অন্যান্য বছরের মতো এবারও ১৭ মে বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস হিসেবে পালিত হলো। সারা বিশ্বের বিশাল জনগোষ্ঠী উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। ছোট ছোট পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের ১০ থেকে ২০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। অর্থাৎ এ দেশে উচ্চ রক্তচাপের রোগী দেড় কোটিরও বেশি। এতে সমস্যাটা কোথায়?
সমস্যা হলো, উচ্চ রক্তচাপ হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায় দ্বিগুণ, হার্ট ফেইলিওরের ঝুঁকি বাড়ায় চারগুণ আর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ ও প্যারালাইসিস/পক্ষাঘাতের ঝুঁকি বাড়ায় সাতগুণ। এর সঙ্গে যোগ করুন কিডনি ফেইলিওর আর চোখের ভেতর রক্তপাতের ঝুঁকি। তবেই বোঝা যায়, এটি কেমন মরণব্যাধি। এ ছাড়া আরেকটি সমস্যা হলো, উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসার অপ্রতুলতা।
খোদ যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় সাড়ে ছয় কোটি রোগীর মধ্যে মাত্র ৬৩ শতাংশ তাদের রোগ যে আছে সেটি জানে, কিন্তু চিকিৎসা পায় মাত্র ৪৫ শতাংশ আর উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে মাত্র ৩৪ শতাংশ রোগীর।
উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসায় শুধু চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীদের ভূমিকাই যথেষ্ট নয়, গণমাধ্যমও এ সম্পর্কে প্রচার চালিয়ে জনসচেতনতা বাড়িয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
রক্তচাপ (ব্লাড প্রেসার) আসলে কী? আমাদের জন্মলগ্ন থেকে হৃৎপিণ্ড পাম্পের কাজ করে দেহের আনাচকানাচে রক্ত সরবরাহ করছে। হৃৎপিণ্ডের এই ‘পাম্পিং’-এর মাধ্যমে যে বল তৈরি হয় এবং প্রবহমান ধারায় রক্তনালির দেয়ালে রক্ত যে ‘বল’ প্রয়োগ করে সামনে এগিয়ে চলে, তা-ই হচ্ছে রক্তচাপ।
এই রক্তচাপ মাপার সময় আমরা বলি সিস্টোলিক রক্তচাপ হচ্ছে এই এবং ডায়াস্টেলিক রক্তচাপ এই। প্রতিবার স্পন্দন করার সময় হৃৎপিণ্ড সংকুচিত হয়ে রক্তকে ধমনি দিয়ে সামনের দিকে সঞ্চালন করে। সে সময় ধমনির দেয়ালে রক্ত যে চাপ তৈরি করে, সেটিই সিস্টোলিক রক্তচাপ। আর দুটি হৃৎস্পন্দনের মাঝখানে হৃৎপিণ্ড যখন প্রসারিত হয়ে রিলাক্স করে (এবং শিরা থেকে রক্ত গ্রহণ করে), তখন ধমনির দেয়ালে যে বেসলাইন চাপ থাকে, সেটিকে বলে ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ।
একজন মানুষের জন্য রক্তচাপের একটি নির্দিষ্ট মাত্রা নেই। একেকজনের রক্তচাপ একেক রকম এবং একই মানুষের চলাফেরা, খাদ্য গ্রহণ বা পরিশ্রমের কাজের সময় রক্তচাপ ভিন্ন ভিন্ন উত্তেজনা, দুশ্চিন্তা ও পরিশ্রমের সময় রক্তচাপ বাড়ে। তেমনি ঘুম ও বিশ্রামের সময় রক্তচাপ কমে।
বয়স যখন কম, রক্তচাপও তখন সাধারণত কম থাকে। একটি নির্দিষ্ট পরিধির মধ্যে রক্তচাপের এই ওঠানামা অত্যন্ত স্বাভাবিক ও কাম্য। কিন্তু যদি অধিকাংশ সময় রক্তচাপ এই স্বাভাবিক মাত্রার বেশি থাকে, বিশেষ করে বিশ্রামকালীন, তবে আপনি উচ্চ রক্তচাপের রোগী।
রক্তচাপ বেড়ে যাবে যদি-১· শরীরে লবণ ও জলীয় অংশ বেড়ে যায়। খাদ্যে অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ ও কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় (বিশেষত, স্টেরয়েড, ব্যথানাশক ও জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি) দেহে লবণ ও পানি জমে গিয়ে এটা হতে পারে।
আপনার রক্তনালির দেয়াল যদি শক্ত হয়ে যায়। এ প্রক্রিয়াকে অ্যাথেরোসক্লেরোসিস বলে, যাতে রক্তনালির দেয়ালে চর্বি জমে তা শক্ত ও সংকুচিত হয়ে যায়, আপনার হৃদ্যন্ত্র যদি অতিরিক্ত জোরে ও দ্রুত রক্ত পাম্প করতে থাকে। এর প্রধান কারণ হলো অতিরিক্ত অ্যালকোহল বা মাদক সেবন বা ধূমপান করা।
উচ্চ রক্তচাপের সবচেয়ে ভীতিকর দিক হলো, প্রায় ৯০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রেই এটি উপসর্গ তৈরি করে না। রক্তচাপ না মাপলে উচ্চ রক্তচাপ শনাক্ত করার কোনো উপায় নেই। সামান্য কিছু রোগীর কিছু উপসর্গ হয়, যেমন ঘাড় ও মাথা ব্যথা করা, বুক ধড়ফড়, ঘুম না হওয়া, বুকে সামান্য অস্বস্তি, জোরে হাঁটতে গেলে বা পরিশ্রমের কাজ করতে গেলে অতিরিক্ত হাঁপিয়ে যাওয়া ইত্যাদি।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আপনি কিছুই বুঝতে পারছেন না অথচ নীরবে-নিভৃতে উচ্চ রক্তচাপ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষতি করে চলে। এ জন্যই একে বলে নীরব ঘাতক। প্রশ্ন আসে, উচ্চ রক্তচাপ বলতে আমি কোন স্তরের রক্তচাপকে বোঝাব। বলা হচ্ছে, চিকিৎসকের চেম্বারে বা হাসপাতালে যদি প্রাপ্তবয়স্ক একজন মানুষের রক্তচাপ কমপক্ষে দুটি আলাদা সময়ে মেপে ১৪০/৯০ মিমি পারদ বা এর বেশি পাওয়া যায়, তাহলে ধরে নিতে হবে সে উচ্চ রক্তচাপের রোগী। কিন্তু সমস্যা হলো, প্রায় ১০ শতাংশ রোগী চিকিৎসকের কাছে গেলেই তাদের প্রেসার ‘বেসলাইন প্রেসার’ থেকে বেড়ে যায়। একে বলে হোয়াইট কোট হাইপারটেনশন।
সে ক্ষেত্রে বাড়িতে একাধিকবার রক্তচাপ মেপে যদি তা ১৩৫/৮৫ মিমি পারদ বা এর বেশি পাওয়া যায়, তবে সে উচ্চ রক্তচাপের রোগী। আজকাল ২৪ ঘণ্টা রক্তচাপ মাপার যন্ত্র লাগিয়ে দেওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে কিন্তু ২৪ ঘণ্টার গড় রক্তচাপ যদি ১২৫/৮০ মিমি পারদ বা এর বেশি হলেই উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে বলে ধরে নিতে হবে।
এ রকম তিনটি স্তরের ‘কাট আপ পয়েন্ট’ কেন করা হলো? আসলে বাড়িতে ‘স্বনিয়ন্ত্রিত’ পরিবেশে রক্তচাপ কমই থাকার কথা। আবার ২৪ ঘণ্টার হিসাবে ঘুমের সময়ের স্বাভাবিক কম রক্তচাপও গড় হিসাবে ঢুকছে। কাজেই উচ্চ রক্তচাপ শনাক্তকরণের কাটআপ পয়েন্টগুলোও তাই স্বভাবতই কম হয় এসব ক্ষেত্রে।
আপনার সিস্টোলিক বা ডায়াস্টোলিক যেকোনো পর্যায়ের রক্তচাপ বেশি থাকলেই আপনি হাইপারটেনসিভ এবং দুটির মধ্যে যেটি তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে, আপনি সে অনুযায়ী সেই লেভেলের রোগী। এখানে একটি শ্রেণীবিভাগ হচ্ছে প্রি-হাইপারটেনশন। গবেষণায় দেখা যায়, যাদের রক্তচাপ ১২০/৮০ মিমি পারদের বেশি থাকে, তাদের প্রায় অর্ধেকই পরবর্তী চার বছরের মধ্যে পুরোপুরি উচ্চ রক্তচাপের রোগী হয়ে যাবে। আগেভাগেই তাদের চিকিৎসা দেওয়া যায় জীবন যাপন পদ্ধতি পরিবর্তনের মাধ্যমে। এতে করে অসংখ্য মানুষ ভবিষ্যতের উচ্চ রক্তচাপের রোগী হওয়া থেকে বেঁচে যেতে পারে।
রোগীদের জিজ্ঞাসা থাকে সিস্টোলিক বা ডায়াস্টলিক রক্তচাপের মধ্যে কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আসলে চল্লিশের নিচে বেশির ভাগ উচ্চ রক্তচাপের রোগীর ডায়াস্টোলিক রক্তচাপই বেশি থাকে (যেমন ১৩০/৯৫) এবং সেটিই তাদের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বয়স বাড়লে শারীরিক বিভিন্ন পরিবর্তনের সঙ্গে দেহের রক্তবাহী ধমনিগুলোও ‘বুড়ো’ হয় এবং শক্ত হয়ে যায়। তখন সিস্টোলিক রক্তচাপ বাড়তে থাকে এবং ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ বরং কমতে থাকে। ষাটোর্ধ্ব রোগীদের জন্য তাই সিস্টোলিক রক্তচাপই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মধ্যবর্তী গ্রুপের জন্য দুটোই সমান গুরুত্ববাহী।
অনেক রোগীর জিজ্ঞাসা থাকে, ‘আমার যে ব্লাড প্রেসার এত বেশি বলছেন, আমি তো কোনো অসুবিধাই অনুভব করি না। তাহলে আমি কেন ওষুধ খাব?’ অনেকে বলেন, ‘আমি ওষুধ খাই না এ জন্য যে একবার ওষুধ শুরু করলে সারা জীবন ওষুধ খেতে হবে।’ প্রথম গ্রুপের প্রশ্নের জবাবে আমরা বলি যে আপনি আজ নিজের চিকিৎসা শুরু করবেন ভবিষ্যতের কিছু দুর্যোগ এড়ানোর জন্য।
আজ ৪০ বছর বয়সে আপনি ওষুধ শুরু করবেন, পাঁচ থেকে ১০ বছরের মধ্যে আপনার হার্ট অ্যাটাক বা হার্ট ফেইলিওরের ঝুঁকি কমাতে; আপনার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ আর পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে বিছানায় প্রস্রাব-পায়খানা করার যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হওয়ার কথা, সেটির ঝুঁকি কমাতে; ১০-১৫ বছর পর কিডনি ফেইলিওর রোগী হয়ে ডায়ালাইসিসের যন্ত্রণা যাতে ভোগ করতে না হয়, সে ঝুঁকি কমাতে। চোখের ভেতর রক্তপাত আর অকালমৃত্যু থেকে নিজেকে মুক্ত করতে আপনি আজ ওষুধ আর নিয়ম-শৃঙ্খলার বাঁধনে জড়াবেন নিজেকে।
যেহেতু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উচ্চ রক্তচাপ উপসর্গ বা লক্ষণবিহীন, কাজেই রক্তচাপ মাপার যন্ত্রটির নির্দেশিত মাত্রাই হবে আপনার চিকিৎসার মূল নির্দেশক। দ্বিতীয় গ্রুপের রোগীদের আমি বলি যে উটপাখির মতো বালিতে মাথা গুঁজে রেখে যদি ভাবি যে রোগকে আমি যেহেতু দেখছি না, সেও আমাকে দেখতে পাবে না, তবে সেটি হবে বিশাল এক ভুল।
উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা মানেই কিন্তু গাদা গাদা ওষুধ খাওয়া নয়। লাইফ স্টাইল পরিবর্তন কিন্তু এ চিকিৎসার একটি বড় অংশ এবং অনেক রোগীর জন্য বহুদিন পর্যন্ত সেটিই একমাত্র প্রয়োজনীয় চিকিৎসা হতে পারে। অন্যদের এর সঙ্গে যোগ করতে হয় ওষুধ, যার মাত্রা ও সংখ্যা নির্ভর করবে রক্তচাপের মাত্রা ও সম্পর্কিত অন্য রোগগুলো থাকা না-থাকার ওপর। কিছু ক্ষেত্রে ওষুধ সারা জীবন খাওয়ার প্রয়োজন হয় না। যেমন প্রেগনেন্সি ইনডিউসড হাইপারটেনশন, ড্রাগ ইনডিউসড হাইপারটেনশন বা এড্রিনাল টিউমার ইনডিউসড হাইপারটেনশন-এসব ক্ষেত্রে আসল রোগটির চিকিৎসা করলেই রক্তচাপ স্বাভাবিক হয়ে আসে।
আরেকটি অসুবিধা হলো মাইগ্রেন রোগীদের ক্ষেত্রে। তাদের মাথাব্যথার সময় রক্তচাপ অস্বাভাবিক বেড়ে যেতে পারে। তখন তারা ভাবে, উচ্চ রক্তচাপই বুঝি তাদের মাথাব্যথার কারণ। অথচ মাথাব্যথার ওষুধ দিয়ে সেটি যখন কমে আসে, তখন তাদের রক্তচাপও হয়ে যায় স্বাভাবিক। এতে বোঝা যায় যে এ ক্ষেত্রে রক্তচাপের বৃদ্ধি ছিল রি-অ্যাকশান বা প্রতিক্রিয়া মাত্র; অ্যাকশন বা আসল কারণ নয়।উচ্চ রক্তচাপ কেন হয়? উত্তরটা খুব সহজ নয়। শতকরা ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের একক কোনো কারণ নেই। একে বলা হয় প্রাইমারি হাইপারটেনশন। জেনেটিক ফ্যাক্টর বা বংশগতির মধ্যে শরীরের ওজন বেশি হওয়া, অতিরিক্ত লবণ খাওয়া, অতিরিক্ত স্মায়বিক বা মানসিক চাপে থাকা, ধূমপান করা, শারীরিক পরিশ্রম না করা, অতিরিক্ত অ্যালকোহল গ্রহণ, বয়স বেশি হয়ে ধমনি শক্ত হয়ে যাওয়া-এ সবকিছুই আংশিকভাবে রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার জন্য দায়ী হতে পারে। সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে পাওয়া যায়। কিছু হরমোনঘটিত রোগ (পিটুইটারি, থাইরয়েড বা অ্যাড্রেনাল গ্লান্ডের কিছু রোগ), কিডনির বিভিন্ন রোগ বা কিডনি ফেইলিওর, কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (স্টেরয়েড, জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি, ব্যথানাশক)-এ সবই সেকেন্ডারি হাইপারটেনশনের কারণ হতে পারে। আরেকটি বিশেষ গ্রুপ হলো গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ। একজন চিকিৎসক উচ্চ রক্তচাপের রোগীর চিকিৎসা করার সময় তিনটি দিকে নজর দেন। প্রথমত, রোগী সত্যি উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে কি না এবং ভুগলে সেটি কোন পর্যায়ের উচ্চ রক্তচাপ; দ্বিতীয়ত, উচ্চ রক্তচাপের কারণে তার শরীরের কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হলো কি না; তৃতীয়ত, উচ্চ রক্তচাপের সঙ্গে তার হৃদরোগের আর কোনো ঝুঁকি আছে কি না।
আবদুল ওয়াদুদ চৌধুরী
সহযোগী অধ্যাপক, কার্ডিওলজি
ঢাকা মেডিকেল কলেজ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ২০, ২০০৯
Leave a Reply