ছোট্ট বিভুকে হাতের লেখার জন্য মায়ের বকুনি খেতে হয় সারা দিনই। খাবেই বা না কেন? লেখা খারাপ হওয়ার কারণে পরীক্ষার নম্বরটাও কমে যাচ্ছে প্রতিবার। বকুনি খাওয়া বিভু তাই মনে মনে ভাবে… ‘ইস্, স্কুলের পরীক্ষাটা মুখে মুখে হলে দেখিয়ে দিত সে…।’
হাতের লেখা নিয়ে ছোট-বড় অনেকেরই নাজেহাল অবস্থা। তবে সুন্দর হাতের লেখা মানেই যে সুন্দর গোটা গোটা অক্ষরে লেখা, তা কিন্তু নয়। সুন্দর হাতের লেখা হচ্ছে পরিচ্ছন্ন হাতের লেখা, যা সবাই সহজে বুঝতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাখাওয়াত্ আনসারী বলেন, ‘ভাষা হচ্ছে ভাব প্রকাশের মাধ্যম। তাই ভাষার লিখিত রূপটি ভাব প্রকাশে বেশি ভূমিকা রাখবে ভালো হাতের লেখা। অর্থাৎ যে লেখা যত বেশিসংখ্যক মানুষ সহজে বুঝতে পারবে, সেটাই তত সুন্দর।
যত দিন পর্যন্ত মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কৃত হয়নি, তত দিন বিশ্বজুড়ে হাতের লেখা প্রচলিত ছিল। মুদ্রণযন্ত্র আসার পর হাতের লেখার দুটি রূপ চলে এল। মুদ্রিত রূপ ও লিখিত রূপ। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে যখন এই মুদ্রিত রূপটি এল, তখন বলা হতো লেখার মতো ছাপা। দীর্ঘকাল ধরে এ রকম চললেও আস্তে আস্তে মুদ্রিত লেখার আকৃতিটা যখন সুন্দর হয়ে এল, তখন বলা হয় ছাপার মতো লেখা। তাই সুন্দর হাতের লেখা বলতে আমরা এখন বলতে পারি, যার হাতের লেখা যত বেশি মুদ্রিত রূপের কাছাকাছি যায়, তার হাতের লেখা তত সুন্দর।’ বললেন সাখাওয়াত্ আনসারী।
হাতের লেখা খারাপের কারণ
প্রাচীনকালে মানুষের এত জাগতিক ব্যবস্থা ছিল না। তারা যে কাজটি করত খুব আন্তরিকতার সঙ্গেই করত। এখন আমরা অনেক বেশি কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তাই কোনো কাজের প্রতি আন্তরিকতাটা আগের মতো নেই। লেখার ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। শ্রম, চিন্তা, ভালোবাসা আন্তরিকতা দিয়ে এখন আর কেউ লেখে না। পাশাপাশি আমরা অনেক বেশি যন্ত্রনির্ভর হয়ে গেছি। আমাদের হাতের লেখার বিকল্প হিসেবে স্থান দখল করেছে কম্পিউটারযন্ত্র। শিশুদের বর্ণ শেখানো হয় এখন এ যন্ত্রের মাধ্যমে। এমনকি হাতে চিঠি লিখতে পর্যন্ত ভুলে গেছি আমরা। হাতের লেখা খারাপ হওয়ার এই কারণগুলোর কথা বললেন বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর হাতের লেখা বিভাগের প্রধান প্রশিক্ষক মেসবাহ উদ্দীন।
শিশুর সুন্দর হাতের লেখা
কে না চায় তার হাতের লেখা সুন্দর হোক, সবাই প্রশংসা করুক। সে জন্য চাই আন্তরিকতা ও ভালোবাসার সঙ্গে চর্চা। হাতের লেখা কিছুটা সাঁতার শেখার মতো। পানিতে না নামলে যেমন সাঁতার কাটা শেখা যায় না, তেমনি চর্চা না করে হাতের লেখাও ভালো করা যায় না। অনেকটা গাইতে গাইতে গায়েনের মতো।
হাতের লেখা সুন্দর করার এ চর্চাটি শুরু করতে হবে একদম শৈশব থেকে। কাদামাটি দিয়ে যেমন কোনো কিছুর সুন্দর একটি আকৃতি দেওয়া যায়, তেমনি একটি ছোট শিশুর কাঁচা হাতের লেখারও একটি সুন্দর রূপ দেওয়া সম্ভব। সাধারণত শিশুর হাতের লেখার হাতেখড়িটা পরিবারেই হয়। তাই প্রাথমিক দায়িত্বটা পরিবারেরই বেশি। এরপর বিদ্যালয় বা কোনো প্রতিষ্ঠানের হতে পারে।
হাতের লেখা সুন্দরের কয়েকটি ধাপ
মেসবাহ উদ্দিন বললেন, হাতের লেখা সুন্দর করার জন্য কিছু ধাপ বা পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। বর্ণ, শব্দ, বাক্য—এ তিনটি ধাপে হাতের লেখা অনুশীলন করা যেতে পারে। বর্ণের ক্ষেত্রে মাত্রাবিহীন, অর্ধমাত্রা ও পূর্ণমাত্রা বর্ণগুলোর দিকে আলাদাভাবে নজর দিন। শিশুদের বর্ণ পরিচয়ের দায়িত্বটা কম্পিউটার, সিডি, টেলিভিশনের ওপর না দিয়ে ফিরে যান পুরোনো ঐতিহ্যে। নিজেই শিশুর জন্য একটু সময় বের করে নিন। আপনার সোনামণির ছোট্ট হাতটা ধরে আপনিই শিখিয়ে দিন বর্ণগুলো। ছাপা বর্ণের একটি সুন্দর তালিকাও ঝুলিয়ে দিতে পারেন ওর টেবিলের সামনে।
আমাদের বাংলা বর্ণমালা শুধু নয়, পৃথিবীর প্রায় সব বর্ণমালাই এসেছে চিত্রলিপি থেকে। তাই ছবি আঁকতে আঁকতেও শিশুকে বর্ণমালা শেখানো যায়। বৃত্তাকার, ত্রিভুজাকার, বর্গাকার ছবিগুলো আঁকতে শেখান। বর্ণ শেখার ক্ষেত্রে অনেকটা এগিয়ে যাবে আপনার চেষ্টা।
শব্দগুলো শেখানোর ক্ষেত্রেও মজার ও শিশুদের প্রিয় শব্দগুলো নির্বাচন করুন। এতে শিশু আনন্দের সঙ্গে লেখা শিখবে।
বাক্যগুলোর ক্ষেত্রেও তা-ই। ওর পছন্দের শব্দগুলো দিয়ে বাক্য রচনা করতে দিন। ওই শব্দগুলো লাইনটানা খাতায় সুন্দরভাবে মাত্রা খেয়াল করে লিখে দিন ওর অনুশীলনের জন্য।
এ ছাড়া খেয়াল রাখুন, শিশু যে স্থানে বসে লেখা অনুশীলন করছে, ওই স্থানটিতে সে আরামবোধ করছে কি না। শিশুর বয়স ও উচ্চতা অনুযায়ী চেয়ার ও টেবিলের উচ্চতা ঠিক আছে কি না, খেয়াল রাখুন।
হাতের লেখার ক্ষেত্রে কলম ধরাটাও গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন মেসবাহ উদ্দীন। তাই শিশু সঠিকভাবে কলমটা ধরতে পারছে কি না, সেদিকে নজর দিন।
এ তো গেল কাদামাটি গড়ার কথা। এবার আসা যাক পোড়ামাটিতে, অর্থাৎ বড়দের বেলায় যাঁরা এর মধ্যে পোড়ামাটি হয়ে বসে আছেন, তাঁরা একটু চেষ্টা করলেই কিন্তু সুন্দর করতে পারেন লেখা। ব্যস্ত সময় থেকে একটু সময় বের করে প্রতিদিন চর্চা করুন হাতের লেখা অথবা আজই স্টেশনারি কোনো দোকান থেকে সুন্দর একটি কলম ও লেখার প্যাড কিনে নিন। আর রাত নিঝুম হলে আপনার প্রিয় মানুষটিকে লিখতে বসে যান একটি চিঠি…।
মডেল: রাশিদা রওনক খান
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ২৭, ২০১০
Leave a Reply