হাইলাইটস
- বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য যেমন ভারতবর্ষের বৈশিষ্ট্য, তেমনই ভারতের আনাচে কানাচে নানা যুগের ইতিহাসের বসবাসও এদেশের অন্যতম আকর্ষণ।
- উত্তর ভারতের সিন্ধু সভ্যতা, দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড় সভ্যতা যেমন ভারতের বৈশিষ্ট্য তেমনই পূর্ব ভারতের দুই সভ্যতার মিশ্রণের উদাহরণও জ্বল জ্বল করে ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাসে।
বিদেশ থেকে বহু মানুষ এদেশে এসেছেন। কখনও লুঠ করেছেন কখনও আবার এই দেশকে ভালোবেসে থেকে গেছেন। তাঁদের সভ্যতাও মিলমিশে গেছে ভারতের সঙ্গে। প্রতি যুগের প্রত্যেক সভ্যতারই একটি করে ইতিহাস আছে। ভারতমাতা তাঁর বুকে বছরের পর বছর ধরে লালন করছেন সেই সব ইতিহাস। কিছু উৎসাহী মানুষ সেই সব ইতিহাসে উলটে পালটে দেখেন, কেউ আবার না দেখে চলে যায়। অনেকে আবার শুধুমাত্র ইতিহাসের টানেই ভারত ভ্রমণ করে বেড়ান। ভারতে ঐতিহাসিক নিদর্শনযুক্ত পর্যটনস্থল অনেক আছে। যার মধ্যে বেশিরভাগই জনপ্রিয় এবং বিখ্যাত। দেশ বিদেশ থেকে পর্যটকরা সেখানে ভিড় জমান। কিন্তু এমন কিছু স্থান আছে যার ঐতিহাসিক মূল্য অসীম হলেও খুব কম পর্যটকই সেখানে বেড়াতে যান।
ঊনকোটি, ত্রিপুরা
ত্রিপুরার প্রশাসনিক জেলা ঊনকোটি। পাহাড় এবং ঝরনায় ঘেরা এই স্থানটি প্রশাসনিক ক্ষেত্রের পাশাপাশি একটি তীর্থক্ষেত্রেও। প্রকৃতি যেন নিজের হাতে যত্ন নিয়ে এই স্থানটিকে সাজিয়ে দিয়েছে। ঊনকোটি শব্দের অর্থ এক কোটির চেয়ে এক কম। কথিত আছে হাজার বছর আগে শিবের ভক্তরা এসে পাথুরে পাহাড়ের গায়ে বিভিন্ন দেবতার মূর্তি খোদাই করে রেখে গেছেন। সেই খোদাই করা মূর্তির সংখ্যা ছিল এক কোটির চেয়ে একটি কম। অর্থাৎ ঊনকোটিটি। সেই থেকে জায়গাটির নাম হয় ঊনকোটি। সপ্তম থেকে নবম শতকের পাথরের গায়ে দেবতার মূর্তি খোদাইয়ের কাজ চলে। পাথরগুলির মধ্যে কেন্দ্রতে খোদাই করা হয়েছিল মহাদেবের মূর্তি। সেই মূর্তিকে ভক্তরা ডাকেন ঊনকোটিশ্বর কাল ভৈরব নামে। মাহাদেবের পাশাপাশি রয়েছে গণেশের মূর্তি। সেই মূর্তির কাজ দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। প্রতি বছর অশোকাষ্টমীর সময় এখানে তীর্থযাত্রীরা দূর দূর স্থান থেকে তীর্থভ্রমণ করতে আসেন।
বৈশালী, বিহার
বিহারের বৈশালী জেলাটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব ব্যাপক। রামায়ণ, বৌদ্ধ এবং জৈন ইতিহাসে উল্লিখিত প্রাচীন মিথিলা অঞ্চলের বৈশালী শহরের নামে এই জেলার নামকরণ করা হয়েছে। বৈশালী নামটি এসেছে রাজা বিশালের নাম থেকে। বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের উত্থানের আগে বৈশালী ছিল সমৃদ্ধ লিচ্ছবি প্রজাতন্ত্রের রাজধানী। মহাবীরের জন্মের (খ্রিস্টপূর্ব ৫৯৯ অব্দ) আগেও এই রাজ্যের অস্থিত্ব ছিল। সম্ভবত এটিই ছিল বিশ্বের প্রথম প্রজাতন্ত্র। পরবর্তীকালে এরকমই প্রজাতন্ত্র গঠিত হয়েছিল প্রাচীন গ্রিসে। লিচ্ছবি রাজ্যটি অবস্থিত ছিল বর্তমান বিহারের গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে। বৈশালীর প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে যেটুকু জানা যায় তা হল, বিষ্ণুপুরাণে বৈশালীর ৩৪ জন রাজার উল্লেখ রয়েছে। এঁদের মধ্যে প্রথম ছিলেন নভগ। ইনি সম্ভবত মানবাধিকার-সংক্রান্ত কোনও কারণে সিংহাসন ত্যাগ করেছিলেন। বৈশালীর সর্বশেষ রাজার নাম সুমতি। ইনি রামের পিতা দশরথের সমসাময়িক বলা ধরা হয়। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মগ্রন্থগুলিতে একাধিকবার বৈশালী শহরের উল্লেখ রয়েছে। রয়েছে বৈশালী এবং অন্যান্য মহাজনপদগুলি সম্পর্কে অনেক তথ্যও। এই তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৩ অব্দে গৌতম বুদ্ধের জন্মের আগে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে বৈশালী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
মহাবীর বৈশালীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। গৌতম বুদ্ধ তার শেষ উপদেশ বৈশালীতে প্রদান করেছিলেন এবং এখানেই তার মহাপরিনির্বাণের কথা ঘোষণা করেছিলেন। বহু লোককথা ও বৌদ্ধ সাহিত্যে উল্লিখিত বিশিষ্ট রাজনর্তকী আম্রপালিও বৈশালীর অধিবাসী ছিলেন। তিনি গৌতম বুদ্ধের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন।
বৈশালী শহর থেকে এক কিলোমিটার দূরে অভিষেক পুষ্করিণী অবস্থিত। এই পবিত্র জলাধারের জল বৈশালীর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অভিষেকের কাজে ব্যবহৃত হত। এই জলাধারের কাছেই জাপানি নতুন ধর্মের নিপ্পনজান-ম্যোহোজি-দাইসং সম্প্রদায় নির্মিত একটি জাপানি মন্দির এবং বিশ্ব শান্তি স্তূপ অবস্থিত। ভগবান বুদ্ধের মহাপ্রয়াণের পর তার দেহাবশেষ আটটি ভাগে বিভক্ত করা হয়। বৈশালীর অভিষেক পুষ্করিণীর কাছে সেই দেহাবশেষের একটি স্তূপ রয়েছে।
নালন্দা, বিহার
প্রাচীন ভারতে বৈদিক শিক্ষার উৎকর্ষ তক্ষশীলা, নালন্দা, বিক্রমশিলা প্রভৃতি বৃহদায়তন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির স্থাপনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। এই প্রতিষ্ঠানগুলিকে ইতিহাসবিদগণ ভারতের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবেও চিহ্নিত করে থাকেন। নালন্দা মহাবিহারের বিকাশ ঘটেছিল খ্রিস্টিয় পঞ্চম-ষষ্ঠ শতাব্দীতে গুপ্ত সাম্রাজ্য থেকে এবং কনৌজের সম্রাট হর্ষবর্ধনে সময় পর্যন্ত। গুপ্ত যুগের উদার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের ফলশ্রুতিতে খ্রিস্টিয় নবম শতাব্দী পর্যন্ত ভারতে এর বিকাশ এবং সমৃদ্ধির যুগ চলেছিল। খ্যাতির মধ্যগগনে থাকাকালীন নালন্দায় ভারত ছাড়াও তিব্বত, চীন, কোরিয়া ও মধ্য এশিয়ার পণ্ডিত ও ছাত্ররা অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা করতে আসতেন। পুরাতাত্ত্বিকদের দাবি, ইন্দোনেশিয়ার শৈলেন্দ্র রাজবংশও যে এই মহাবিহারের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিল। নালন্দা সম্পর্কে অনেক তথ্যই জানা যায় চিনা পরিব্রাজক হিউ-এন-সাং এবং ই ৎসিং-দের ভ্রমণ বৃত্তান্ত থেকে। নালন্দায় সকল ছাত্রই মহাযান এবং বৌদ্ধধর্মের আঠারোটি (হীনযান) সম্প্রদায়ের ধর্মগ্রন্থাদি অধ্যয়ন করতেন। সেই সঙ্গে বেদ, ন্যায়শাস্ত্র, সংস্কৃত, ব্যাকরণ, ভেষজবিদ্যা ও সাংখ্য দর্শনও পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল।
১৯১৫ সালে প্রথম নালন্দা অঞ্চলে নিয়মমাফিক খননকার্য শুরু করেন পুরাতাত্ত্বিকরা। ১২ হেক্টর জমিতে সুবিন্যস্ত এগারোটি মঠ ও ইঁটের তৈরি ছয়টি মন্দির আবিষ্কৃত হয়। এছাড়া ধ্বংসস্তুপের মধ্য থেকে প্রচুর ভাস্কর্য, মুদ্রা, শিলমোহর ও উৎকীর্ণ লিপিও আবিষ্কৃত হয়। এগুলির কয়েকটি নিকটবর্তী নালন্দা পুরাতত্ত্ব সংগ্রহালয়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে। ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তকমাও পেয়েছে নালন্দা।
লোথাল, গুজরাট
গুজরাটের লোথালের নাম হয়তো খুব লোকেই শুনেছেন। কিন্তু একটা সময় ছিল যখন লোথাল ছিল ভারতীয়দের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান। সময়টা প্রায় ৩৭০০ খ্রিষ্ট পূর্বে। ভারতে তখন সিন্ধুসভ্যতার বিস্তার হয়েছে। সেই সময় লোথাল ছিল বিখ্যাত শহর এবং বন্দর। মূলত লোথাল বন্দরকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল একটি ব্যস্ত শহর। মাটি খুঁড়ে এই শহরের আবিষ্কার হয় ১৯৫৪ সাল নাগাদ। এরপর ১৯৫৫ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া এখানে খনন কাজ চালায়। পুরাতাত্ত্বিকদের মতে, লোথাল ছিল বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন জাহাজবন্দর। এর মাধ্যমে প্রাচীন সবরমতি নদী হয়ে হরপ্পা সভ্যতার শহরগুলির সঙ্গে আরব সাগরের তীরবর্তী সৌরাষ্ট্রের উপকূলবর্তী এলাকাগুলির যোগাযোগ করা হত। ১৯৬১ সালে খননকাজ পুনরায় শুরু করা হলে প্রত্নতাত্ত্বিকরা নদীটির উত্তর, পূর্ব এবং পশ্চিমাঞ্চলের ভাঁজগুলি খনন করে নদী দিয়ে ডক সংযোগকারী ইনলেট চ্যানেল এবং নালা খুঁজে পায়। খননকৃত অঞ্চলের পাশে অবস্থিত প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহশালায় সংরক্ষণ করা হচ্ছে। ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে মান্যতা পেয়েছে লোথালও। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর সিন্ধসভ্যতার বেশিরভাগ স্থানই পাকিস্তানে চলে যায়। ভারতে যেটুকু স্থান অবশিষ্ট রয়েছে লোথাল তার মধ্যে অন্যতম।
পত্তডকল, কর্ণাটক
চালুক্য সাম্রাজ্যের সময়ের দ্রাবিড়িয় এবং নাগরীয় নকশায় তৈরি পত্তডকল স্মারকসমূহ অবস্থিত কর্ণাটকের বাগালকোটে মালপ্রভা নদীর তীরে। ১৯৮৭ সালে এটি ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তৰ্ভুক্ত হয়। এখানে রয়েছে নয়টি গুরুত্বপূৰ্ণ হিন্দু মন্দির এবং একটা জৈন মঠ। এর মধ্যে বিরূপাক্ষ মন্দিরটি ৭৪০ খ্ৰীষ্টাব্দে নির্মাণ করেছিলেন রানি লোকমহাদেবী। উপলক্ষ্য ছিল তাঁর স্বামীর দক্ষিণ ভারত বিজয়। এটি একটি অসাধারণ স্থাপত্য নিদৰ্শন। এই মন্দিরটি ছাড়াও এখানে রয়েছে আইহোল, বাদামি, পত্তডকল এবং ষষ্ঠ শতাব্দীর চালুক্য রাজবংশের নিৰ্মিত একাধিক মন্দির। এই মন্দিরগুলি হল উত্তর এবং দক্ষিণ ভারতীয় স্থাপত্যরীতির এক অনবদ্য মিশ্ৰণ। পত্তডাকাল এটি হিন্দু তীৰ্থস্থান। এখানে আঠটি শিব মন্দির এবং একটি শৈব মঠ রয়েছে। প্ৰাঙ্গণে রয়েছে পাপনাথ মন্দির এবং একটি জৈন মন্দির।
Lifestyle News in Bengali, লাইফস্টাইল খবর, Health Tips, Fashion Trends and Tips in Bangla
2021-08-20 16:09:46
Source link
Leave a Reply