লেখাটি যখন লিখছি তখন টিভিতে খবর হচ্ছে, মেক্সিকোতে বাংলাদেশি একজন লোকেরও মৃত্যু হয়েছে। শোকাহত হলাম। এদিকে খবর এসেছিল আগে, মেক্সিকোর বাইরে সোয়াইন ফ্লু প্রাণ কেড়ে নিয়েছে আমেরিকার টেক্সাসের একটি ছোট্ট বালকের। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সোয়াইন ফ্লু মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছে, সতর্কতার মাত্রা পাঁচ। মেক্সিকোতে আরও পাঁচ দিন জনগণকে ঘরে থাকতে বলা হয়েছে।
কানাডা, অস্ট্রিয়া, নিউজিল্যান্ড, ইসরায়েল, স্পেন, ব্রিটেন, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, ঘানা-সব দেশেই এ রোগের প্রাদুর্ভাবের খবর মিলছে। মেক্সিকোতে সন্দেহজনক মৃত্যু হয়েছে ১৬৮ জনের। আটজনের মৃত্যু যে এ রোগে, তা প্রতিপন্ন হয়েছে। আমেরিকায় হয়েছে একজনের মৃত্যু, সংক্রমণ ঘটেছে ৯১ জনের; নিউজিল্যান্ডে ১৩ জন, কানাডায় ১৯ জন, ব্রিটেনে ৫ জন, স্পেনে ১০ জন, জার্মানিতে তিনজনের ঘটেছে সংক্রমণ। ঘটেছে সংক্রমণ কোস্টারিকা ও পেরুতে। তবে এ পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক মিস্চ্যান বলেন, পৃথিবী এখন ইতিহাসের যেকোনো সময়ের চেয়ে ফ্লু মহামারি ঠেকাতে বেশি প্রস্তুত। সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য হাত ধোয়ার মতো সহজ স্বাস্থ্যবিধি পালন জরুরি। এ পরিস্থিতে শান্ত থেকে জনসচেতনতা বাড়ানো প্রধান কাজ। এই প্রাদুর্ভাবের উৎস খোঁজা হচ্ছে এবং সে দেশের পূর্বাঞ্চলে একটি শূকরের খামার থেকে যে এর উদ্ভব, এমনটি মনে করা হচ্ছে। সোয়াইন ফ্লু শ্বাসযন্ত্রের একটি রোগ। শূকরকে সংক্রমিত করে এমন একটি টাইপ-এ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসও রয়েছে এর মূলে। এর রয়েছে অনেক ধরন এবং সংক্রমণে পরিবর্তন ঘটছে নিরন্তর।
এ খবর পাওয়ার আগ পর্যন্ত সোয়াইন ফ্লু মানুষের হয়েছে জানা ছিল না, তবে এই নতুন ফ্লু অবশ্যই মানুষের শরীরে হানা দিয়েছে এবং এও প্রমাণ মিলেছে যে হাঁচি-কাশির মাধ্যমে মানুষ থেকে মানুষে এর বিস্তার ঘটছে।
কী এমন নতুন খবর? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দৃঢ়ভাবে বলছে, অন্তত কয়েকটি এমন ফ্লু সংক্রমণের পেছনে রয়েছে ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপের এইচ১এন১ প্রজাতির এমন রূপ, যা একেবারে নতুন। আগে কখনো দেখা যায়নি। অথচ সোয়াইন ফ্লু ঋতুকালীন ফ্লুর প্রাদুর্ভাবের মতোই, তবে এ থেকে মানুষের মৃত্যু হয়েছে মেক্সিকো ও আমেরিকায়ও।
এইচ১ এন১ প্রজাতি, যা ১৯১৮ সালে ফ্লু মহামারি ঘটিয়েছিল। এর একটি নতুন রূপ ঘটিয়েছে এই প্রাদুর্ভাব। তবে বিশ্বজুড়ে মহামারির মতো ঘটনা ঘটবে এখন, তা বলা যাচ্ছে না। এর যদিও চিকিৎসা রয়েছে, তবে প্রতিরোধক কোনো টিকা নেই। ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি, যেমন হাত ধোয়া এবং মুখ-নাক ঢেকে হাঁচি ও কাশি দেওয়া-এগুলো প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় অভ্যাস। মুখ ও নাক খোলা রেখে হাঁচলে বা কাশলে সংক্রমিত লোকের ছড়ানো ভাইরাস বাতাসে থাকতে পারে দু-তিন ঘণ্টা। এর পেছনে যে এইচ১ এন১ ভাইরাস, এই ভাইরাস ঋতুকালে নিয়মিত ফ্লু ঘটাচ্ছে।
তবে এইচ১ এন১ প্রজাতির এবারের রূপটি ভিন্নঃ এতে যে ডিএনএ রয়েছে, সেগুলো এসেছে মানুষ, পাখি ও শূকরের ফ্লু ভাইরাস-তিনটি থেকেই। ফ্লু ভাইরাসের এমন ক্ষমতা রয়েছে যে এরা পরস্পর জিন বিনিময় করতে পারে। এবং মনে হচ্ছে, এইচ১ এন১ প্রজাতির নতুন এই রূপটি মানুষ, পাখি ও শূকরের ভাইরাসের জীবনের সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছে।
কীভাবে এল
বিভিন্ন প্রজাতির ফ্লু ভাইরাস আশ্রয় নেয় বিভিন্ন প্রাণীতে। ইনফ্লুয়েঞ্জা এ ভাইরাসের হতে পারে মিউটেশন বা পরিব্যক্তি। এটি হতে পারে দুভাবেঃ অ্যান্টিজেন প্রবাহ, যা দীর্ঘদিন চলে ঈষৎ এই মিউটেশন ঘটলে শরীর এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। আবার অ্যান্টিজেন স্থানান্তরের মাধ্যমে এসেছে নতুন এইচ১ এন১ প্রজাতি, যার বিরুদ্ধে মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। সোয়াইন ফ্লু বলা হচ্ছে, কারণ শূকরকে শূকর, পাখি ও মানুষের ফ্লু ভাইরাস জিনের মিশ্রণের আধার বলে মনে করা হয়েছে। নতুন ফ্লু ভাইরাসে এসেছে এই তিনটি ভাইরাসের জিনের মিশ্রণে। নতুন ভাইরাসটি শূকর থেকে লাফিয়ে চলে এল মানুষের মধ্যে এবং দেখা গেল হাঁচি-কাশির মাধ্যমে মানুষের মধ্যে পরস্পর সম্প্রচারও ঘটেছে।
তবে ঋতুকালীন ফ্লুর উপসর্গ ও সোয়াইন ফ্লুর উপসর্গ মানুষের মধ্যে প্রায় একই রকম। কফ, কাশ, জ্বর, গলাব্যথা, শরীরে ব্যথা, শীত শীত লাগা ও ক্লান্তি-এসবই হলো উপসর্গ। ঋতুকালীন ফ্লু প্রতিবছরই জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। সারা পৃথিবীতে এতে মারা যায় আড়াই লাখ থেকে পাঁচ লাখ লোক। এখনো পর্যন্ত বেশির ভাগ সোয়াইন ফ্লুর প্রকোপ মৃদু, পাতলা মল কোনো কোনো ক্ষেত্রে হচ্ছে। তাই এ নিয়ে বড় রকমের আতঙ্কের কারণ নেই। সারা বিশ্বই যে এর প্রতিরোধে এখন অনেক বেশি প্রস্তুত।
১৯১৮ সালে যে ফ্লু মহামারি হয়েছিল স্পেনে, এতে মারা গিয়েছিল ৫০ মিলিয়ন মানুষ (এইচ১ এন১ ফ্লু)। ১৯৫৭ সালে এশিয়ান ফ্লুতে মারা যায় দুই মিলিয়ন লোক। এর মূলে ছিল এইচ২ এন২ ভাইরাসের মানবরূপ, সঙ্গে মিশ্রিত ছিল বুনোহাঁসের একটি পরিব্যক্তি হওয়া প্রজাতির জিন।
১৯৬৮ সালে হলো যে প্রাদুর্ভাব, হংকংয়ে যা ধরা পড়ল, এইচ৩ এন২ প্রজাতি ছিল এর মূলে। মারা গেল পৃথিবীজুড়ে এক মিলিয়ন লোক।
তবে বর্তমান ফ্লু রোগের বিরুদ্ধে সব দেশ ও সরকারকে জরুরি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে পরামর্শ দিচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। মহামারির মতো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য তৈরি থাকতেও বলা হচ্ছে। তবে আশার কথা হলো, মানুষ যেহেতু প্রতিবছরই প্রায় এইচ১ এন১ প্রজাতির মুখোমুখি হয়, সে জন্য এই নতুন রূপের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সূচনায় মানুষ টিকে থাকতে পারবে। তবে এবার যারা আক্রান্ত, এরা প্রায় সবাই তরুণ। আর স্বাভাবিক ঋতুকালীন ফ্লু বেশি হয় বয়স্কদের মধ্যে।
এই ভাইরাস কি দমন করা যাবে?
বর্তমানে আকাশভ্রমণের যুগে দমন কাজ হবে খুবই কঠিন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলে, উড়োজাহাজের উড়ালকে বন্ধ করে লাভ নেই। আর যাত্রীদের স্ক্রিনিংও বেশি কার্যকর হবে না। কারণ, অনেক সংক্রমিত লোকের মধ্যে উপসর্গ থাকে না। অবশ্য এর চিকিৎসা আছে। ফ্লু চিকিৎসার ওষুধ টামিফ্লু ও রেলেনজা সূচনাকালে দিলে বেশ কার্যকর।
তাহলে কীভাবে নিরাপদ থাকবেন
সোয়াইন ভাইরাসের সংস্পর্শে এসেছে এমন কারও, যেমন মেক্সিকোর সে এলাকাবাসী বা সেখানে ভ্রমণ করে এলে এরা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন। তবে ঘর থেকে বেরিয়ে না গিয়ে ঘরে থেকে সাধারণ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া ভালো। এতেও বিস্তার রোধ হবে।
প্রতিরোধ করতে হবে যেভাবে
— যারা অসুস্থ, যাদের সর্দি, জ্বর, কাশ রয়েছে, এদের সংস্পর্শ এড়ানো উচিত।
— ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি চর্চা জরুরি। হাঁচি দেওয়া ও কাশের সময় নাক-মুখ ঢেকে রাখা উচিত। টিস্যু দিয়ে হাঁচি বা কাশি ঢেকে ঝেড়ে ফেলে দেওয়া উচিত বর্জ্য পাত্রে।
— একজন থেকে অন্যজনের মধ্যে সংক্রমণ রোধের জন্য হাত বারবার সাবানজল দিয়ে ভালো করে ধোয়া উচিত। আর হাত দিয়ে দরজার হাতল ধরলে তা ধোয়ার জিনিস দিয়ে ধুয়ে ফেলা উচিত।
— যাদের ফ্লুর মতো অসুখ হয়েছে, রোগের বিস্তার এড়ানোর জন্য এরা নাক-মুখ ঢাকার জন্য মুখোশ ব্যবহার করবেন।
ফ্লু ভাইরাস শীতপ্রধান অঞ্চলে প্রকোপ ফেলার আশঙ্কা বেশি। উষ্ণ অঞ্চলে এর প্রকোপ পড়বে কম। তাই বিশ্বমারি শিগগিরই ঘটার আশঙ্কা কম। দেখা যাচ্ছে, মেক্সিকোতে প্রাদুর্ভাব ঘটা সোয়াইন ফ্লু এক সপ্তাহের মধ্যে এসে পড়েছে এশিয়ায়। দক্ষিণ কোরিয়া, ইসরায়েলে রোগীর সন্ধান মিলেছে।
হংকংয়ে পাওয়া গেল সোয়াইন ফ্লুর রোগী, এশিয়ায় পদধ্বনি। পাওয়া গেল ডেনমার্কেও। মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে এটি ছড়িয়ে পড়ার খবর এসেছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও যাতে এর সংক্রমণ না হয়, এ জন্য সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রধান তিন বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দরে নেওয়া হয়েছে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ।
বাংলাদেশে এখনো সোয়াইন ফ্লুতে আক্রান্ত কোনো রোগী পাওয়া যায়নি। এখন পর্যন্ত আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। জনসচেতনতা বাড়ানো এবং জরুরি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ১৪ দেশের আগত যাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য চালু হয়েছে স্বাস্থ্যসহায়তা ডেস্ক। এ ছাড়া এ অসুখের জন্য ওষুধও পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে বাংলাদেশে। তাই ভয়ের কিছু নেই, রোগ সম্পর্কে সচেতন থাকা ও সতর্ক থাকা জরুরি। আরেকটা সুখবর হলো, সোয়াইন ফ্লুতে সর্বপ্রথম আক্রান্ত মেক্সিকোর ভেরিক্রুজ রাজ্যের শহর লাগ্লোবিয়ার এক কক্ষের একটি খুপরিঘরে লালিতপালিত শিশু এদগার হার্নান্দেজ এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।
প্রতিরোধক টিকা আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে, তবে তা জানুয়ারির আগে হবে বলে মনে হয় না। গত শুক্রবার হংকংয়ে প্রথম সোয়াইন ফ্লু রোগী শনাক্ত করা হলো। এশিয়ার সোয়াইন ফ্লু রোগী প্রথম জোরালোভাবে প্রতিপন্ন হলো।
গত বুধবার পর্যন্ত এ রোগের নাম ছিল সোয়াইন ফ্লু। বৃহস্পতিবার থেকে সোয়াইনের ‘এস’ শব্দটি বাদ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নতুন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের নাম দিয়েছে ইনফ্লুয়েঞ্জা ‘এ’ (এইচ১ এন১)। সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনও এই নামটি বাদ দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে। সোয়াইন ফ্লু ভাইরাসটিকে শুরুতে যতটা ভয়ঙ্কর করা মনে হচ্ছিল, আসলে এটি ততটা ভয়ঙ্কর নয়। এটা সাধারণ ফ্লু ভাইরাসের মতোই এবং এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী যে মহামারির আশঙ্কা করা হয়েছিল তা নাও ঘটতে পারে। তাই এ নিয়ে খুব বেশি আতঙ্কিত হওয়ার কারণ আপাতত নেই। সবাই সুস্থ ও নিরাপদ থাকুন, এই কামনা।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম
অধ্যাপক, ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ০৬, ২০০৯
Leave a Reply