অনেক শিশু-কিশোর তাদের স্বভাবসুলভ আচরণ না করে অভিভাবকের অবাধ্য হয়ে ওঠে এবং অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ করে। সমাজের সঙ্গে তারা সঠিকভাবে মিশতে পারে না। তাদের এ সমস্যাকে বলা হয় আচরণজনিত সমস্যা (কন্ডাক্ট ডিজঅর্ডার)। এ ধরনের সমস্যা শিশুর মনোবিকারজনিত সমস্যা। বাবা-মা যদি কোনো অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকেন, সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকেন, ছোটবেলায় যদি শিশুর বেড়ে ওঠা সঠিকভাবে না হয়, বাবা-মার সঙ্গে শিশুর সম্পর্ক যদি গতানুগতিক ও স্বাভাবিক না হয়, শিশু যদি শৈশবে কোনো ধরনের শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়, যদি স্কুলের পরিবেশ শিশুর জন্য প্রতিকূল থাকে, যদি শিশুর পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ভালো না হয়, তবে শিশুর আচরণে সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আবার ওপরের কোনো কারণের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও শিশু-কিশোরের আচরণগত সমস্যা হতে পারে।
আবার জেনেটিক কারণেও এ ধরনের সমস্যা হতে পারে। এ ধরনের সমস্যায় আক্রান্ত শিশু-কিশোরদের মধ্যে যে লক্ষণগুলো দীর্ঘ সময় ধরে বিদ্যমান থাকতে পারে, তা হলো অন্যদের উপহাস, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, হুমকি দেওয়া বা আতঙ্কিত করার চেষ্টা করা; হঠাৎ করে মারামারিতে জড়িয়ে পড়া; মারামারির সময় মারাত্মক অস্ত্র ব্যবহার করা; অন্য মানুষের শারীরিকভাবে নিষ্ঠুর পীড়ন করা; বিভিন্ন পশুপাখির প্রতি নির্দয় হওয়া, যেমন-বিড়াল, কুকুর বা পাখিকে কষ্ট দেওয়া বা হত্যা করা; চুরি করা, মিথ্যা বলা, অন্যকে যৌন হয়রানি করা, কোনো কিছু নষ্ট করার জন্য আগুন লাগিয়ে দেওয়া, অন্যের সম্পত্তির ক্ষতি করা, বিনা কারণে ঘর বা গাড়ি ভাঙচুর করা, সব সময় অভিভাবকের বিরুদ্ধাচরণ করা, বিনা অনুমতিতে, কোনো যোগাযোগ না করে রাতে বাসার বাইরে থাকা; গভীর রাতে বাসা থেকে একাধিকবার বের হয়ে যাওয়া এবং প্রায়শই স্কুল-পালানোর অভ্যাস থাকা।
এ আচরণজনিত সমস্যার জন্য শিশুর প্রতি, তার পরিবারের প্রতি এবং তার চারদিকের পরিবেশের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। শিশুকে তার আচরণ পরিবর্তনের জন্য সুযোগ দিতে হবে। প্রথমেই সমাজের চোখে তাকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। তাকে সামাজিক দক্ষতা শেখার জন্য ছোট ছোট সামাজিক আচরণ রপ্ত করাতে হবে। ছোট ছোট সমস্যা কীভাবে সমাধান করা যায়, এ বিষয়ে তাকেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। প্রয়োজনে তাকে বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে ‘কাউন্সেলিং’ এবং প্রয়োজনীয় সাইকোলজিক্যাল চিকিৎসা প্রদান করতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শমতো তাকে ওষুধ সেবন করাতে হবে। শিশুর বাবা-মাকে হতে হবে সহনশীল। অযথা রূঢ় আচরণ করা চলবে না। নিজেদের মধ্যে সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন আরও দৃঢ় করতে হবে। শিশুর সামনে দাম্পত্য বা পারিবারিক কলহ পরিহার করতে হবে। শিশুকে নিয়ে সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে হবে এবং সপরিবারে বেড়াতে যেতে হবে। শিশুর প্রতি যেমন রূঢ় হওয়া চলবে না, তেমনি অত্যধিক আদরও তাকে দেওয়া যাবে না, যখন-তখন তার সব আবদার মেটানো চলবে না। শিশুকে নৈতিকতাবোধ, ধর্মীয় অনুশাসন এবং দেশীয় সংস্কৃতি শিক্ষা দিতে হবে। পরিবারের পাশাপাশি এ ধরনের শিশুর প্রতি সমাজকেও হতে হবে সহনশীল ও সহানুভূতিসম্পন্ন। শাস্তির বদলে তাকে সংশোধনের উদ্যোগ নিতে হবে। ‘ভালো কাজের জন্য প্রশংসা-পুরস্কার এবং মন্দ কাজের জন্য পুরস্কার-প্রশংসা বন্ধ’-এ নিয়ম অনুসরণ করতে হবে।
আহমেদ হেলাল
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ০৬, ২০০৯
Leave a Reply