রক্তনালির মাধ্যমে সারা শরীরে রক্ত সঞ্চালিত করে হৃৎপিণ্ড। হৃদযন্ত্র থেকে পাম্প হওয়া রক্ত দিয়ে ধমনির দেয়ালে যে বল প্রয়োগ হচ্ছে, সেই বলের পরিমাণ হলো রক্তের চাপ। ধমনির মধ্য দিয়ে রক্ত স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বল প্রয়োগে যখন পাম্প হতে থাকে, তখনই হয় উচ্চ রক্তচাপ। ধমনির ওপর এই বাড়তি চাপের কারণে ধমনির দেয়ালে চর্বির স্তর পলির মতো পড়তে থাকে। এই প্রক্রিয়া হলো এথারোস্ক্লেরোসিস। এর পরিণতিতে হার্ট অ্যাটাক ও মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের (স্ট্রোক) মতো সমস্যা হয়। এথারোস্ক্লেরোসিসের অন্যান্য ঝুঁকি হলো ধূমপান ও রক্তে উঁচুমান কোলেস্টেরল থাকা। উচ্চ রক্তচাপ হলো রক্ত সংবহনতন্ত্রের সচরাচর একটি সমস্যা। এ সমস্যা জগৎজোড়া। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এই সমস্যা বাড়ে। প্রবীণদের ধমনির স্থিতিস্থাপকতা কমে যাওয়ায় তাঁদের রক্তচাপ বাড়ে কিছুটা স্বাভাবিক নিয়মেই।
এমনিতে তেমন উপসর্গ হয় না। উচ্চ রক্তচাপ আছে এমন বুঝতেই পারে না অনেকে। বিশেষজ্ঞরা তাই বলেন, প্রত্যেকেরই নিয়মিত রক্তচাপ মাপানো উচিত।
কীভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় রক্তচাপ
হৃৎপিণ্ড যখন সংকুচিত হয়, তখন বাঁ নিলয়ের ভেতরের রক্ত সজোরে বেরিয়ে আসে মহাধমনিতে এবং ধমনিগুলোতে। এরপর রক্ত প্রবেশ করে ধমনিকায়। এই ছোট রক্তনালির দেয়াল পেশিবহুল। ধমনিকার পেশল দেয়ালের ‘টোন’ নির্ধারণ করে ধমনিকা শিথিল থাকবে, না সংকুচিত হবে। সরু হয়ে গেলে তখন রক্তের পথ রোধ হয়। রক্তের প্রবাহের এই হ্রাস পাওয়া ধরা পড়ে মস্তিষ্কে, কিডনিতে এবং অন্যত্র। স্মায়ু হয় উদ্দীপিত, আর হরমোন উৎপন্ন হতে থাকে। হৃৎপিণ্ডও আরও জোরে স্পন্দিত হয়, রক্তচাপ তাই থেকে যায় উচ্চমানে। এভাবে ধমনিকার মধ্য দিয়ে রক্তের রোধকে অতিক্রম করার চেষ্টা চলে। রক্তের প্রবাহ ভালো রাখার জন্য বেড়ে যায় রক্তচাপ এবং মস্তিষ্ক ও কিডনির কাজকর্মও থাকে সচল। স্বাভাবিকভাবে এ ধরনের সমন্বয় চলে। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে এই সমন্বয় হয়ে পড়ে স্থির, অটল-এটিই উচ্চ রক্তচাপ।
মৃদু, মাঝারি ও বেশি রক্তচাপ
উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে মৃদু, মাঝারি ও বেশি। আমরা যখন ব্যায়াম করি, তখন রক্তচাপ এমনিতেই কিছু বেড়ে যায়। বিশ্রাম নেওয়ার সময়ও যদি রক্তচাপ উঁচুতে অটল হয়ে থাকে, তখনই তা উদ্বেগের কারণ। এর মানে হলো, হৃৎপিণ্ড কাজের ভারে চাপগ্রস্ত আর ধমনির দেয়ালের ওপর পড়ছে অতিরিক্ত চাপ। রক্তচাপ দুই রকম-সিসটোলিক ও ডায়াসটোলিক। হৃৎযন্ত্র যখন পাম্প করে, তখন ধমনিতে সর্বোচ্চ যে চাপ হয় একে বলে সিসটোলিক চাপ। সাধারণত এটি ১১০-১৩০ মিলিমিটার পারদ চাপের মধ্যে থাকে। হৃৎপিণ্ড যখন শিথিল হয় এবং রক্তে পরিপূর্ণ হতে থাকে, তখন ধমনিতে যে চাপ হয় একে বলে ডায়াসটোলিক চাপ। এটি ৭০-৮০ মিলিমিটার পারদ চাপের মধ্যে থাকে।
লবণ খাওয়া কমান
দেখা গেছে, সারা বিশ্বেই মানুষের মধ্যে গড়ে প্রতিদিন লবণ গ্রহণের পরিমাণ হলো ৯ থেকে ১২ গ্রাম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিদিন ৫ থেকে ৬ গ্রামের বেশি লবণ খাওয়া ঠিক নয়। সম্প্রতি বলা হচ্ছে, প্রতিদিন লবণ আধা চা চামচের বেশি খাওয়া উচিত নয় এবং শিশুদের জন্য আরও কম। জাতীয় উদ্যোগে মানুষের মধ্যে লবণ খাওয়া কমানোর প্রচেষ্টা হলো হৃদরোগ ও রক্তনালির রোগ প্রতিরোধের সাশ্রয়ী উপায়।
গবেষকেরা দেখেছেন, লবণ খাওয়া যদি অর্ধেক কমানো যায়, তাহলে বিশ্বজুড়ে হার্ট অ্যাটাক ও মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে আনুমানিক ২৫ লাখ মৃত্যু ঠেকানো যাবে।
এ জন্য বিশ্বজুড়ে নানা কৌশল অবলম্বনের কথা বলা হচ্ছে। উন্নত দেশগুলোতে খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কম লবণ যোগ করতে বলা হবে। সরকার জনগণকে খাবারে লবণ কম খাওয়ার জন্য উৎসাহিত করবে। খাবারের লেবেলে লবণের পরিমাণ লেখা থাকবে। জনগণকে বেশি লবণ খাওয়ার বিপদ সম্পর্কে জানাতে হবে। উন্নয়নশীল দেশেও এসব ব্যাপারে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
যারা খাবারে নুন বেশি খায়, তাদের উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার ঝুঁকি খুব বেশি। পরিণতিতে হার্ট অ্যাটাক ও মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ এমনকি কিডনির রোগও হতে পারে। তবে শুধু লবণদানি থেকে খাবারে নুন ঝেড়ে খাওয়া বন্ধ করলেই হবে না, আমাদের খাদ্যের ৮০ শতাংশ লবণ আসে প্রক্রিয়াজাত, প্যাকেট করা খাবার, রেস্তোরাঁর খাবার ও ফাস্টফুড থেকে। তাহলে সেসব খাবার বর্জনও কিন্তু কাম্য। দোকান থেকে প্যাকেট খাবার কেনার আগে লেবেলে লবণের পরিমাণ জেনে নিন। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিশ্বজুড়ে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, উচ্চ রক্তচাপ ও কিডনি রোগের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ হলো মৃত্যুর একক বৃহত্তম কারণ। আর রক্তচাপ বাড়ার প্রধান কারণ হলো অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ। লবণ খাওয়া অর্ধেক কমালে বিশ্বজুড়ে হার্ট অ্যাটাক, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ ও ক্রনিক কিডনি রোগে ২৫ লাখ মৃত্যু রোধ করা যাবে।
নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে উচ্চ রক্তচাপ
বাসায় প্রতিদিন বা নিয়মিত রক্তচাপ মেপে দেখুন। রক্তচাপ বেশি মনে হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ সেবন করলে তা নিয়মিত করতে হবে।
উচ্চ রক্তচাপ থাকলে চিকিৎসা নিতেই হবে। ধূমপান বর্জন করুন। পরিমিত ব্যায়াম করুন। খাবারে চর্বি, কোলেস্টেরল, নুন, চিনি খাওয়া কমান। ডায়াবেটিস থাকলে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখুন। বেশি আঁশযুক্ত খাবার, কম লবণ, কম চর্বির খাবার খাওয়া-উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণে এসবের কোনো বিকল্প নেই। এভাবে জীবনযাপনে পরিবর্তন এনে আমরা অনেক বড় স্বাস্থ্য সমস্যা এড়াতে পারি।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস
বারডেম, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ০৮, ২০০৯
Leave a Reply