনিত কারণে কম বয়সীরা বয়স্কদের তুলনায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। ধূমপানজনিত কারণে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর মারা যায় প্রায় পাঁচ লাখ লোক। ধূমপায়ী ব্যক্তি অধূমপায়ীদের তুলনায় বেশি শারীরিক অক্ষমতায় ভোগে এবং কাজকর্মে অমনোযোগী থাকে। ধূমপানের ফলে ফুসফুসের রোগ, শ্বাসনালি, মুখগহ্বর, নাকবিবর, সাইনাস, খাদ্যনালি, পাকস্থলী, যকৃৎ, বৃক্ক, মূত্রথলি, মূত্রনালির বিভিন্ন রোগ হতে পারে। এ ছাড়া মাইলয়েড লিউকেমিয়ার (রক্তের একধরনের ক্যান্সার) মতো জীবনধ্বংসকারী রোগও হতে পারে।
ফুসফুসের ক্যান্সারের প্রধান কারণ ধূমপান
বিশ্বে ধূমপান হলো ক্যান্সার-আক্রান্ত মৃত্যুর মধ্যে প্রধানতম কারণ। যে ব্যক্তি প্রতিদিন এক প্যাকেট বিড়ি বা সিগারেট খায়, তার ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ১০ গুণ বেড়ে যায়। দিনে যে দুই প্যাকেট খায়, তার ক্ষেত্রে সেটা হয় প্রায় ২৫ গুণ। এ ছাড়া ধূমপান শ্বাসনালির দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহের (সিওপিডি) অন্যতম প্রধান কারণ। সিওপিডির কারণে একজন ধূমপায়ীর মৃত্যুঝুঁকি অধূমপায়ীদের তুলনায় ২৫ গুণ বেশি। যারা হাঁপানিতে আক্রান্ত ও ধূমপায়ী, তাদের ক্ষেত্রে ওষুধের কার্যক্ষমতা কমে যায় এবং তারা চিকিৎসার সুফল থেকে বঞ্চিত হয়।
হৃদরোগ ও রক্তনালির জটিলতা
ধূমপান করোনারি হৃদরোগের একটি অন্যতম প্রধান কারণ। অধূমপায়ীর তুলনায় ধূমপায়ী রক্তনালির জটিলতার শতকরা ৬০ থেকে ৭০ ভাগ বেশি ভুগে থাকে। যেসব হৃদরোগ থেকে হঠাৎ মৃত্যু হতে পারে, তাদের ক্ষেত্রে অল্পবয়সী ধূমপায়ীরা অধূমপায়ীদের তুলনায় দুই থেকে চার গুণ বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকে। একবার হৃৎপিণ্ডজনিত বুকের ব্যথায় (এমআই) আক্রান্ত হওয়ার পরও যারা ধূমপান ছাড়ে না, তারা ধূমপান ছেড়ে দেওয়া রোগীদের চেয়ে ১০ গুণ বেশি মৃত্যুঝুঁকির মধ্যে থাকে। ধূমপান মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের (স্ট্রোক) একটি প্রধান কারণ। এই ঝুঁকি ধূমপানের পরিমাণের সঙ্গে সমানুপাতিক হারে সম্পর্কযুক্ত। ধূমপানের ফলে শরীরে, হাত ও পায়ের শিরা-উপশিরায় রক্তপ্রবাহ কমে যেতে পারে। ফলে বার্জার রোগ (যে অসুখে পায়ের আঙুল পচে যেতে শুরু করে) হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। উচ্চ রক্তচাপের রোগী যদি ধূমপায়ী হয় ও ক্রমাগত ধূমপান চালিয়ে যেতে থাকে, তাদের উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রিত না হওয়ার ঝুঁকি অনেকটাই বেড়ে যায়। যেহেতু ধূমপান ও সিওপিডির সঙ্গে এর একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে, তাই এ দুটো মিলে ধূমপায়ীর দীর্ঘস্থায়ী ফুসফুসজনিত হৃদরোগের ঝুঁকিও অনেকটা বেড়ে যায়।
হতে পারে পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা
ধূমপায়ীদের গ্যাস্ট্রিক আলসার ও ডিওডেনাল আলসার বেশি হয়। ধূমপানের ফলে আলসারের স্বাভাবিক প্রশমন বাধা পায়। এ ছাড়া ধূমপায়ীদের শরীরে নিকোটিনের প্রভাবে ওষুধের কার্যক্ষমতাও কমে যায়। ফলে এসব রোগ সেরে গেলেও পরে তা বারবার হওয়ার আশঙ্কা অধূমপায়ীদের তুলনায় অনেক বেশি। এ ছাড়া ধূমপায়ীদের অর্কিওপোরেসিস হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। এছাড়া ধূমপায়ীরা অধূমপায়ীদের চেয়ে বেশি বিষণ্নতায় ভোগে।
ধূমপান ছাড়ুন সুস্থ থাকুন
দেখা গেছে, ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার এক বছরের মধ্যে এমআই-জাতীয় হৃদরোগের হার অনেক কমে যায় এবং মৃত্যুঝুঁকিসম্পন্ন মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ ও ফুসফুসে দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণের ঝুঁকি ১৫ ভাগ কমে যায়। ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার কিছুদিনের মধ্যে ধূমপায়ীর ঘ্রাণশক্তি ও খাওয়ার রুচি ফিরে আসে। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক কর্মক্ষমতাও বাড়তে শুরু করে।
ধূমপান ছাড়বেন কীভাবে
প্রথমেই নিজেকে মানসিকভাবে তৈরি করে নিন। তারপর নেশাটাকে চক্রাকারে কমাতে হবে, যা ধূমপানের নেশাকে কমাতে সাহায্য করবে। পর্যায়ক্রমিক একটি ধারণা তৈরি করুন যে একটি নির্দিষ্ট সময় পর আপনি আর ধূমপান করবেন না। ধূমপানের ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে জেনে আপনার ধূমপান বর্জনের পক্ষে একটা জোরালো যুক্তি মনের মধ্যে দাঁড় করাতে পারেন। আর এভাবেই আপনি একদিন সফলভাবে একজন অধূমপায়ী সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষে পরিণত হতে পারেন। যাঁরা ধূমপান ছাড়তে চান অথচ পারছেন না, তাঁরা প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন। সব ক্ষেত্রে তামাক ও ধূমপানের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, এর প্রচার ও প্রসার কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়ে একটি তামাকবিহীন সুস্থ ও নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করাই হোক এবারের বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসে আমাদের অঙ্গীকার।
মো· দেলোয়ার হোসেন
মেডিসিন ও বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ
বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ২৭, ২০০৯
Leave a Reply