সজল বাবুর চোখে (ছদ্মনাম) ছানির লক্ষণ এসেছিল বেশ কয়েক বছর আগে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিজের চোখের দিকে ভালোভাবে নজর দেওয়ার সময় পাননি। যদিও ঝাপসা দৃষ্টির কারণে বারবার ছুটেছেন চক্ষুবিশেষজ্ঞের কাছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেছেন ছানি অপারেশন করিয়ে নিতে। ‘এবারের মতো পাওয়ারটা পরিবর্তন করে দিন, স্কুলের কাজ তো অনেক! কাজ শেষ করে সুযোগমতো অপারেশন করিয়ে নেব।’ এসব বলে সময় কাটিয়েছেন। শেষমেশ অবসরগ্রহণের পরই চোখের অস্ত্রোপচার করিয়েছেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক চোখের ভেতর কৃত্রিম লেন্স সংযোজন করে দিয়েছেন। লেন্স সংযোজনের আগে লেন্সের মাপ নেওয়া হয়েছে। চিকিৎসককে জিজ্ঞেস করেছিলেন এ বিষয়ে। চিকিৎসক জানিয়েছিলেন, ছানি অপারেশনের বিভিন্ন পদ্ধতি আছে। তবে ইদানীং যে পদ্ধতিতে অস্ত্রোপচার করা হয়, এতে চোখের ভেতরের লেন্সটা বের করে সেখানে কৃত্রিম লেন্স বসিয়ে দেওয়া হয়। চশমার আর প্রয়োজন হয় না। এ প্রসঙ্গে চিকিৎসক সজলবাবুকে আগেকার দিনে ক্যাম্পে অস্ত্রোপচারের পর মোটা কাচের যে চশমা দেওয়া হতো তাও বলেছেন। সজলবাবুর মনে আছে, তাঁর স্কুলেই বছরে একবার চক্ষুশিবির হতো। শিবির শেষে মাসখানেক পর যে অনুষ্ঠানে চশমা দেওয়া হতো, সে অনুষ্ঠানেও তিনি থাকতেন। ওই সময়ই ছানি অস্ত্রোপচারের পর মোটা কাচের চশমার বিষয়ে এক ধরনের ভীতি জন্মেছিল তাঁর। ৪০ বছর বয়সের পর নিজে চমশা ব্যবহার করছেন। চশমার প্রতি এক ধরনের বিরক্তি রয়েছে তাঁর। চিকিৎসক যখন বলছিলেন, লেন্স সংযোজনের পর আর চশমা লাগবে না, এতে এক ধরনের স্বস্তি বোধ করেছিলেন তিনি।
অস্ত্রোপচার শেষে কালো চমশা ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন চক্ষু শল্যবিদ। চোখের ব্যবহারও সীমিত রাখতে বলেছেন। তাই সজলবাবুর দীর্ঘদিনের পড়ার অভ্যাসে এক ধরনের সাময়িক ইতি টানতে হয়েছে। উভয় চোখে ছানির আবির্ভাবহেতু ছোট ছয় পয়েন্ট অক্ষরের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন সম্পর্ক তাঁর অনেক দিনের। অস্ত্রোপচার শেষে একপর্যায়ে চশমা ছাড়াই সব ধরনের লেখা পড়ার প্রত্যাশাটা তাঁকে তাই আন্দোলিত করে। দৃষ্টির কাজ কমে গেলেও ্নৃতির জগৎটায় তাঁর বিচরণ বেড়েছে। অতীতের বিভিন্ন ্নৃতি তাঁর চোখের সামনে ভিড় জমায়। বাসায় স্কুল-কলেজে পড়া নাতি-নাতনিদের মুখে শুনতে পান, মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধকালীন পত্র যোগাযোগের ওপর একাত্তরের চিঠি প্রকাশ হতে যাচ্ছে। তাঁর খুব আনন্দ হয়, চশমা ছাড়াই হয়তো পড়তে পারবেন তা! তিনি কালো চমশার ভেতর দিয়ে টেলিভিশনে কিছু অনুষ্ঠান দেখেন। দূরের সবকিছু বেশ ভালো দেখা যায়। কিন্তু কাছে তিনি তেমন দেখতে পান না। সজলবাবুর মন খারাপ হয়। মনে প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি তাঁর অস্ত্রোপচারে কোনো ত্রুটি হয়েছে? এক মাস পর তিনি তাঁর সার্জনের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি চোখ পরীক্ষা করে চশমার প্রেসক্রিপশন তুলে দেন হাতে। চিকিৎসক বলেন, এ চশমা ব্যবহার করবেন। ছয় মাস পর আবার আসতে হবে, তখন প্রয়োজনে পাওয়ার বদলাতে হতে পারে। সজলবাবু প্রশ্ন করেন, লেন্স সংযোজনের পরও কি চশমা ব্যবহার করতে হয়?
হ্যাঁ।
কেন?
বিভিন্ন দূরত্বে দেখার জন্য চোখের অভ্যন্তরের লেন্সের আকৃতির পরিবর্তন প্রয়োজন। স্বাভাবিক লেন্স পারে বলেই শিশু-কিশোর-যুবক বয়সীরা সব ধরনের দূরত্বে সবকিছু দেখতে পায়। কৃত্রিম লেন্সের সে ক্ষমতা নেই। এ ছাড়া ৪০ বছর বয়সের পর ছানি ছাড়াও আমাদের স্বাভাবিক লেন্সও সে ক্ষমতা
হারিয়ে ফেলে। তাই চল্লিশের পর কাছের দৃষ্টির জন্য স্বাভাবিক চোখে চশমা ব্যবহার করতে হয়। ছানি অপারেশনের পর +২·৫০ ডিএস লেন্স কাছের দৃষ্টির জন্য প্রয়োজন হয়। কিছুটা বিষণ্ন মন নিয়েই তিনি চক্ষুবিশেষজ্ঞের চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসেন। তাঁর মনে নানা প্রশ্ন দানা বাঁধে। অস্ত্রোপচার ঠিক হয়েছে তো? ঢাকা গেলে কি ভালো হতো? ঢাকার রোগীরাও কি চশমা ব্যবহার করে? নিজের ভেতরকার এসব অতিসাধারণ প্রশ্নগুলো নিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলত লজ্জা বোধ হয়। তিনি চশমা তৈরির জন্য চশমার দোকানে যান। ওখানে দেখা হয় তাঁর মতো বয়সী দুই রোগীর সঙ্গে। তাঁদের একজন ঢাকায় অস্ত্রোপচার করিয়েছেন, একজন চট্টগ্রামের বড় চক্ষু হাসপাতালে। দুজনই এসেছেন চশমা তৈরি করতে। তাঁরাও জানালেন, অস্ত্রোপচার যত ভালোই হোক, তাঁদের জন্য চশমা লাগবেই। দূরের জন্য লাগে না। হয়তো সজলবাবুকে তা-ই বলা হয়েছিল। তাঁর মনে পড়ে, তাঁকে ডাক্তার কাছের বিষয়ে কিছু বলেননি। সজল বাবুর বিষণ্নতা কমে আসে। তিনি চশমা তৈরি করে বাড়ি ফেরেন। তাঁর বড় নাতনি একাত্তরের চিঠি বইটি কিনে এনেছে আজই। এক ধরনের ভয়মিশ্রিত আগ্রহ নিয়ে চোখে চশমা লাগিয়ে বইয়ের পাতা ওল্টান। সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে! তিনি সবকিছুই পড়তে পারছেন! আনন্দের শিহরণ লাগে শরীরে! তাঁর মনের অস্ত্রোপচার সম্পর্কিত সব প্রশ্ন, বিষণ্নতা দূর হয়ে যায়। যেন নতুন জীবন ফিরে পেয়েছেন।
শেষ কথা
বিভিন্ন লেন্স নির্মাতা কোম্পানি বিভিন্ন দূরত্বের নিরিখে মাল্টিফোকাল কৃত্রিম লেন্স বের করছে। এখন এসব লেন্স সম্পর্কে সন্দেহাতীতভাবে বিভিন্ন দূরত্বের দৃষ্টি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। তাই অদ্যাবধি কাছের জন্য চশমার ব্যবহারই উত্তম।
মো· শফিকুল ইসলাম
সহযোগী অধ্যাপক, চক্ষুবিজ্ঞান বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ২০, ২০০৯
Leave a Reply