খ্যাতিমান টিভি তারকা ও রিয়েলিটি শো বিগ বসের বিজয়ী সিদ্ধার্থ শুক্লা গত ২ সেপ্টেম্বর বড় ধরনের হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল মাত্র ৪০ বছর। এত অল্প বয়সে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয়েছে বলে অবাক হতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অল্প বয়সে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলেছে- বিশেষত ৩০ থেকে ৫০ এর মধ্যে। কিন্তু কেন এমনটা হচ্ছে? আসুন, এ সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।
হার্ট অ্যাটাক কি?
মায়োকার্ডিয়াল ইনফারকশন হিসেবেও পরিচিত হার্ট অ্যাটাক হলো রক্তপ্রবাহে প্রতিবন্ধকতা জনিত মেডিক্যাল সমস্যা। কোনো প্রতিবন্ধকতার কারণে হার্টের রক্ত চলাচল হঠাৎ থেমে গেলে হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকে। সাধারণত রক্তনালীতে প্লেক গঠনে হার্ট অ্যাটাক হয়। মূলত ফ্যাট ও কোলেস্টেরল জমে প্লেক গঠিত হয়।
রক্ত চলাচল বাধাপ্রাপ্ত হলে হার্টের মাংসপেশি ধ্বংস হতে পারে। এটা এতটাই ভয়াবহ হতে পারে যে, তৎক্ষণাৎ জরুরি চিকিৎসা না করলে মৃত্যু অবশ্যাম্ভাবী। কিছুদিন আগে থেকে কোনো লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা দেওয়া ছাড়াই হঠাৎ করে যে হার্ট অ্যাটাক হয় তা প্রাণনাশক হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, অনেকেরই হার্ট অ্যাটাক হওয়ার কিছুদিন বা সপ্তাহখানেক পূর্বে লক্ষণ বা উপসর্গ প্রকাশ পেয়ে থাকে- এসময় চিকিৎসকের কাছে গেলে ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিলে ঝুঁকি কমে আসে।
বর্তমানে হার্ট অ্যাটাকের ঘটনা বাড়ছে কেন?
হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক শরীরের জন্য নিঃসন্দেহে বড় ধাক্কা। হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকের জন্য নির্দিষ্ট বয়স নেই। বরং জীবনযাপনে অসংগতি, অস্বাস্থ্যকর খাবার, জিনগত সমস্যা ও অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় এর ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এসব কারণে আজকাল অল্প বয়সে হার্ট অ্যাটাক বেশি হচ্ছে- বিশেষ করে ৩০-৫০ বছর বয়সীদের মধ্যে। এছাড়া করোনাকালে হার্ট অ্যাটাকে মারা যাওয়ার আরেকটি সম্ভাব্য কারণ হলো, কোভিড পরবর্তী হার্টের সমস্যা। যারা কোভিড-১৯ থেকে সুস্থ হয়েছেন তাদের অনেকেরই রক্ত জমাটবদ্ধতার সমস্যা হয়েছে। সমস্যাটি হার্ট অ্যাটাকের প্রবণতা বাড়িয়ে দিয়েছে।
মানসিক চাপে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ে?
অল্প বয়সে হার্ট অ্যাটাকের হার বৃদ্ধি সম্পর্কে বলতে গিয়ে চিকিৎসকেরা মানসিক চাপকেও দোষারোপ করেছেন। এশিয়ান হার্ট ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট তিলক সুবর্ণ বলেন, ‘করোনা মহামারিতে মানসিক চাপ বেড়েছে। এটা হার্ট অ্যাটাকের অন্যতম কারণ হতে পারে।’ মানসিক চাপের মাত্রা পরিমাপ করা কঠিন, তাই কতটা মানসিক চাপে ভুগলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কতটা বাড়ে তা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে বিশেষজ্ঞরা যোগব্যায়াম, ধ্যান, শরীরচর্চা ও ওষুধের মাধ্যমে মানসিক চাপকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণ করতে পরামর্শ দিয়েছেন।এছাড়া হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়সমূহ এড়িয়ে যেতে হবে ও নিয়মিত চেকআপ করতে হবে।
হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ
হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকের মানে এটা নয় যে, লক্ষণ ছাড়াই সংঘটিত হবে। এই হার্ট অ্যাটাকেও সতর্ককারী লক্ষণ দেখা দিয়ে থাকে, যা লক্ষ্য করলে দ্রুত চিকিৎসা পাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। এরকম হার্ট অ্যাটাকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য লক্ষণ হলো, বুকে অনবরত ব্যথা বা চাপ অনুভব করা- যা কিছু মিনিট স্থায়ী হয় এবং পুনরায় ফিরে আসতে পারে। আরেকটি লক্ষণ হলো- পরিশ্রমের সময় ব্যথা অনুভব করা, কিন্তু বিশ্রাম নিলে ভালবোধ করা। হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকের অন্যান্য প্রচলিত লক্ষণ হলো- বমিভাব, বদহজম, ঘেমে যাওয়া, ক্লান্তি, চেতনা হারাচ্ছে মনে হওয়া এবং কাঁধে বা চোয়ালে ব্যথা ছড়িয়ে পড়া। এসব লক্ষণ দেখলে জরুরি চিকিৎসা নিতে হবে। এটা মনে রাখতে হবে যে, দুজন লোক হার্ট অ্যাটাকের একই ধরনের লক্ষণে নাও ভুগতে পারে।
৩০-৫০ বছর বয়সে হার্ট অ্যাটাক বেশি হচ্ছে কেন?
বয়স কম বলে নিজেকে হার্ট অ্যাটাকের আওতামুক্ত মনে করার অবকাশ নেই। কেবল বয়স্ক মানুষ নয়, অল্প বয়সীদেরও হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। এটা সত্য যে, বার্ধক্যে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। বিশেষ করে হার্টে ও রক্তনালীতে সমস্যা থাকলে ঝুঁকি যে আকাশচুম্বী হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু আজকাল অল্প বয়সেও উল্লেখযোগ্য হারে হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে। এখানে অল্প বয়সী বলতে তরুণ ও মধ্যবয়স্ককে বোঝানো হচ্ছে, যাদের বয়স ৫০ এর নিচে। বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনাকালে ৩০-৫০ বছর বয়সে হার্ট অ্যাটাকের হার আরো বেড়েছে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুটি কারণ হচ্ছে- চিকিৎসা পেতে বিলম্ব ও কোভিড জনিত শারীরিক জটিলতা। গত ১০ বছরের বিশ্ব পরিসংখ্যান বলছে, তরুণ ও মধ্যবয়স্কদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকের হার প্রতিবছরে ২ শতাংশ করে বেড়েছে।
হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়
চিকিৎসকেরা জানান, আধুনিক জীবনযাপনে অসংগত পরিবর্তন ও শারীরিক নিষ্ক্রিয়তাই হলো হার্ট ও রক্তনালীতে সমস্যা বেড়ে যাওয়ার দুটি বড় কারণ। অল্প বয়সেই হার্ট অ্যাটাক বা হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধির সম্ভাব্য কারণসমূহ হলো-
* ধূমপান ও তামাকের ব্যাপক ব্যবহার
* এমন কাজকর্মে ব্যস্ত থাকা যা শরীরকে নিষ্ক্রিয় রাখে
* দীর্ঘসময় বসে থাকা
* অত্যধিক লবণ খাওয়া
* দাঁতের যত্ন না নেওয়া
* পর্যাপ্ত না ঘুমানো
* স্থূলতা তথা শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে না রাখা
* মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা
* মাদক সেবন
* উচ্চ কোলেস্টেরল
* পরিবারের কারো হার্ট অ্যাটাক বা হৃদরোগ হয়েছে
* ডায়াবেটিস
* অস্বাস্থ্যকর খাবার, বিশেষত উচ্চ চর্বি ও কোলেস্টেরল রয়েছে এমন খাবার
* অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন।
হার্ট অ্যাটাক এড়াতে করণীয়
তরুণ বা বৃদ্ধ, যে কারো হার্ট অ্যাটাক জীবন বিনাশের কারণ হতে পারে। এমনকি মৃত্যু না হলেও স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। একারণে যা করলে হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ হতে পারে তাতে মনোযোগী হওয়া উচিত। এমন জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে হবে যা হার্টে সমস্যার ঝুঁকি বাড়ায় না। এমন খাবার খেতে হবে যা রক্তনালীতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না। যাদের বয়স ৩০-৫০, তারা হার্ট অ্যাটাক বা হৃদরোগ প্রতিরোধে এসব পরামর্শ মেনে চলতে পারেন-
* খাদ্যতালিকায় হার্টের জন্য উপকারী এমন খাবার রাখুন
* প্রক্রিয়াজাত খাবার পরিহার করুন
* প্রতিদিন শরীরচর্চা করুন এবং শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকুন
* মাদকদ্রব্য ও তামাকজাত দ্রব্য এড়িয়ে চলুন
* হার্ট অ্যাটাকের পারিবারিক ইতিহাস থাকলে অল্প বয়স থেকেই স্ক্রিনিং করুন
* মানসিক চাপ কমে বা মনে প্রফুল্লতা আসে এমনকিছু করুন
* শরীরে হৃদরোগ ছাড়াও অন্যকোনো সমস্যা থাকলে চিকিৎসা করুন
* হার্টের সমস্যা সংক্রান্ত লক্ষণ বা উপসর্গ সম্পর্কে জ্ঞান রাখুন।
এন এইচ, ০৫ আগস্ট
স্বাস্থ্য | DesheBideshe
2021-09-05 16:38:29
Source link
Leave a Reply