কেস স্টাডি
তিন বছর বয়স নাবিলের (কাল্পনিক নাম)। বাবা-মা নাবিলকে নিয়ে বিভিন্ন চিকিৎসকের কাছে ছুটছেন। কোনো কূলকিনারা পাচ্ছেন না। নাবিলের মৃগীরোগ। এ ছাড়া সে মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী। কথা বলে না, বসতে পারে না, এমনকি চোখেও দেখে না।
কেন এমন হলো
নাবিল যখন পেটে আসে, মা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানেই ছিলেন। মায়ের কোনো সমস্যা ছিল না। কেবল নাবিল হওয়ার দিন রক্তচাপ একটু বেড়ে গিয়েছিল। যা হোক, স্বাভাবিক প্রসবই হয়। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরপরই জোরে চিৎকার দিয়ে কেঁদেছিল শিশুটি। দুই দিন পর্যন্ত ভালোই ছিল, কিন্তু তৃতীয় দিনই খুব করে কাঁদে, কোনো অবস্থাতেই থামানো যাচ্ছিল না। গুরুজনেরা বলেছিলেন, বাচ্চার পেটব্যথা করছে। সে জন্য পেটে হালকা সেঁকও দেওয়া হয়েছিল। এভাবে কাটল তিন দিন। চতুর্থ দিনে মা লক্ষ করলেন, তার একটা হাত ও পা হঠাৎ করে একটু নড়ে উঠছে বা ঝাঁকি দিচ্ছে। দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নেওয়া হলো। চিকিৎসক বললেন, বাচ্চার খিঁচুনি হচ্ছে। শুনে সবাই অবাক হলেন যে কান্না থেকে আবার কীভাবে খিঁচুনি হতে পারে।
চিকিৎসার পর কান্না থেমে গেল, সঙ্গে হাত-পায়ের ঝাঁকুনিও। এভাবে কাটে আরও এক-দুই মাস। বাচ্চার ঘাড় শক্ত হচ্ছে না, কারও মুখের দিকেও তাকায় না বা হাসে না। একটু দুশ্চিন্তা হলেও পরিবারের অনেকেই বলেন যে সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। এভাবে চলল আরও কিছুদিন। নাবিলের চার মাস বয়সে একদিন হঠাৎ করে শরীরজুড়ে খিঁচুনি হলো। সে সময় শরীরে জ্বর ছিল না। দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নেওয়া হলো। শুরু হলো খিঁচুনির চিকিৎসা। সেই থেকে চিকিৎসা চলছেই। খিঁচুনি কখনো বাড়ে, কখনো কমে। অবস্থার উন্নতি না দেখে বিভিন্ন চিকিৎসকের কাছে নেওয়া হলো। নতুন কোনো ওষুধ শুরু করলে প্রথম দিকে একটু কমে, এরপর কিছুদিন গেলে ঠিক আগের পর্যায়ে চলে আসে। আস্তে আস্তে ঘাড় কিছুটা শক্ত হলেও সে বসতে পারে না, কোনো খেলনাও ধরে না বা কারও মুখের দিকে তাকায় না। চক্ষুবিশেষজ্ঞের কাছে নেওয়া হলো। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানা গেল চোখ পুরোপুরি ভালো। তবে চোখে না দেখার কারণ মস্তিষ্ক। মস্তিষ্কের এমআরআই পরীক্ষা করে জানা গেল চোখের স্মায়ুগুলো মস্তিষ্কের যে অংশে গেছে, সে অংশে রয়েছে ক্ষতের চিহ্ন।
এ রকম হওয়ার কারণ কী
নবজাতকের অতিরিক্ত কান্না, যেটা কোনোভাবেই থামানো যায় না, সেটা আসলে একটা রোগের লক্ষণ। সাধারণত রক্তের প্রদাহ (সেপসিস) হতে পারে। রক্তের এই প্রদাহ দ্রুত মস্তিষ্কে ছড়ায়। তখন বাচ্চার খিঁচুনি বা ঝাঁকি হতে পারে। মস্তিষ্কে প্রদাহ ছড়িয়ে পড়ে। দেরিতে এর চিকিৎসা শুরু করলে মস্তিষ্কের কিছু অংশ স্থায়ীভাবে নষ্ট হয়ে যায়। এ অবস্থায়ও যদি চিকিৎসা না করা হয়, তাহলে মস্তিষ্কের যেসব অংশ ভালো আছে, সেগুলোও নষ্ট হয়ে যায়।
এখন তাহলে চিকিৎসা কী
— খিঁচুনি পুরোপুরি বন্ধ করা
— বিভিন্ন রকমের থেরাপি দেওয়া,
যেমন মুখ ও হাত-পায়ের ব্যায়াম।
এই দুটো একসঙ্গেই চালাতে হবে, না হলে শিশু স্থায়ীভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে যাবে। যত তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু হবে ততই শিশুর পুরোপুরি সুস্থ ও স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
মনে রাখবেন, জন্মের মুহূর্তে বাচ্চার কান্না অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু জন্মের এক-দুই ঘণ্টা পর থেকে যেকোনো সময়ে অতিরিক্ত কান্না একটা রোগের লক্ষণ। এ রকম হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
সেলিনা ডেইজী
শিশু, শিশু নিউরোলজি ও ক্লিনিক্যাল নিউরোফিজিওলজি বিশেষজ্ঞ,
সহযোগী অধ্যাপক, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ০১, ২০০৯
Leave a Reply