যকৃতের প্রদাহ বা হেপাটাইটিস নিয়ে উদ্বেগের কারণ অনেক আগে ঘটে থাকলেও এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা সৃষ্টি ও একে প্রতিরোধের জন্য উদ্যোগ সাম্প্রতিক কালের। এর মধ্যে বেশির ভাগ লোকের যে হেপাটাইটিস রয়েছে, সে সম্পর্কে তারা জানেই না এভাবে অনেকে ক্রনিক হেপাটাইটিসের শিকার হয়ে পড়েছে এবং দেখা গেছে, এর মূলে প্রধানত রয়েছে হেপাটাইটিস ভাইরাস ‘বি’ ও ‘সি’।
এর গুরুত্ব অনুধাবন করে ‘বিশ্ব হেপাটাইটিস অ্যালায়েন্স’ সংস্থাটি এগিয়ে এল এবং বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস পালনের উদ্যোগ নিল। দিবসটি পালনের প্রতিপাদ্য ‘আমি কি নম্বর ১২?’ নির্ধারিত হয়েছিল ২০০৮ সালে। এই প্রতিপাদ্য নির্বাচনের ব্যাপারে যে যুক্তি, তা হলো পৃথিবীজুড়ে ১২ জনের মধ্যে একজন ক্রনিক হেপাটাইটিস ‘বি’ বা ক্রনিক হেপাটাইটিস ‘সি’ নিয়ে বেঁচে আছে। এইচআইভি/এইডস সংক্রমণ বা ক্যান্সারে আক্রান্ত লোকের চেয়ে ক্রনিক হেপাটাইটিস অনেক বেশি হলেও এ ব্যাপারে সচেতনতা অত্যন্ত কম এবং সংক্রমিত অনেকেই এ রোগের সংক্রমণ সম্পর্কে জানে না।
তাই বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসের এই প্রতিপাদ্য ধারণ করে এবারও ১৯ মে পালিত হলো বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস। বিশ্ব হেপাটাইটিস অ্যালায়েন্সের ধারণা, এই প্রতিপাদ্যের মর্মার্থ মানুষ বুঝতে পারবে এবং বিশ্বজুড়ে ক্রনিক হেপাটাইটিসের বিশাল প্রকোপ নিয়ে ভাববে, নিজেরা ঝুঁকিতে আছে কি না তা সহজ-সরল পরীক্ষা করিয়ে জেনে নেবে এবং কীভাবে এ রোগ এড়িয়ে চলা যায় তাও জেনে নেবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এ আন্দোলনে যোগ দিয়েছে এবং এ মাসেই জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ৬২তম ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলিতে একটি পৃথক অ্যাজেন্ডা হিসেবে আলোচিত হবে ভাইরাল হেপাটাইটিস এবং বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস।
‘আমি কি নম্বর ১২?’ এই বাণী বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছানো, এর ব্যাপকতা সম্পর্কে অবহিত করা এবং হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ সম্পর্কে সচেতনতা এবং এ রোগের ব্যাপারে নানা ধরনের কুসংস্কার ছিন্ন করা হলো ২০০৯ সালে এই দিবস পালনের উদ্দেশ্য।
এ ব্যাপারে যে বিষয়গুলো মানুষকে জানানো যাবে সেগুলো হলোঃ
— বিশ্বের ৫০ কোট লোক (প্রতি ১২ জনে একজন) ক্রনিক ভাইরাল হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ রোগে আক্রান্ত।
— হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ সংক্রমণের ব্যাপারে কোনো বিবেচনা, তারতম্য ও বৈষম্য করে না। সারা বিশ্বে এক-তৃতীয়াংশের বেশি মানুষ এই দুটি ভাইরাসের সংক্রমণের শিকার হয়েছে।
— নিজে কি এ সম্পর্কে জানি? হেপাটাইটিস নীরবে রয়েছে কি না শরীরে, তা পরীক্ষা করিয়ে জানি।
দেখা গেছে, এ রোগের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো অজ্ঞানতা। আর এর চিকিৎসা না করালে মারাত্মক পরিণতি হতে পারে।
যকৃতের রোগের তিনটি বড় কারণ হলোঃ মদ্যপান, ফ্যাটি লিভার ডিজিজ, ভাইরাল হেপাটাইটিস।
— দীর্ঘদিন নিয়মিত মদ্যপানে যকৃৎ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই মদ্যপান বর্জন করা উচিত।
— যকৃতে চর্বি জমতে পারে। এতে হয় প্রদাহ ও ক্ষত। যারা স্থূল, তাদেরই এ সমস্যা বেশি হয়। তাই শরীরের ওজন ঠিক রাখতে হবে। প্রচুর ফলফলারি ও সবজি খেতে হবে। বেশি পরিমাণ পানি পান করতে হবে। ছোট থালায় খাবার নিয়ে খেতে হবে এবং চর্বি ও চিনি খুব কম খেতে হবে। প্রতিদিন অন্তত আধঘণ্টা ব্যায়াম। উপভোগ্য কোনো শরীরচর্চা, যেমন-হাঁটা, সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা বা নৃত্য করা।
— ভাইরাল হেপাটাইটিস বড় সমস্যা পৃথিবীজুড়েই। রক্তবাহিত দুটি ভাইরাস হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ যকৃতের বড় ক্ষতি করছে। রক্ত থেকে রক্তের সংস্পর্শে সহজে হয় এগুলোর সম্প্রচার এবং এগুলো থেকে পরিত্রাণ পাওয়া বড় কঠিন।
— তবে হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস সংক্রমণ থেকে প্রতিরোধের জন্য রয়েছে টিকা।
— এ ছাড়া কখনোই রেজার, কাঁচি, নেলসিজার, ব্লেড বা টুথব্রাশ ভাগাভাগি করে ব্যবহার করা উচিত নয়।
— শরীরের ক্ষত ঢেকে রাখা উচিত, বিশেষ করে খেলার সময়।
— কান ফুটো করা, শরীরে উল্কি আঁকানো বর্জন করা ভালো। কান ফুটো করতেই হলে একবার ব্যবহার্য (ডিসপোজেবল) যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা উচিত।
— রক্তভরণ ও গ্রহণের সময় একবার ব্যবহার্য সুচ ও সিরিঞ্জ ব্যবহার করা নিশ্চিত করতে হবে।
— সঙ্গীর সঙ্গে সহগমন যেন নিরাপদ হয়, প্রয়োজনে প্রোটেকশন ব্যবহার করতে হবে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, হেপাটাইটিস বি ও সির সংক্রমণে প্রতিবছর মারা যায় ১০ লাখ মানুষ।
৫০০ মিলিয়ন লোক ক্রনিক ভাইরাল সংক্রমণের
শিকার।
হেপাটাইটিস ‘বি’ সংক্রমণ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য টিকা নেওয়া সবচেয়ে ভালো পন্থা
হেপাটাইটিসের মধ্যে প্রধান হুমকি হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’। এই দুটো ভাইরাস হলো নীরব ঘাতক, অজান্তে মানবদেহে সংক্রমিত হয়ে থাকতে পারে বছরের পর বছর। চিকিৎসা না হলে লিভার সিরোসিসের পথে অগ্রসর হতে পারে। পরে লিভারের ক্যান্সার এবং নিষ্ত্র্নিয় হয়ে যাওয়া, এমনকি মৃত্যু।
হেপাটাইটিস ‘বি’ঃ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মানবজাতির একটি প্রধান রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘হেপাটাইটিস বি’। সবচেয়ে সচরাচর ‘বি’ ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমান, পৃথিবীতে দুই বিলিয়ন লোক হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসে সংক্রমিত এবং আনুমানিক ৩৫০ মিলিয়ন লোক ক্রনিক (দীর্ঘমেয়াদি) সংক্রমণের শিকার।
হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস অত্যন্ত ছোঁয়াচে এবং এইচআইভি থেকে ৫০ থেকে ১০০ গুণ বেশি সংক্রামক। ‘বি’ ভাইরাসটি সংক্রমিত ব্যক্তির সব দেহতরলে, যেমন-রক্ত, বীর্য, ঘাম, অশ্রু, এমনকি বুকের দুধেও পাওয়া যায়। অনেক সংক্রমিত ব্যক্তির কোনো উপসর্গ থাকে না। তবে যাদের থাকে তাদের ক্ষেত্রে এ ধরনের উপসর্গ লক্ষ করা যায়-
বমি হওয়া, ক্লান্তি লাগা, জন্ডিস, পেটে ব্যথা, তরল মল, হাড়ের গিঁটে ব্যথা। তবে সুসংবাদ হলো, হেপাটাইটিস ‘বি’ প্রতিরোধে রয়েছে কার্যকর টিকা। তাই এর জন্য টিকা নেওয়া উচিত এবং অবশ্যই।
হেপাটাইটিস ‘সি’ঃ হেপাটাইটিস ‘সি’ প্রধানত রক্ত থেকে রক্তে সংক্রমণ ঘটে, ‘বি’ ভাইরাসের মতোই। উপসর্গের মধ্যে আছে-বমি, ক্লান্তি, পেশি ও গিঁটে ব্যথা, উদ্বেগ ও বিষণ্নতা, মনোযোগের অভাব, পেটে ব্যথা, ক্ষুধামান্দ্য।
ঝুঁকিগুলো কী
হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে সংক্রমিত রক্তের সংস্পর্শে। অন্যান্য দেহতরল, যেমন-বীর্য, ঘাম, অশ্রু ও বুকের দুধও সংক্রমণক্ষম। হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে সংক্রমিত রক্তের সরাসরি সংস্পর্শে। কদাচিৎ অন্যান্য দেহতরলের মাধ্যমেও এর সংক্রমণ ঘটে। অনেক সংক্রমিত লোকের কোনো লক্ষণ উপসর্গ থাকে না। এদিকে একে অন্যকে সংক্রমিত করতে থাকে। সংক্রমণের উৎসগুলো হলোঃ
— রক্তভরণ, যেমন পরীক্ষা ছাড়াই রক্তভরণ করলে।
— যন্ত্রপাতি নির্বীজন না করে সার্জিক্যাল বা ডেন্টাল অস্ত্রোপচার করলে।
— শিশু জন্মের সময় সংক্রমিত মা থেকে শিশুর মধ্যে।
— মাদক নেওয়ার সময় সুচ ও সিরিঞ্জ ভাগাভাগি করলে।
— ট্রুথব্রাশ, শেয়ার ব্লেড ও অন্যান্য গেরস্তালি দ্রব্য সংক্রমিত ব্যক্তির সঙ্গে শেয়ার করলে।
— নির্বীজন না করা যন্ত্রপাতি দিয়ে উল্কি আঁকা, কান ফুটো করা-এসব কাজ করলে।
— অনিরাপদ সহগমনে।
রক্ত পরীক্ষা করে নেওয়া ভালো
হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ শনাক্ত করার জন্য সহজ রক্ত পরীক্ষা রয়েছে। সংক্রমিত হয়ে থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে অবশ্যই। মোকাবিলা করতে হবে রোগকে সাহসের সঙ্গে। অন্যদের কাছে সংক্রমণ যাতে না ছড়ায় সে জন্য সতর্ক থাকতে হবে, যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসাও নিতে হবে। হেপাটাইটিস ক্রনিক সংক্রমণ এভাবে হলে জানতে হবে রোগ সম্পর্কে, কীভাবে প্রতিরোধ করা যায় জানতে হবে, অসুখ হলে চিকিৎসা নিতে হবে। জনসচেতনতা এ ক্ষেত্রে বড় জরুরি। বাংলাদেশে লিভার ফাউন্ডেশন এবং বিভিন্ন চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানের লিভার ইউনিট, সরকারি-বেসরকারি সংস্থা এ ব্যাপারে হবে সক্রিয় ও উদ্যোগী-এ প্রত্যাশা সবার।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, পরীক্ষাগার সেবা
বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ২০, ২০০৯
Leave a Reply