হাইলাইটস
- অলোক রায়চৌধুরীর বয়স ৫২ বছর। মধ্য চল্লিশে এসে এক বার নিয়মমাফিক ব্লাড সুগার টেস্ট করিয়েছিলেন।
- ধরা পড়েছিল তাঁর টাইপ-টু ডায়াবিটিস। ফলে তড়িঘড়ি ডাক্তারের কাছে ছুটলেন। শুরু হল ওষুধ। সমস্যা হল অন্যত্র।
- তার পর অলোকবাবু কিছুতেই নিয়মিত চেকআপ করাতেন না।
এইচবিএওয়ানসি-র পুরো নাম হিমোগ্লোবিন এওয়ানসি পরীক্ষা। এটি আদতে গত তিন মাসের কোনও রোগীর ডায়াবিটিস মেটাবলিজমের গড় হার। কারও যদি এই গড় মাত্রা নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তা হলে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির মতো নানা সমস্যা হতে পারে। অলোকবাবুর প্রধান গাফিলতি ছিল যে, প্রথম বার রক্তে শর্করার পরিমাণ বেশি ধরা পড়ার পরে তিনি চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু কোনও ভাবেই সেই পরামর্শ মেনে চলেননি। ফলে গত ১০-১২ বছর ধরে যখন মনে হয়েছে ওষুধ খেয়েছেন এবং যখন ইচ্ছে হয়নি, ওষুধ খাওয়া স্রেফ বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে গত এক দশকে তাঁর রক্তে শর্করার পরিমাণ কখনও ২০০ মিলিগ্রাম/ ডেসিলিটারের নীচেই নামেনি। ফলে সমস্যা বাড়তে বাড়তে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে, তাঁর কিডনি বিকল অর্থাৎ কোনও কাজই করছে না। সাধারণত, ডায়াবিটিসের কারণে কিডনির সমস্যা দেখা দিলে ধরে নেওয়া হয় রোগীর চোখেও সমস্যা তৈরি হবে। তাই অলোকবাবুর রেটিনা টেস্ট করতে দিলে দেখা যায় তাঁর ‘প্রোলিফারেটিভ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি’ হয়েছে। এবং বলে নেওয়া প্রয়োজন, অলোকবাবুর ক্ষেত্রে তা একেবারেই অস্বাভাবিক ঘটনা নয়।
অলকবাবুর ঘটনায় যেহেতু ওঁর ডায়াবিটিসের পরিমাণ বরাবরই মাত্রা ছাড়া ছিল, ফলে ওঁর দৃষ্টিশক্তি হারানোর গতি ধীরে হয়েছে, কিন্তু ক্রমশ বেড়েছে। ফলে ইন্ডোক্রিনোলজিস্টের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে তিনি দেখিয়েছেন ভালো অপথালমোলজিস্টকে। অলোকবাবুর চোখে থেরাপি শুরু হয়েছে এবং রেটিনায় বেশ কিছু ইঞ্জেকশনও দিতে হয়েছে।
ডায়াবিটিসের সমস্যা এখন ঘরে ঘরে। জীবনযাত্রায় বদল আনলেই এই রোগকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। কিন্তু যদি কেউ দিনের পর দিন টাইপ টু ডায়াবিটিসের মতো সমস্যাকে এড়িয়ে যান, নিয়মতি দেখভাল না করেন, পরীক্ষা না করান এবং নিজের ইচ্ছে মতো ওষুধ চালু ও বন্ধ করেন, তা হলে টাইপ টু ডায়াবিটিস অকালেই এমন অনেক সমস্যা ডেকে আনে, যা থেকে প্রাণের ঝুঁকিও হতে পারে। অলকবাবুর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। শুরু থেকেই সচেতন হলে তিনি ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির মতো সমস্যাকে এড়িয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি রোগটি আদতে কী?
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি কী?
দীর্ঘ দিন ধরে কেউ যদি ডায়াবিটিসের মতো রোগে ভোগেন, তা হলে ধীরে ধীরে তাঁর দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হতে শুরু করে। এই পরিস্থিতিতেই তৈরি হয় ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির মতো রোগ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি ধরা পড়ে একদম শেষ পর্যায়ে গিয়ে। তখন আর ফিরে আসার কোনও উপায় থাকে না। ডাক্তার সঞ্জয় ধওয়ন বলছেন, ডায়াবিটিসের সমস্যা দীর্ঘদিনের হলে এক সময়ের পরে তা প্রভাব ফেলে রক্তনালী বা ব্লাড ভেসেলে, শিরায় এবং ধমনীতে। এমনকি রেটিনার মতো সূক্ষ্ম জায়গায় যে ছোট ছোট ধমনী থাকে, সেখানেও প্রভাব ফেলে দীর্ঘদিন ধরে চলা ডায়াবিটিস। অনেক সময়ে রক্তনালী ছিঁড়ে যায়। ফলে চোখে রক্ত সঞ্চালন ব্যাহত হয়। আবার অনেক সময়ে রকনালীতে রক্ত জমাট বেঁধে গেলেও রক চলাচলের এই একই সমস্যা দেখা দেয়।
ঠিক কী কারণে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির সমস্যা বাড়ে?
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি হওয়ার প্রথম এবং প্রধান কারণ দীর্ঘদিন ধরে থাকা ডায়াবিটিসের সমস্যা। কিন্তু কারও যদি রক্তচাপ এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা অত্যন্ত মাত্রাছাড়া থাকে এবং অতিরিক্ত ধূমপান করেন, তা হলে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির সমস্যা জাঁকিয়ে বসে। সিনিয়র কনসালট্যান্ট এন্ডোক্রিনোলজিস্ট রিচা চতুর্বেদীর কথায়, কোনও ডায়াবেটিক রোগীর যদি হাইপারটেনশন এবং ইউরিনারি প্রোটিন লিকেজ অর্থাৎ অ্যালবুমিনিউরিয়ার মতো আনুষঙ্গিক রোগ থাকে, তা হলে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির আশঙ্কা বাড়ে। এ ছাড়া বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডায়াবেটিক রোগীদের ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির মতো সমস্যা দেখা দেওয়া খুব অস্বাভাবিক নয়।
আরও পড়ুন
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির লক্ষণগুলি কী কী?
এমনিতেই ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি ধরা পড়ে একেবারে শেষ পর্যায়ে গিয়ে। তবে এই রোগের প্রাথমিক লক্ষণগুলি হল চোখে ঝাপসা দেখা, হঠাৎ করে চোখে আলোর ঝলকানি কিংবা চোখের সামনে প্রায় সব সময়ই ভাসমান কিছু নড়তে চড়তে দেখা। এই ধরনের কোনও লক্ষণ প্রকাশ পেলে এক মুহূর্ত দেরি না করে চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির সমস্যা বাড়ছে কমবয়সিদের মধ্যেও
এখন ডায়াবিটিস হওয়ার আর কোনও বিশেষ বয়স নেই। অনিয়মের জীবনযাত্রা, ভুল খাদ্যাভ্যাস, অনিদ্রা এবং শারীরচর্চার অভাবে তরুণ-তরুণীদের শরীরেও বাসা বাঁধছে ডায়াবিটিস। ডা. সঞ্জয় ধওয়ন বলছেন, খাবারে অতিরিক্ত প্রমাণে চিনি, কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট, সেডেন্টারি লাইফস্টাইল এবং প্যাকেটজাত খাবারই এই সমস্যা বাড়াচ্ছে। চিকিৎসকেরা তাই ডায়াবিটিস রয়েছে, অথচ অন্তঃসত্বা মহিলাদের আরও বেশি করে সাবধানে থাকতে বলছেন, পরামর্শ দিচ্ছেন নিয়মিত পরীক্ষা করার।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা হু-এর মতে, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতে ডায়াবিটিসে ভুগতে পারেন প্রায় ৭৯.৪ লক্ষ মানুষ। এর মধ্যে টাই ওয়ান ডায়াবিটিসের সকলেই এবং টাইপ টু ডায়াবিটিসের প্রায় অউই তৃতীয়াংশের হতে পারে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি।
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির চিকিৎসা
চিকিৎসকেরা বলছেন, একবার ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি ধরা পড়লে তা ফিরিয়ে আনা যায় না ঠিকই। কিন্তু নিয়মিত চিকিৎসা, থেরাপি এবং পরীক্ষার মাধ্যমে ক্ষতিকে থামিয়ে দেওয়া যায়। আর যাতে দৃষ্টিশক্তি না হারায়, খেয়াল রাখা যায় সে দিকে। যদি কারও ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির লক্ষণ অল্প থাকে এবং চোখ ও ডায়াবিটিস- দুইয়ের চিকিৎসাই একসঙ্গে করা যায়, তা হলে সমস্যা খানিক হলেও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি গুরুতর পর্যায়ে গেলে অপারেশন বা লেসার থেরাপি ছাড়া উপায় থাকে না।
তাই সময় থাকতেই সচেতন হোন। কারণ, ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির সমস্যা একেবারে নির্মূল করা যায় না ঠিকই, কিন্তু রোগী চাইলেই সেই রোগের গতি মন্থর করতে পারে।
Health and Fitness Tips in Bengali শরীর-গতিক, Yoga and Exercise Tips in Bangla
2021-08-26 17:26:23
Source link
Leave a Reply