শিশুর যক্ষ্মা
‘যক্ষ্মা রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব’-যক্ষ্মা সম্পর্কে এ কথাটি আমাদের সবার জানা থাকা দরকার। সারা পৃথিবীতে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যক্ষ্মা এখনো অসংখ্য মৃত্যুর কারণ হিসেবে চিহ্নিত। যক্ষ্মা বা টিবি রোগ শুধু বড়দের হয়, এ কথা মনে করা ঠিক নয়। এ দেশে অনেক শিশুই যক্ষ্মা রোগে ভোগে। প্রোটিন শক্তি অপুষ্টিতে ভোগে যেসব শিশু, তাদের যক্ষ্মা হওয়ার ঝুঁকি বেশি। কোনো শিশু হাম ও হুপিং কাশিতে আক্রান্ত হওয়ার পর টিবি রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেকগুণ বেড়ে যায়। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, এইডস ও যক্ষ্মার জীবাণু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দুষ্টচক্রের সৃষ্টি করে। কোনো শিশু এইডসে ভুগলে যক্ষ্মা হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। আবার এইডস রোগী যক্ষ্মায় আক্রান্ত হলে খুব তাড়াতাড়ি তা মারাত্মক হয়ে ওঠে।
যক্ষ্মার কারণ
এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া-মাইক্রোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকুলোসিস বা মাইক্রো-ব্যাকটেরিয়াম বোভিস জীবাণু যক্ষ্মা রোগ সৃষ্টি করে। দৈর্ঘ্য মাত্র ২ দশমিক ৫ মাইক্রোমিটার। ফলে সহজেই ফুসফুসের অভ্যন্তরে চলে যেতে পারে।
শিশু কীভাবে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়
সাধারণত পরিবার কিংবা প্রতিবেশী বড়দের কেউ যক্ষ্মায় ভুগলে তার সঙ্গে যে শিশুর মেলামেশা হয় সে শিশুর যক্ষ্মা হওয়ার ঝুঁকি থাকে। যক্ষ্মায় আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির মাধ্যমে মাইক্রোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকুলোসিস নামক যক্ষ্মার জীবাণু বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। শিশু তার সংস্পর্শে এলে তার ফুসফুসের অভ্যন্তরে চলে যেতে পারে। একইভাবে যক্ষ্মায় আক্রান্ত লোকের প্রস্রাব কিংবা গ্ল্যান্ডের পুঁজ যক্ষ্মার জীবাণুতে ভর্তি থাকে বলে অন্যরা সংক্রমিত হতে পারে। যক্ষ্মায় ভুগছে এমন কোনো প্রাণীর দুধ, যেমন গরুর দুধ যদি পাস্তুরাইজ না করিয়ে পান করা হয় তাহলে যক্ষ্মার জীবাণু দেহে প্রবেশ করে যক্ষ্মার সৃষ্টি করতে পারে। গর্ভাবস্থায় মা যক্ষ্মা রোগে ভুগলে নবজাত শিশুও এ রোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করতে পারে।
বড়দের ও শিশুদের যক্ষ্মার পার্থক্য
বড়দের মতো শিশুদের যক্ষ্মা বেশি ছোঁয়াচে হয় না। তাদের বাড়িতে রেখে চিকিৎসা করানো যায়। শিশুদের যক্ষ্মা ফুসফুস বা শরীরের অন্য কোনো অংশে প্রাথমিক ক্ষত করার পর রক্তের মাধ্যমে দ্রুত শরীরের অন্যান্য স্থান, যেমন মস্তিষ্ক, হাড় ইত্যাদিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে, বড়দের ক্ষেত্রে যা সচরাচর দেখা যায় না।
শিশুর যক্ষ্মা রোগের উৎপত্তি যক্ষ্মায় আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির সংস্পর্শে থাকার কারণে, বড়দের বেলায় যক্ষ্মা নিজের শরীরেই লুকিয়ে থাকা অবস্থা থেকে আত্মপ্রকাশ করে থাকে। বিশেষ করে অন্য কোনো অসুখে ভুগে যখন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা লোপ পায়।
যক্ষ্মার জীবাণু শিশুর ফুসফুসে প্রবেশ করে যে প্রাথমিক ক্ষত সৃষ্টি করে শতকরা ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে তা আপনাআপনি শুকিয়ে যায়। বড়দের ক্ষেত্রে দেখা যায় তার বিপরীত চিত্র। কেননা প্রায়ই ফুসফুসে জটিল ক্ষত বর্তমান থাকে। শিশুদের যক্ষ্মায় ফুসফুসের কাছাকাছি গ্ল্যান্ড প্রধানত আক্রান্ত হয়ে থাকে, বড়দের ক্ষেত্রে এই আক্রমণ ফুসফুসে ক্ষত সৃষ্টি করে। এ ছাড়া বড়দের তুলনায় শিশুর যক্ষ্মার ক্ষতসমূহে যক্ষ্মার জীবাণু খুব কম পাওয়া যায়।
শিশুর যক্ষ্মা হয়েছে কি না বুঝবেন কীভাবে
শিশুদের যক্ষ্মা রোগ নির্ণয় খুব কঠিন। প্রায় ক্ষেত্রে রোগের খুব স্পষ্ট লক্ষণ থাকে না। সচরাচর যেসব লক্ষণ দেখা যায় তার মধ্যে রয়েছে-দীর্ঘদিন ধরে অল্প জ্বর, বিকেলের দিকে এই জ্বর কিছুটা বাড়ে, রাতে ঘাম দিয়ে ছেড়ে যায়; অনেক দিন ধরে কাশি, বিশেষ করে তা যদি ৩০ দিনের বেশি স্থায়ী হয়; খাওয়ায় অরুচি; ওজন কমে যাওয়া বা ওজন না বাড়া।
বিশেষ লক্ষণ
আমাদের দেশে যক্ষ্মায় আক্রান্ত শিশুর শতকরা প্রায় ৮০ ভাগই ফুসফুসের যক্ষ্মা হিসেবে দেখা যায়। দ্বিতীয়ত, সর্বোচ্চ হচ্ছে শরীরের বিভিন্ন গ্রন্থি বা গ্ল্যান্ডের যক্ষ্মা (টিউবারকুলোসিস লিমপেডেনোপ্যাথি)।
তৃতীয়ত, শরীরের বিভিন্ন হাড় যক্ষ্মার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যাকে বলা হয় স্কেলিটাল টিউবারকুলোসিস। এর মধ্যে সমধিক হচ্ছে মেরুদণ্ডের যক্ষ্মা বা কেরিস স্পাইন, হিপ ও হাঁটুর যক্ষ্মা। শিশুর ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের যক্ষ্মা হওয়া মারাত্মক ব্যাপার। সাধারণত যক্ষ্মার জীবাণু শরীরে প্রবেশ করার ছয় মাসের মধ্যে মস্তিষ্কের যক্ষ্মা দেখা যায়। এ ছাড়া যক্ষ্মার জীবাণু কিডনি, ক্ষুদ্রান্ত, ত্বক, লিভার ইত্যাদি অংশে আক্রমণ করতে পারে। কিডনির যক্ষ্মা যক্ষ্মার জীবাণু শরীরে প্রবেশ করার প্রায় চার থেকে পাঁচ বছর পর হয়ে থাকে। অন্যদিকে হাড়ের যক্ষ্মা হতে তা সময় নেয় তিন বছরের মতো।
শিশুর যক্ষ্মার সাধারণ লক্ষণ
অনেক দিন ধরে অল্প জ্বর, কাশি, খিদে কমে যাওয়া, খিটখিটে মেজাজ, ওজন কমে যাওয়া বা ওজন না বাড়া ইত্যাদি। শিশু ডিসিজ ভ্যাকসিন না নিয়ে থাকলে বা বিসিজি টিকার দাগ না থাকলে। পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশু টিবি রোগে আক্রান্ত বড় কারও সংস্পর্শে ছিল এ রকম কিছু জানা গেলে।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা
বড়দের কফ পরীক্ষা করে এফবি দেখা হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে যেহেতু তারা কফ গিলে ফেলে তাই পাকস্থলী থেকে খালিপেটে সকালে তরল নিয়ে পরীক্ষা করতে হয়। তবে শিশুদের যক্ষ্মা নির্ণয় করা হয় মূলত লক্ষণ ও টিউবারকুলিন/বিসিজি টেস্ট, সম্ভব হবে বায়োপসির সাহায্যে।
যক্ষ্মার ওষুধ
‘যক্ষ্মা হলে রক্ষা নেই’ এ রকম ধারণা একসময় প্রচলিত ছিল। যার কারণে ‘রাজরোগ’ নামেও অভিহিত হতো টিবি। আগেকার দিনে যক্ষ্মা রোগের নির্দিষ্ট ওষুধ প্রয়োগ করতে হতো ১৮ মাস থেকে দুই বছরের মতো। বর্তমানে অনেক ওষুধ আবিষ্কারের ফলে বেশির ভাগ যক্ষ্মা ছয় মাস নিয়মিত চিকিৎসায় সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়। এমনকি চিকিৎসা শুরুর দুই সপ্তাহের মধ্যে রোগীর রোগ ছড়ানোর ক্ষমতা কমে যায় ও সমাজের জন্য নিরাপদ হয়ে ওঠে।
গর্ভাবস্থায় মায়ের টিবি রোগ থাকলে নবজাতকের টিবি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সে ক্ষেত্রে পরীক্ষা করে দেখতে হবে, তখন মায়ের টিবি চিকিৎসা করার পাশাপাশি নবজাত শিশুকেও চিকিৎসা দিতে হতে পারে। তবে তখনো শিশু মায়ের বুকের দুধ খেতে পারবে। কিন্তু দ্রুত শিশুবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
অধ্যাপক ডা· মাহমুদ এ· চৌধুরী
শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ —
চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ২৫, ২০০৯
Leave a Reply