আমাদের দেশের মেয়েরা স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্নে পরিধিও তাঁদের অনেক বড়। সাজানো-গোছানো গৃহের গণ্ডির বাইরেও অনেক বড় জায়গায় নিজেকে ছড়িয়ে দিতে চান তাঁরা। নিজের কাজ দিয়েই নিজের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে চান। পারসোনা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কানিজ আলমাস খানও তেমনই একজন মানুষ। তবে শুধু স্বপ্ন দেখা নয়, সেটার বাস্তবায়নও প্রায় করা হয়ে গেছে তাঁর। রূপবিশেষজ্ঞ পরিচয় ছাপিয়ে আজ তিনি হয়ে উঠেছেন একজন সফল ও পুরস্কৃত উদ্যোক্তা। মানুষের সুন্দর থাকার, সুন্দর হয়ে ওঠার ইচ্ছাপূরণের সঙ্গী হয়ে গেছেন তিনি। অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থানের সহায় হয়েছেন তিনি। আর নিজের জন্য এনেছেন সুনাম, প্রতিষ্ঠা, সাফল্য। সম্প্রতি তিনি অর্জন করেছেন ডেইলি স্টার-ডিএইচএল বাংলাদেশবিজনেস অ্যাওয়ার্ড। কানিজ আলমাস খান পুরস্কারটি পেয়েছেন আউটস্ট্যান্ডিং উইমেন ইন বিজনেস বিভাগে।
না বুঝেই!
রূপবিশেষজ্ঞ হিসেবে কানিজ আলমাস খান কাজ শুরু করেন ১৯৯০ সালে। ঢাকা শহরে তখন বিউটি পারলারের সংখ্যা হাতে গোনা। বোন আর বান্ধবীরা মিলে ফুলিয়ে খোঁপা করে দেন। টুথপেস্ট আর কুমকুম দিয়ে মুখে এঁকে দেন নানা নকশা। বউসাজ তখন অনেকটা এমনই হতো। ফেসিয়াল, হেয়ার ট্রিটমেন্ট—পারলারে গিয়ে এসব করানোর ধারণা ছিলই না বলা চলে। এর মধ্যেই জেরিনা আজগর, গীতি বিল্লাহরা এগিয়ে নিচ্ছিলেন নিজেদের। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হলেন কানিজ আলমাস খান। ঢাকার কলাবাগানের ছোট্ট এক বাড়িতে যাত্রা শুরু করল তাঁর পারলার ‘গ্ল্যামার’। ‘সে সময় না বুঝেই একটা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। আজকে উদ্যোক্তা হিসেবে আমার এই পরিচিতি হতে পারে, তখন সেটা মনেই আসেনি।’ বললেন তিনি।
গান করতেন খুব মনোযোগ দিয়ে। সংগীতশিল্পী হওয়ারও স্বপ্ন দেখতেন। সেটা না হয়ে তাঁর রূপবিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠা। ‘বড়দের সঙ্গে পারলারে যেতাম। কিন্তু সাজগোজ করে সুন্দর হয়ে বেরিয়ে আসার ব্যাপারটা আমাকে টানেনি। বরং হেয়ার ড্রায়ারের শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে, কচকচ করে কাটা চুল পড়ছে মেঝেতে, পারলারের মেয়েরা ব্যস্ত পায়ে ঘুরছে—এই জিনিসগুলোই আমি অবাক হয়ে দেখতাম। পারলারের এমন কর্মকাণ্ড, ভেতরের পরিবেশটা দারুণ আপন মনে হতো। সেই ভালোলাগাই আমাকে নিয়ে এল এই পেশায়।’ শুরুর কথা জানালেন তিনি।
রূপবিশেষজ্ঞ থেকে ব্যবসায়ী
তাঁর কাছে সেজেগুঁজে মুখে তৃপ্তির হাসি আর সৌন্দর্যের দীপ্তি নিয়ে বেরিয়ে যান গ্রাহকেরা। বারবার ধন্যবাদ জানান তাঁকে। এসব ভালো লাগা নিয়েই ছিলেন তিনি। একসময় তাঁকে মনোযোগ দিতেই হলো ব্যবসায়, লাভ-ক্ষতির হিসেবে—‘বিউটি পারলারের সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর বসানো হলো, খরচও অনেক বাড়ল। ব্যবসার বুঝতাম না কিছুই। কিন্তু এটা মাথায় ছিল, আমাকে খরচ মিটিয়ে লাভ করতে হবে। ঠকে ঠকেই শিখতে শুরু করলাম।’
বড় জায়গা, বড় স্বপ্ন
পারসোনার শুরুর কথা বলতে গিয়ে কানিজ আলমাস খান বললেন—কলাবাগানের সেই বাসায় বিউটি পারলার, সেখানেই পরিবার নিয়ে থাকা। পারলারের গ্রাহকও তত দিনে বেড়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে সানসিল্কের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হওয়ার দায়িত্বও পেয়েছেন। ‘তখন বিউটি পারলার সম্পর্কে মানুষের ধারণা খুব ভালো ছিল না। কেউ সহজে বাড়ি ভাড়া দিতে চাইত না। শেষমেশ ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়কে একটি বাড়ি পাওয়া গেল। মালিক একজন নারী। মেয়েদের উদ্যোগ, মেয়েরা কাজ করবে শুনে তিনি অনেক উৎসাহ দিলেন। এত দিন বাড়ি খুঁজতে গিয়ে নানা প্রশ্ন, নানা সন্দেহ। সেই প্রথম বাড়ি খুঁজতে গিয়ে সম্মান পাওয়া গেল।’ জানালেন কানিজ।
এখানেই ১৯৯৮ সালে যাত্রা শুরু হয় পারসোনার। কর্মীসংখ্যা তখন ১২। এখান থেকেই ডালাপালা মেলে ছড়িয়ে পড়া ঢাকার গুলশানে, মিরপুরে। পারসোনা পরিবারে দিনে দিনে যোগ হয়েছে ছেলেদের সৌন্দর্যচর্চার জন্য পারসোনা অ্যাডামস, শরীরচর্চার জন্য পারসোনা হেলথ, স্প্রিং স্পা, ছবি তোলার জন্য স্টুডিও পারসোনা, লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন ক্যানভাস, সৌন্দর্যচর্চার প্রশিক্ষণের প্রতিষ্ঠান পারসোনা ইনস্টিটিউট অব বিউটি অ্যান্ড লাইফস্টাইল। এখন এক হাজার ২০০ জনের বিরাট কর্মীবাহিনী আছে তাঁর সঙ্গে। যাঁদের ৯৯ শতাংশই নারী। কানিজ আলমাস খান জানালেন, ‘আশা করছি, কর্মীসংখ্যা এ বছরের মধ্যে দ্বিগুণ হয়ে যাবে। সামনে ঢাকার উত্তরা ও বারিধারায় পারসোনার শাখা খোলা হবে। এখানে আরও বড় পরিসরে, নতুন সব সেবা দিতে চেষ্টা করব গ্রাহকদের।’
পেছনে শক্ত অবলম্বন
‘আমি বিশ্বাস করি, আমার পেছনে যদি পরিবারের এমন সমর্থন না থাকত তাহলে কিছুই করতে পারতাম না। যোগ্যতা, মেধা অনেকেরই থাকে। কিন্তু সেগুলোর বিকাশ হতে পারে না পরিবারের সাহায্য ছাড়া। আমি খুব ভাগ্যবান যে আমার বাবার বাড়ি এবং শ্বশুরবাড়ি—দুই জায়গা থেকেই উৎসাহ পেয়েছি। আমার স্বামী, মেয়ে দিশার সাহায্য পেয়েছি সব সময়। আমার পরিবারের সদস্যরা পারসোনা গ্রুপের সঙ্গেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত আছেন।’ বলেছেন কানিজ আলমাস খান।
বদলে দিয়েছেন কত কিছুই
কানিজ আলমাস খানের অর্জন শুধু তাঁর একার নয়। তাঁর উদাহরণ সামনে রেখে অনেকেই অনুপ্রেরণা খুঁজে নিয়েছেন নিজের কিছু একটা দাঁড় করানোর। আজকে আমাদের দেশের সৌন্দর্যচর্চার ক্ষেত্রটি এত বড় হয়েছে তাঁর মতন উদ্যোক্তাদের কারণে। ‘একটা সময় পুরো এক বছর ধরে পারলারের জন্য একটা বাড়ি খুঁজেছি। আর এখন কোনো বড় ইমারত তৈরি হলে আমাদের কাছে ব্রোশিওর পাঠানো হয়, জানতে চাওয়া হয় আমরা সেটা ভাড়া নেব কি না। ব্যাংক থেকে যোগাযোগ করে জানতে চায় আমাদের কোনো সাহায্য লাগবে কি না। এটা অনেক বড় পরিবর্তন। তবে এটাকেও ছাড়িয়ে যায় আমার অন্য আরেকটি অর্জন। রূপবিশেষজ্ঞ আজ সম্মানের একটি পেশা। তাঁদের দিকে সন্দেহের তীর তাক করা হয় না আর। বরং উদ্যোক্তা হিসেবে মূল্য পান তাঁরা। এটাই আমার সবচেয়ে তৃপ্তির প্রাপ্তি।’ মুচকি হাসিতে আত্মপ্রত্যয় ছড়িয়ে বলেন কানিজ আলমাস খান।
রুহিনা তাসকিন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ১১, ২০১০
Leave a Reply