‘অনেকের ধারণা ক্যান্সার রোগ হলো ধনীদের ও বৃদ্ধদের সমস্যা। এটি সত্য নয়।’ বলেছেন রিচার্ড হর্টন, বিশ্বখ্যাত মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেটের সম্পাদক ও প্রকাশক। ২০০৭ সালের এপ্রিলে সিঙ্গাপুরে ক্যান্সার শীর্ষক দুই দিনের একটি কর্মশালায় এই বক্তব্য দেন রিচার্ড হর্টন।
তিনি আরও বলেন, ‘অন্যদের ধারণা, ক্যান্সার একটি অপ্রতিরোধ্য রোগ, অবশ্যম্ভাবী; জিনগত প্রবণতা রয়েছে এর পেছনে। এ কথাও সত্য নয়। ৪০ শতাংশ ক্যান্সার প্রতিরোধ করা যায় কেবল জীবনযাপনকে পাল্টে দিলে।
সিঙ্গাপুরে এই সম্মেলনে বক্তারা মতামত ব্যক্ত করেন, ২০২০ সালের মধ্যে এশিয়ায় ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা বাড়তে পারে নাটকীয়ভাবে। প্রধান কারণ হচ্ছে, এ অঞ্চলে লোকের গড় আয়ু বৃদ্ধি এবং জীবনযাপনে পরিবর্তন। সংক্রামক ব্যাধিকে টিকা এবং উন্নত ওষুধ দিয়ে ঠেকানো যাচ্ছে, স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতি হচ্ছে; মানুষ বেশি স্বাস্থ্যসচেতন হচ্ছে-এ জন্য লোকের প্রত্যাশিত গড় আয়ু বাড়বেই।
আর এর ফলে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে, উন্নত প্রযুক্তির ফলে ক্যান্সার চিনহিতও হচ্ছে বেশি। আবার পরিবেশদূষণ বাড়ছে, কীটনাশকের ব্যবহার বাড়ছে; খাদ্যে ভেজাল, ধূমপান-এ সবই ক্যান্সার হওয়াকে প্ররোচিত করার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। খাদ্যাভ্যাস, চর্বি ও ফাস্টফুড, ট্রান্সফ্যাটের ব্যবহার-এগুলোও কম দায়ী নয়। এসব পরিবর্তনের শিকার হচ্ছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দরিদ্র দেশগুলোর মানুষ।
উন্নয়নশীল দেশগুলোয় জনসংখ্যা ক্রমে বাড়ছে, মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু বাড়ছে, খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপনে ঘটছে পরিবর্তন; অথচ এসব দেশে ক্যান্সার স্ক্রিনিং, টিকা ও ব্যয়বহুল চিকিৎসা জনগণের আওতার মধ্যে নেই-এ রকম পরিবেশ ও পরিস্থিতি ক্যান্সার সমস্যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য গুরুভার সমস্যা হয়ে আছে।
সিঙ্গাপুরে ল্যানসেট মেডিকেল জার্নালের আনুকূল্যে আয়োজিত দুই দিনের সম্মেলনের শুরুতে এমন বক্তব্য দিলেন বিশেষজ্ঞরা। এশিয়ার দেশগুলোতে প্রধানত ক্যান্সার-সমস্যা হলো ফুসফুস, পাকস্থলী ও যকৃতের ক্যান্সার। এরপর রয়েছে স্তন ও মলাশয়ের ক্যান্সার। এ অঞ্চলে নতুন ক্যান্সার রোগী ২০০২ সালে ৪৫ লাখ থেকে বেড়ে ২০২০ সালে দাঁড়াবে ৭১ লাখে। বিশেষজ্ঞদের অনুমান এ রকমই।
প্রতিটি দেশের রোগী, তাদের পরিবার এবং স্বাস্থ্য পরিচর্যাব্যবস্থার ওপর এতে প্রচণ্ড চাপ পড়বে। সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ভাষ্য, সিঙ্গাপুরও এ থেকে রেহাই পাবে না। দেশে বৃদ্ধ লোকের সংখ্যা যত বাড়বে, সমস্যা আরও বাড়বে।
এশিয়ার সবচেয়ে বড় ক্যান্সার-সমস্যা হলো ফুসফুসের ক্যান্সার। প্রতিবছর নতুন রোগীর সংখ্যা ছয় লাখ। এর প্রধান কারণ হলো ধূমপান। অক্সফোর্ডের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সার্ভিস ইউনিট এবং এপিডেমিওলজিক্যাল স্টাডিস ইউনিটের গবেষণা ফেলো ডা· ডোনাল্ড ম্যাক্স পার্কিন বলেন, ‘এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে ৬০ শতাংশ পুরুষ ধূমপান করে। এশিয়া হলো ধূমপান মহামারির মহাকেন্দ্র।’
এশিয়ায় বাড়ছে পাকস্থলীর ক্যান্সারও। তবে নিয়মিত ব্যায়াম করে এবং নুন কম ও চর্বি কম স্বাস্থ্যকর খাদ্য খেয়ে এ ঝুঁকি অনেকখানি হ্রাস করা সম্ভব। টিকার মাধ্যমে হেপাটাইটিস ‘বি’ প্রতিরোধ করলে যকৃতের ক্যান্সার হ্রাস করা যাবে। যকৃতের ক্যান্সারও এ অঞ্চলে অন্যতম প্রধান সমস্যা।
বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর নতুন ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা হচ্ছে এক কোটি ১০ লাখ এবং প্রতিবছর ক্যান্সারে মৃতুবরণ করে ৭০ লাখ মানুষ।
লেখকঃ অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
উৎসঃ দৈনিক প্রথম আলো, ৩১ অক্টোবর ২০০৭
Leave a Reply