রবি ঠাকুরের ‘কাবুলিওয়ালা’ পড়ে ধারণা খানিকটা হয়তো স্পষ্ট হয়। আরেকটু বড় বেলায় সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘দেশে বিদেশে’ পড়ে কাবুল এবং আফগানিস্থান সম্পর্কে অনেকটাই ধারণা হয়। তারপর তো খবরের কাগজ ছিলই। তালিবানি শাসন, তাদের সরিয়ে আমেরিকার সেনার দেশ দখল, সেদেশের অশান্তি, অরাজকতা, রুক্ষতা, সন্ত্রাসবাদী সন্ত্রাস এবং বিদেশি সেনাবাহিনীর অত্যাচার, মুস্তফা সাহেবের ‘দেশে বিদেশে’ উপন্যাসের ‘জেলের ভিতর অপরাধীদের চামড়া টেনে টেনে তোলার বিবরণ’ সব মিলিয়ে আফগানিস্থান আম বাঙালির কাছে হয়ে ওঠে এক কুখ্যাত দেশ। যে দেশে শান্তি কোনোদিনও পা রাখেনি।
যেতে পারি কিন্তু কেন যাব
কিন্তু রহমত আলির দেশে যে শুধু অশান্তি, হিংসা আর রক্তক্ষরণ হয় না নয়, সেদেশের কিছু কিছু এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও অপূর্ব সুন্দর। দেশের ভাস্কর্য, স্থাপত্য ইত্যাদিও রয়েছে। কিন্তু হিংসার চাপে পড়ে সেদেশের পর্যটনশিল্প খুব একটা উন্নত নয়। রয়েছে নিরাপত্তার অভাবও। তাই সেখানে পর্যটকরা যেতে ভয় পান। আর এখন সেখানে যেতে গেলে তো বুকের পাটাটি বিশাল বড় হতে হবে। তবে যেতে না পারেন সেদেশের বিখ্যাত ভ্রমণস্থানগুলির একটি ভার্চুয়াল ট্যুর তো করা যেতেই পারে। তাহলে সেটাই করা যাক।
পামির পর্বতমালা
পামির শব্দের অর্থ মালভূমি। পামির বিশ্বের সর্বোচ্চ মালভূমি। একে বলা হয় পৃথিবীর ছাদ। মধ্য এশিয়ার এই মালভূমি বা পামির পর্বতমালার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসাধারণ। এটি একটি ইউ আকৃতির উপত্যকা। চারদিকে পর্বত দিয়ে ঘেরা। এটি হিমালয় এবং তিয়ান শান, হিন্দুকুশ, সুলেমান, কুনলুন এবং কারাকোরাম পর্বতের মধ্যে অবস্থিত। অ্যাডভেঞ্চার প্রেমীদের কাছে এই পামির অঞ্চল দারুণ আকর্ষণীয়। পামিরের কাছেই রয়েছে পামির নদী, জোরকুল হ্রদ, গান্ট নদী, কারাকুল হ্রদ।
বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি
আফগানিস্থানের মধ্যভাগে শহর বামিয়ানে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ছিল। তারই প্রমাণ ছিল প্রায় ৫৫ মিটার এবং ৩৫ মিটার উঁচু দুটি বুদ্ধমূর্তি। বিশ্বের বৃহত্তম বুদ্ধমূর্তিগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল এগুলি। মূর্তি দুটি স্থাপিত হয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৫০০ মিটার উঁচু পর্বতের গায়ে খোদাই করা অবস্থায় দাঁড়িয়েছিল প্রায় দেড় হাজার বছরের পুরোনো এই ঐতিহাসিক মূর্তি দুটি। এছাড়াও ঐ অঞ্চলের পর্বতের গায়ে অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট আরও অনেক বুদ্ধ মূর্তি খোদাই দেখতে পাওয়া যায়। ঐতিহাসিকদের মতে খ্রিস্টিয় তৃতীয় থেকে দশম শতক পর্যন্ত এই অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে প্রভাবিত যে বিশেষ ধরনের শিল্পকলা বিকাশ লাভ করেছিল। এগুলি সেই গান্ধার শিল্পেরই উৎকৃষ্ট নিদর্শন। ইউনেস্কো এই মূর্তিগুলিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। কিন্তু তালিবান নেতা মোল্লা মুহম্মদ ওমরের নির্দেশে ২০০১ সালের মার্চ মাসে বড় মূর্তি দুটিকে পাহাড়ের গায়ে ডিনামাইট বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ধ্বংস করা হয়। পরে জাপান, সুইৎজারল্যান্ড সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উদ্যোগে মূর্তি দুটিকে পুনরায় তৈরি এবং পুনঃস্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। বর্তমান পরিস্থিতে অবশ্য় সেই কাজ নিয়ে গভীর প্রশ্ন চিহ্ন রয়ে গেল।
ব্রোঘিল পাস
আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তে অবস্থিত ব্রোঘিল পাস এবং জাতীয় উদ্যান। আফগানিস্থানের চিত্রল শহর থেকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ব্রোঘিল ভ্যালি। এটি প্রধানত পার্বত্য অঞ্চল। অত্যন্ত আকর্ষণীয় জায়গা হলেও ব্রোঘিল পাসে পর্যটকদের জন্য বিশেষ কোনও সুযোগ সুবিধা নেই। এই এলাকার বার্ষিক উৎসব উপলক্ষে এখানে পর্যটকরা ভিড় জমান। চমরি গাইয়ের উপর বসে পোলো খেলা, উলের তৈরি নানা পোশাক, হস্তশিল্প, সাবেকি খাবার এবং সংগীত এখানকার অন্যতম আকর্ষণ। জাতীয় অভয়ারণ্যের ঘাসের জমি, গাছপালা ইত্যাদি বেশ জনপ্রিয়। নানা ধরনের পশু পাখিতে জঙ্গল ভর্তি। আর এই স্থানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
বন্দ-এ-আমির
আফগানিস্থানের রুক্ষ পরিবেশে বন্দ-এ-আমির যেন একটি সবুজ মরীচিকা। বন্দ-এ-আমির জাতীয় উদ্যানের প্রতিষ্ঠা হয় ২০০৯ সালে। এখানে আছে ছয়টি আলাদা আলাদা পার্বত্য হ্রদ। হিন্দুকুশ পর্বতমালার শিখরে প্রায় তিন হাজার মিটার উপরে অবস্থিত এই হ্রদগুলি। বসন্ত এবং গ্রীষ্মকালে এখানে পর্যটকরা আসেন। এই সময় এখানকার আবহাওয়া বেশ মনোরম থাকে। সেই সময় পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ হয় বন্দ-এ পানির এবং বন্দ-এ ঘোলামন-এর জলের ঘন নীল রং।
বাগ-এ বাবর
এখন কাবুলে চলছে তালিবানি শাসন। কিন্তু একটা সময় ছিল যখন কাবুলের অধিপতি ছিলেন মোঘল সম্রাট বাবর। তাঁর নির্মিত বাগ-এ বাবর আজও পর্যটকদের আকর্ষণ করে। অনেক ঐতিহাসিকদের মতে এখানেই সম্রাটকে কবর দেওয়া হয়। সম্রাট বাবরের তৈরি এই বাগানের সৌন্দর্য আজও অক্ষুন্ন রয়েছে। তবে কতদিন এটি সুন্দর থাকবে তা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন রয়েছে।
হিরাট মিউজিয়াম
আফগানিস্তানের তৃতীয় বৃহত্তম শহর হিরাট। এখানকার প্রাচীন সংগ্রহশালাটি ধ্বংস হযে গিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ফের তৈরি হয এই সংগ্রহশালাটি। আফগানিস্থানের ইতিহাস জানা যায় এই সংগ্রহশালায় গেলে। হিরাটের শুক্রবারের মসজিদটিও একটি দর্শনীয় স্থান। তুর্কি, পার্সি এবং মোঘল শিল্পকলার এক অনন্য মিশ্রণের উদাহরণ এই মসজিদ।
সমঙ্গন
প্রাচীনকালে পুরোনো রেশম পথ দিয়ে চলার পথে সমঙ্গন ছিল একটি বিশ্রামাগার শহর। সওদাগরদের কাছে বেশ জনপ্রিয় ছিল এটি। এখনও এর জনপ্রিয়তা নিছক কম নয়। সৌজন্যে এখানকার তখত্-ই-রুস্তম কৃত্রিম গুহার সারি। আনুমানিক তৃতীয়-চতুর্থ শতাব্দীতে এর নির্মাণ হয়। গুহার ভিতরে ছিল প্রাচীন বৌদ্ধ মঠ। তার নিদর্শন এখনও রয়েছে।
এখানেই শেষ নয়, আফগানিস্তানের সৌন্দর্য এবং দর্শনীয় স্থানের বর্ণনা দিতে গেলে পাতার পর পাতা লিখে যেতে হবে। কিন্তু হিংসা, সন্ত্রাস দেশের সেই লাবণ্যকে ধূলিস্মাৎ করে দিয়েছে। ফের কবে আফগানিস্থান ভ্রমণ আদৌ সম্ভব হবে তা কেউ জানে না।
Lifestyle News in Bengali, লাইফস্টাইল খবর, Health Tips, Fashion Trends and Tips in Bangla
2021-09-10 17:17:55
Source link
Leave a Reply